Type Here to Get Search Results !

ওয়েস্ট পিকার্স......একটি জীবনধারা

কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে তিনি রোজ ভোর সাড়ে চারটায় বেড়িয়ে পড়েন। পরনের কাপড়কে চাদরের মতো ব্যবহার করে, মাথায় একটি ফেট্টি বেঁধে। তিনি চিনাম্মা। প্রতিদিন একই সময়ে তিনি রওয়ানা দেন তার গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। হায়দ্রাবাদ শহরের অনতিদূরে জওহরনগর মিউনিসিপ্যাল ডাম্প স্টেশন তার গন্তব্যস্থল। শরীর ভীষণরকম ভাবে বেগড়বাই না করলে ৩৬৫ দিনে এই নিয়মের কোন ব্যতিক্রম হয়না চিনাম্মার জীবনে। সময়ের একটু এদিক সেদিক মানে সমস্ত দিন নষ্ট। কারণ ঠিক ৭টায় ডাম্প স্টেশনের গেইট বন্ধ হয়ে যায়। দুই থেকে আড়াই ঘণ্টার মধ্যে চিনাম্মার পিঠের থলি ভর্তি হয়ে যায় সাত রাজার সব ধন-সম্পত্তিতে। প্ল্যাস্টিকের বোতল, ব্যাগ, ছেঁড়া জুতা, ফেলে দেওয়া সামগ্রী, ধাতব ভাঙ্গা যন্ত্রের অংশ। আরও কত কি জমায় সে তার থলিতে। আমরা যেগুলিকে চিনি জঞ্জাল নামে। নিজস্ব স্টাইলে প্রতিটি সামগ্রীকে আলাদা আলাদা ভাবে প্যাকিং ও বাণ্ডেল করেন বছর ৪৮এর চিনাম্মা। ঘণ্টা খানেক পর বিক্রি করেন নির্দিষ্ট দোকানে। কেজি প্রতি ৫টাকা। সব মিলিয়ে ১৫০টাকা পেলে এটাই বিশাল ব্যাপার। চিনাম্মা একজন ওয়েস্ট পিকার্স। সারা দেশের হাজার হাজার জনের একজন। যারা জঞ্জাল কুড়িয়ে প্রতিদিন তাদের জীবিকা নির্বাহের কাজটি করে থাকেন। 
এই ওয়েস্ট পিকার্সরা ঘুম ভাঙ্গানিয়া পাখীর কলতানের অপেক্ষায় থাকেন না। ভোরের সূর্যের সুন্দর মনোময় প্রভাতী সূচনার পূর্বেই চলা শুরু হয়ে যায় তাদের দিনের। আর অন্য সকলের অনেক অনেক আগে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, অফিস আদালত চত্বর, রাস্তার দুপাশ, নালা-নর্দমা তাদের গন্তব্যস্থল। জীবনের মানে তাদের কাছে এইসব জায়গার অপ্রয়োজনীয়, অব্যবহার্য দ্রব্যাদি কুড়নো। চলতি ভাষায় যা জঞ্জাল, আবর্জনা, বর্জ্য পদার্থ রূপে পরিচিত। অর্থাৎ ওয়েস্ট। আমরা জানি, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় কাজের নামই জীবিকা। এই মানুষগুলো এই জঞ্জালকে, ওয়েস্টকে কুড়নোর মাধ্যমেই তাদের জীবিকার পথ খুঁজে নিয়েছেন। 
পিঠে বস্তা, হাতে ব্যাগ নিয়ে তারা এগিয়ে যান জঞ্জাল কুড়িয়ে। দিনের শেষে সেই বস্তা বা ব্যাগ ভর্তি হয়ে যায় প্ল্যাস্টিকের বোতল, প্যাকেট, নষ্ট মোটর পার্টস, ভাঙ্গা খেলনা, পানীয়ের বোতল, চা-কফির কাপ, গ্লাস আরও কত কি। দিনান্তে ব্যাগ ভর্তির হিসাবে যদি থাকে সামান্য অপ্রতুলতা, তা যেন হয়ে যায় এক বহুমুখী টেনশন, মন খারাপের উপাদান। কারণ এই কুড়িয়ে আনা দ্রব্যাদি, জঞ্জাল বিক্রি করেই যে চলে তাদের সংসার জীবনের ধারা। এটাই তাদের জীবিকা। মাস ঘুরে বছর, বছর ঘুরে যুগ- এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। ভারতবর্ষের এমন কোন শহর হয়তো পাওয়া যাবেনা, যেখানে জঞ্জাল কুড়নোর এই ধারাকে খুঁজে পাওয়া যাবেনা। 
জঞ্জাল কুড়নোর এই প্রক্রিয়ায় কঠিন, দৃঢ় বর্জ্যকে পুনব্যবহার্যকরণে অদৃশ্য কর্মশক্তি রূপে বিরাট ভূমিকা নিচ্ছেন এই  ওয়েস্ট পিকার্সরা। পেশাগত স্বীকৃতির দিক থেকে এই বিশাল কর্মশক্তি ভীষণ ভাবে অবহেলিত। বিভিন্ন বিশ্লেষণ এবং তথ্যসুত্রে জানা যায়, সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া - কি সামাজিকভাবে, কি অর্থনৈতিকভাবে মানুষগুলোই এই পেশায় যুক্ত। জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলি তাদের কাছে দূরের আকাশের তারার মতো। মূলত দারিদ্রতাই তাদের সমাজের জঞ্জাল অপসারণের এই পেশায় যুক্ত করে রেখেছে। প্রশ্ন হচ্ছে- ওয়েস্ট পিকার্সরা কি শুধুমাত্র তাদের জীবন-জীবিকার উদ্দেশ্য সাধনেই এই কাজটুকু করে যাচ্ছেন ? উত্তরটা - না। সেই কাকভোর থেকে মানুষগুলি যে কাজে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নিজেদের যুক্ত করে রাখেন তাতেই শহুরে নর্দমাগুলি প্ল্যাস্টিক ব্যাগ, বোতল, মানুষের ফেলে দেওয়া জিনিষ থেকে মুক্ত হয়। নর্দমার স্বাভাবিক ধারা বজায় থাকে। তাদের ঘাম নিঃসৃত শ্রমের ফলেই রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্যের পরিবেশ অটুট থাকে। সর্বোপরি তাদের হাত ধরেই মধ্যস্ততাকারী ব্যবসায়ীরা কঠিন বর্জ্যকে নিয়ে পুনর্নবিকরণ শিল্পের বিকাশ ঘটান। এইভাবেই ওয়েস্ট পিকার্সরা পরিবেশ বান্ধবরূপে বিশেষ ভূমিকা নিচ্ছেন। তাদের নিত্য দিনের কাজের ফসল হলো- সুস্থ, নির্মল, নিরোগ পরিবেশ। যে জঞ্জাল বা পুঁতিগন্ধময় আবর্জনা জনমানসে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য দায়ী, সেগুলি থেকে তারা পরিবেশকে মুক্ত করেন। নিজেদের তৈরি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এবং এই কাজটা শুরু করেন ঐ বিশেষ গোত্রের মানুষগুলি যাদের জীবনশৈলীর প্রক্রিয়ায় সমাজ জঞ্জালময় তাদের ঘুমন্ত অবস্থায়। এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, শহুরে, তথাকথিত শিক্ষিতজনের ফেলে দেওয়া জিনিষগুলিই ওয়েস্ট পিকার্সদের শ্রমের বিষয়বস্তু। আমরা চা-কফি খাই। কাপ বা গ্লাসকে ফেলি রাস্তায়। তেষ্টা মিটিয়ে পানীয়ের বোতলকে জায়গা দেই নিষ্কাশনী নর্দমায়। আমাদের অব্যবহার্য জিনিষের ঠিকানা করি যত্রতত্র। পচনশীল পদার্থ আমাদের জন্য, সমাজের জন্য ক্ষতিকারক। তবুও পচনশীল পদার্থকে ফেলার সময় আলাদা কোন ভাবনা রাখিনা আমরা। কারণ আমরা জানি পরের দিন সকালে ওয়েস্ট পিকার্সরা হাজির হয়ে যাবেন এইগুলি কুড়াতে। আগের দিনের ফেলে যাওয়া জিনিষগুলি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তারা কুড়িয়ে নিয়ে যাবেন। আমাদের দায়বদ্ধহীনতা তাদের হাত ধরে সঠিক দিশা খুঁজে পায়। সমাজ সুস্থভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারে। 
  ওয়েস্ট পিকার্সরা মূলত কাজ করেন তিন শ্রেণীতে। এক শ্রেণী আছেন যারা নিজেরা বর্জ্য করেন এবংপুনরায় ব্যাবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থা বা বড় ফার্মে বিক্রি করেন। আর এক শ্রেণীর পিকার্সরা কোন নির্দিষ্ট সমবায় সংস্থা, এনজিও এর চুক্তিবদ্ধ কর্মীরূপে জঞ্জাল, বর্জ্য সংগ্রহ করেন। এছাড়া অন্য শ্রেণীর পিকার্সরা সরকারি অধিকৃত সংস্থা যেমন নগর পালিকা, নগর উন্নয়ন সংস্থার বেতনভুক্ত কর্মীরূপে তাদের কাজটি করেন। এইভাবেই ওয়েস্ট পিকার্সরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করেন। বড় বড় শহরে মহিলারাই এই কাজটিতে বেশী মাত্রায় অংশগ্রহন করেন। সংসার প্রতিপালনে ঘরের পুরুষটিকে প্রয়োজনীয় সাহায্য তারা এইভাবেই জুগিয়ে চলেন মাসের পর মাস। যুগের পড় যুগ। পরিতাপের বিষয় এই কঠিন, অস্বাস্থ্যকর কাজে মহিলারা তাদের ছোট ছোট শিশুগুলিকেও নিয়ে আসেন। শিশু শ্রমের আইন তাদের কাছে মূল্যহীন। দারিদ্রতার অসহনীয় পীড়া এবং ক্ষুধা নিবৃত্তির আকুতি তাদের সন্তান সহ প্রতিদিন এই কাজে রাস্তায় আনে। ফলত একটি বিশেষ সংখ্যক শিশু প্রচলিত শিক্ষা থেকে যুগের পর যুগ বঞ্চিত থেকে যায়। ভবিষ্যতে অসুরক্ষিত থেকে যায়। 
জীবিকা উপার্জনের জন্য ওয়েস্ট পিকার্সরা এই পেশা বেছে নিলেও তাদের সামাজিক, আর্থিক অবস্থা বহুকাল ধরে একই জায়গায় থেকে গেছে। আগামী দিনেও থাকবে ধরে নেওয়া যায়। তাদের বাসস্থান আগেও ছিলো ঝুপড়ি-বস্তি আর এখনও তাই। তারা জঞ্জাল সাফ করে সমাজকে সুন্দর, সুস্থ রাখার কাজটি করেন, আর নিজেরা থাকেন সেই জঞ্জালে আবদ্ধ হয়ে। এই অবস্থার পরিবর্তনে সরকার কিছুটা হলেও সদর্থক ভূমিকার পরিচয় দিচ্ছেন। ওয়েস্ট পিকার্সদের বিভিন্ন এনজিও, সমবায় সংস্থার মাধ্যমে সংগঠিত করার এক প্রয়াস উপলব্ধিতে আসছে। তথ্যসূত্র অনুযায়ী, যেকোনো শহরের প্রায় ১২ শতাংশ ওয়েস্ট বা আবর্জনা অথবা জঞ্জাল রিসাইকেলের জন্য পরিষ্কৃত হয় এই ওয়েস্ট পিকার্সদের মাধ্যমে। আমাদের সমাজে এই চিনাম্মাদের জন্য আলাদা করে ভাবনার প্রয়োজন হয়ে গেছে। তারা তাদের কাজের সূত্রেই সমাজের বন্ধু। সামাজিক পরিবেশের কৌলিণ্য রক্ষায়, শুদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে অনস্বীকার্য ভূমিকা নিচ্ছেন চিনাম্মারা। তাই তাদের জন্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক ,বেতন, সন্তানদের প্রচলিত শিক্ষা, বিনা খরচে চিকিৎসা, বাসস্থান, স্বল্প খরচে অন্নের সংস্থান - এই সমস্ত মৌলিক চাহিদাগুলির পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারি ভাবে। 
এই ভাবনায় এগিয়ে যেতে পারলেই কামিনী রায়ের উক্তি - " সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে " স্বার্থক রূপ পাবে।।

লেখকঃ সেলিম জাফর
ছবিঃ সংগৃহীত
২৯শে জুলাই ২০১৮ইং                                      

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.