পরপর তিন বছর সাধ্যের শেষ সীমানায় থেকে নিউইয়র্কের 'কুইন্স' এ আমাদের ঠিকানা ছিল একটি ষ্টুডিও। আমেরিকায় 'ষ্টুডিও' বলতে এক ধরণের এপার্টমেন্ট বোঝায় যেখানে 'কিচেন টু বেডরুম' সব থাকে একটি রুমের ভেতরেই।
না ছিল তখন মোবাইল ফোন, না ছিল কোনো পাবলিক সোশ্যাল মিডিয়া। আর তাই হয়তো পৃথিবীটা তখন এতো ছোট ছিল না। তখন অনেকেই ভাবতো আমেরিকা মানেই স্বপ্নের দেশ। ওখানে ঘরে ঘরে মজুত থাকে একটি করে আলাদিনের প্রদীপ। সেই প্রদীপ থেকে genie বেরিয়ে এসে মন্ত্রবলে সব স্বপ্ন সত্যি করে দিয়ে যায়।
আমার বর স্বপনের তখন চলছে দু-দু'টো বিষয় পড়াশোনার ভীষণ ব্যস্ততা। সামনে দাঁড়িয়ে আমি -- যার কোনোরকমের চাকরি সংক্রান্ত কাজের অভিজ্ঞতা নেই।তাও আবার বিদেশে ! এ অবস্থায় পায়ের নিচের মাটি খুব নড়বড়ে মনে হতো। হেরে যাবো না তো আমরা? এমনি চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকতো দিন-রাত। অনেক হোঁচট খেতে খেতে এই অচিন দেশে আসার কুড়ি দিন থেকে বেঁচে থাকার হাল তুলে নিয়েছিলাম নিজের হাতে। তখন যারাই বলতো, "তোমাদের আর কী, আছো তো স্বপ্নের দেশে !"-- ওদের কথার উত্তরে কী বলবো বুঝে উঠতে পারতাম না।
নিউইয়র্কের 'কুইন্স' থেকে রোজ ভোরে উঠে যাত্রা শুরু হতো আমার ঠিক ছ'টার সাবওয়ে ট্রেন ধরে। ম্যানহাটনে আমি কাজ করতাম সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছ'টা, সপ্তাহে ছ'দিন। ওরকম ভাবে আমি যদি কাজ চালিয়ে যেতে না পারি, সেই ভেবে এতো ব্যস্ততার মধ্যেও স্বপন একটা পার্ট-টাইম কাজ করে যাচ্ছিলো।
ভয়ঙ্কর সব তুষারপাত, আর মাইনাসে চলা শীতে হিম হওয়া দিনগুলো কোনো ব্যতিক্রম আনতো না আমাদের জীবনে তখন। শুধু চলা, আর চালিয়ে যাওয়া-- এই ছিল আমাদের মন্ত্র। এতো কষ্টের শেষে পরপর দুটো ভালো খবর এলো --- স্বপনের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনে মাস্টার্স কোর্স -এ "টপ স্টুডেন্ট অফ দ্য ইয়ার', আর ডাক্তারী পরীক্ষার তিনটি পার্টের দুর্দান্ত রেজাল্ট ! প্রথমবারের মতো মনে হলো -- এটা সত্যিই স্বপ্নের দেশ ! তারপর থেকে যতবার কেউ না কেউ বলেছে আমরা স্বপ্নের দেশে থাকি, মনে হতো ওরা ঠিকই বলেছে - এটা সত্যিই স্বপ্নের দেশ -- যদি স্বপ্ন সত্যি করার আকাঙ্খা কারো থাকে।
আমাদের ঠিকানা পরিবর্তনের সময় এলো তারপর। স্টুডিওতে থাকার সুদীর্ঘ তিন বছরের, আর আমাদের প্রথম স্বপ্ন সফলের অধ্যায়ের সমাপ্তি এখানেই। তারপর শুরু অন্য পর্যায়, যা আর 'অচিন দেশে' আছি সেই মন নিয়ে নয়। শুরু হলো চেনা পরবাসে নিজের মূল্যবোধ নিয়ে পায়ে-পা মিলিয়ে সকলের সাথে চলার দিন।
স্বপ্ন দেখা আজও ছাড়িনি। কারণ আমার বিশ্বাস -- স্বপ্নেরা আছে, তাই আছি আমিও।
জবা চৌধুরী,কলাম লেখিকা
আরশিকথা, আমেরিকা
১৯শে আগস্ট ২০১৮ইং