Type Here to Get Search Results !

ঘুরে এলাম সনাতন ধর্মের শহর বেনারস(সমাপ্তি পর্ব) ... রীণা দাশ

(প্রথম অংশের পর)

বেনারসে গঙ্গার ঘাটের হৃদপিন্ড দশাশ্বমেধ ঘাট।জানতে পারলাম,সবচেয়ে পুরনো ঘাট এটাই।মূল আকর্ষণ গঙ্গারতি।দেশ বিদেশের প্রচুর লোক জমায়েত হন ঘাটের সিঁড়ি থেকে নৌকা পর্যন্ত।ঘাটের সিঁড়ি ঈশ্বর ফ্রি করে দিলেও নৌকাতে বসে আরতি দেখতে কিছু মাঝি দক্ষিণা ছাড়তে হয়। 

 প্রতি সন্ধ্যায় ভগবানের  নামে সম্পূর্ণ ও অপ্রতিহত প্রেম নিবেদন করা হয় আরতির মাধ্যমে।আলোচনায় জানতে পারলাম হিন্দু তীর্থক্ষেত্র হরিদ্বার,ঋষিকেশ ও বেনারসে একযোগে এই আরতি চড়ানো হয়।প্রথম দিনে ঘাটে বসেই আরতি দর্শণ করেছি।পরের সন্ধ্যায় নৌকাতে বসে আরতি দর্শণ হলো।কেননা নদীর দিকে মুখ করেই আরতি করা হয়।সংস্কৃত শ্লোক সহযোগে ,সাতজন পন্ডিত ব্যক্তি আরতি আসনে উপবিষ্ট হয়ে শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে আরতি শুরু হয়।এর মোহনীয়তা  ,সৌন্দর্যের বিশাল ব্যপ্তি চাক্ষুষ না করলে বুঝানো।মুশকিল।সবচেয়ে আকৃষ্ট হওয়ার মত,ঝড় ঝঞ্ঝায়ও নাকি আরতি স্হগিত হয় না।পঁয়তাল্লিশ মিনিটের এই আরতিতে ধ্বনিত হয় আকাশ বাতাস ধ্বনিত হয় গঙ্গামায়ের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণে।
মোহাবিষ্ঠ হতে হবে কিছুক্ষণের জন্য।ঐহিক জগত থেকে কিছুটা সময় পালিয়ে শান্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম।
আরতি দেখেছি অনেক---কখনো এর উপাচার আর উপযোগিতা নিয়ে মাথা ঘামাই নি।আগ্রহান্বিত হলাম,কেন,কি ,এই নিয়ে।মূহুর্তে উত্তর পাওয়া যায় নিজের মাঝে নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে।আসলে আমরা ভোগী মন নিয়ে যখন নিজেকে বা অন্যকে প্রশ্ন ছুঁড়ি তখন এর উত্তর আসে একরকম,যখন ত্যাগী মন নিয়ে প্রশ্ন করি তখন এর প্রত্যুত্তর আসে অন্যভাবে।এখানেই ত্যাগী আর ভোগীতে তফাৎ।।দেখলাম আরতি করার সময় প্রতিটি পদক্ষেপ আধ্যাত্মিকতার বৈজ্ঞানিক আধার মেনে করা হয়।এক সন্তকে জিজ্ঞেস  জানতে পারলাম ,আরতির নামে আসলে সাধারণ মানুষকূল যা করি তা নিছকই ঈশ্বরোপসনার নামে বিনোদনমাত্র।নিয়ম মেনে করা হয় না।তাই এগুলো উপাচারেই আবদ্ধ থাকে,উপকারে আসে না।
আরতি দর্শণের পর আশ্রমে ঢুকে রাতের অন্নভোগ গ্রহণের পর বিশ্রাম।

পরের দিন সকালে স্নান সেরে অটো নিয়ে আশ্রম থেকে দুই কিমি দূরত্বে কাশী বিশ্বনাথ দর্শণে চলে গেলাম।সাথে টাকা পয়সা ছাড়া ব্যাগ পুটুরি মোবাইল কিছু নেয়া যাবে না।ভীড় এড়াতে ছেলে আগেভাগেই অনলাইনে মাথাপিছু তিনশ টাকা করে টিকিট কেটে দিয়েছিল।কিন্তু মন্দির চত্বরে পা দিয়ে চক্ষু ছানাবড়া।সকাল সাড়ে ছটা।ফাঁকা ফাঁকা সব।ভক্ত সমাগম তেমন নেই।কারণে অকারণে তিনবার ঘুরা হল শিব জীকে।অভিষেক সেরে নিলাম মন্দিরে।কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে কাশী বিশ্বনাথ জীর ইতিহাস জানার চেষ্টা করলাম।খটকা লাগলো কোন কোন জায়গায়।বইপুঁথির তথ্য আর মুখোমুখি ভাষ্যের মধ্যে অনেকটাই ফারাক।যাই হোক এই ভাষ্যও একদিন ইতিহাস হবে,হয়তো বা পুঁথি আকারে ছাপাও হবে।সত্য মিথ্যাকে শিকেয় তুলে পা বাড়ালাম পাশেই অবস্হিত অন্নপূর্ণা মায়ের মন্দিরে।প্রণাম সেরে ফ্রি তে ভরপেট প্রসাদ নিলাম।বাইরে বেরোতেই ভীড়ের ঝটকা লাগলো।বিশাল লম্বা লাইন।নারী পু্রুষের লাইনের চক্রান্তে ফেঁসে গেলাম।দাঁড়ালাম ঠিকই---------কিন্তু ততক্ষণে দুজনার দুটি পথ দুটি দিকে গেছে চলে।বাবা ভোলানাথ সব ভুলিয়ে বোকা বানিয়ে দিলেন।ভয় পেয়ে গেছি।জনসমুদ্রে আর পথসমুদ্রে কোথায় খুঁজব ? ভুলভুলাইয়াতে আটকে গেছি।হঠাৎ হিন্দী ভাষী এক ভদ্রলোক সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন।জালে পড়ে উপকারে না অপকারে এগুচ্ছি বুঝতে পারছিলাম না।শেষে গন্তব্যে পৌঁছলাম।ভাবছিলাম ভুলভুলাইয়ার চক্করে ভোলানাথই ফেললেন না তো !! নয়তো মহামিলনের এই স্রোতের সাক্ষী হতে পারতাম কি !!

বেলা দশটা।আশ্রমে ঢুকে আবার বের হয়ে পড়ি অন্যান্য দর্শণীয় স্হানগুলো দর্শণের উদ্দেশ্যে।মন্দিরে মন্দিরে ছয়লাপ শহর।পুরো কভার করা সম্ভব নয় ভেবে আগেভাগেই বেছে নিয়েছিলাম।একে একে দুর্গা মায়ের মন্দির,ত্রিদেবের মন্দির,সঙ্কটমোচন মন্দির,তুলসী মানস মন্দির সেরে রওনা হই এশিয়ার বৃহত্তম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি দেখব বলে।পথে চলতে চলতে বেনারসের বিখ্যাত লস্যি ও মালাই পর্ব সেরে নিলাম। বেনারসের পানের প্রতি স্বপ্ন ছিল।পান মুখে দেই নি কখনো।বেনারসী পানবাহার দেখে আর লোভ সামলাতে পারি নি।আঠারো টাকার বিনিময়ে মিষ্টি পান মুখে পুড়ে নিলাম।কর্তাবাবুর মশলাপানের দাম দিতে হলো পনেরো টাকা।স্বাদে গন্ধে টাকার অঙ্ক ভুলে গেলাম।পান চিবোতে চিবোতে ইউনিভার্সিটির গেইটে।এত বিশাল পরিসর হেঁটে দেখতে গেলে সারাদিন চলে যাবে।ভালো লাগলো মূল ফটকেই ঈশ্বর উপাসনা হচ্ছে দেখে।পড়াশুনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিক চেতনা জাগ্রত হওয়া প্রয়োজন জীবনের জন্য।

এবার গন্তব্য সারনাথ।যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে দশ কিমি।গাড়ি ছুটছে সাথে আমাদের মন।পৌঁছে পঞ্চাশ টাকার বিনিময়ে একজন গাইড পার্সন নিয়ে নিলাম।মাসে ট্রাষ্ট মারফৎ চার হাজার টাকা র বেতনভোগী কর্মী নাকি এরা।যাই হোক বৌদ্ধ ধর্মের উন্মেষ ঘটেছিল এখানেই ইতিহাস পাঠে জেনেছি ,স্বচক্ষে দেখতে পেরে মোহিত হলাম।দেখা আর শোনার মেলবন্ধন ঘটল।এটাই পাওনা।অর্থ কড়ি সব গৌণ এক্ষেত্রে।এখানকার স্হাপত্যকলা আকর্ষণীয়।এবার ফেরার পালা।
বিকেল চারটা।নেমে গেলাম আবার গঙ্গার ঘাটে।দেখার পিয়াস মেটে না মনে হয়।হাঁটলে সব ঘাটকেই ছুঁয়ে যাওয়া যায়।সামনে পড়লো দ্বারভাঙ্গা ঘাট।পথ চলতি সাথীদের সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলাম এই ঘাটকে ফটোজেনিক ঘাটও নাকি বলে।ছবি খুব ভালো আসে।ইহজগতের বহু সিনেমার স্যুটিং নাকি এখানে হয়েছে।বিহারের রাজ পরিবার এই ঘাটে মহল তৈরী করেছিলেন।ফলে এর সৌন্দর্য বেড়ে গেছে।
এরপর পেলাম মানমন্দির ঘাট।জয়পুরের রাজপুত রাজ মানসিংহ এই ঘাট নির্মাণ করেন।রাজপুত বীর জয় সিং গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি জানার জন্য টেলিস্কোপ বসিয়েছেন।আরেকটা ঘাট এসে পড়লো।স্কিনদিয়া ঘাট।দেখলাম অর্ধ নিমজ্জিত শিবের মূর্তি।ঘাট নির্মাণের সময় নাকি অর্ধেক জলে ডুবে যায়।আজও সেই একই অবস্হায়।একে একে বাকী ঘাটগুলোকে ছুঁয়ে শেষে আবার আরতি দর্শণ।এবার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার সাক্ষী।দাম্পত্য জীবনকে সুখ সমৃদ্ধিতে ভরপুর করার আশায় গঙ্গামায়ের রাতুল চরণে শ্রদ্ধা সমর্পণ।বৈদিক মন্ত্রোচ্চারণের মধ্য দিয়ে উনারা ধূপ দীপ চড়ালেন।অদ্ভুত এক পরিবেশ।সমাহিত হওয়ার মতো।এজন্যই বোধহয় পশ্চিমীরা ভারতবর্ষকে আধ্যাত্মিকতার দেশ বলে মানে।মুগ্ধ চোখে কেবল তাকিয়েছিলাম।পুরো ঘাট জুড়ে কিসের নেশায় এ পশ্চিমী সন্তরা ঘাটে ঘাটে জপতপে মেতে আছেন,কে জানে !!!
এবার ফেরার পালা আশ্রমিক আবাসে।
ফেরার পথেও শেষ হয়ে ,হয় না শেষ।কেনাকাটার প্রতি মুখ ঘুরিয়ে রেখেছিলাম কদিন।হঠাৎ মাথায় চাপলো বেনারসী শাড়ি।মেয়েদের নাকি শাড়ি গয়নায় তৃপ্তি নেই।এই প্রবাদকে আরেকটু সজীব রাখতে চলে যাই বেনারসি শাড়ি ফ্যাক্টরিতে।একখানা ভেবে তিনখানা নিয়ে চলে এলাম আশ্রমে।রাত নটা।পরের দিন রওনা হতে হবে প্রয়াগরাজে।উদ্দেশ্য ত্রিবেণীসঙ্গমে অবগাহন।লক্ষ্য মোক্ষলাভ।

(সমাপ্ত)

৩রা ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.