‘দুনিয়াটা মস্ত বড় খাও দাও ফূর্তি করো আগামীকাল বাঁচবে কি না বলতে পারো’ আশির দশকের জনপ্রিয় জনি সিনেমার এই গানটি কিশোর হৃদয়ের অনূভুতিকে দারুণভাবে দাগাংকিত করেছিল।
অভিভাবকদের নানা নিয়মের বেড়াজালে থেকে নিজকে মুক্ত করার অদম্য বয়স ছিল তখন। আমাদের আগের প্রজন্মের একটি দিকনির্দেশনা ছিল সঞ্চয়ী মনোভাবাপন্ন হিসেবে আমাদের প্রজন্মকে গড়ে তোলা। সেই লক্ষ্যে আমরা বাঁশের চৌঙ্গা থেকে মাটির ব্যাংকে পয়সা জমাতাম। যারা আরেকটু অগ্রবর্তী ছিল তারা প্রাইজবন্ডের মাধ্যমে অর্থ সঞ্চয় করতো। সঞ্চয় হলো খারাপ সময়ের আর্থিক নিরাপত্তা।
হালের কিছু কার্যক্রম এই সঞ্চয় প্রবণতাকে ভীষণভাবে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। একদিকে মানুষকে সঞ্চয়ে উৎসাহিত করার জন্য জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের পেছনে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন সঞ্চয় স্কিম অটোমেশনের নামে ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা হচ্ছে।
সাধারণত নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত , অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীরাই মূলতঃ এই ধরণের সঞ্চয় স্কিমের সম্মানিত গ্রাহক। ব্যাংকিং ব্যবস্থার দীনতা এই শ্রেণীদের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের এই সব স্কিমে বিনিয়োগে বাধ্য করেছে। সকলের সম্পদের সঠিক হিসাব থাকা এবং নিয়মাফিক কর দেয়া এই অটোমেশনের ইতিবাচক দিক কিন্তু সঞ্চয়ের সিলিং বেঁধে দেয়া ও ব্যাংক হিসাবে বাধ্যতামূলক লেনদেন করা ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার একটি কৌশল।
অটোমেশনের পূর্বে বিভিন্ন স্কিম একজন সাধারণ বিনিয়োগকারী সর্বোচ্চ এক কোটি বিশ লক্ষ টাকা, একজন মহিলা বিনিয়োগকারী এক কোটি পয়ষট্টি লাখ টাকা, একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এক কোটি সত্তর লাখ টাকা ও একজন মহিলা অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী দুই কোটি পনের লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারতেন। অনেক গ্রাহক রয়েছেন যাদের সর্বোচ্চ সীমায় বিনিয়োগ রয়েছে। আর নতুন ব্যবস্থায় একজন সর্বোচ্চ পঞ্চাশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে মেয়াদ পূর্তির পর পঞ্চাশ লাখ টাকার অতিরিক্ত টাকা তাদেরকে অন্য খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
শেয়ারবাজারের অস্থিরতা আর হলমার্ক সহ নানা কারণে ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা এই সকল গ্রাহককে বিলাসী জীবন যাপনে বাধ্য করবে। মার্কেটে মুদ্রার যোগান বেশী থাকবে ফলে মুদ্রার অবমূল্যায়ন ঘটবে।
সঞ্চয়ের এই ধরনের গ্রাহকের মূল চাহিদা হলো নিরাপদ বিনিয়োগের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে মূনাফা অর্জন। এক্ষেত্রে সরকারকে বাজেটের একটা বড় অংশ মুনাফা দিতে হচ্ছে। সরকার ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে এর অর্ধেক খরচ হবে তাই সঞ্চয়ের সিলিং কমানো, কর বাড়ানো, টিআইএন বাধ্যতামূলক করা, ব্যাংক হিসাবে অর্থ লেনদেনসহ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছে যাতে এই খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ কম হয়।
সময়ের দাবি অনুযায়ী, সিস্টেম ডিজিটাইজ হবে এটাই স্বাভাবিক কিন্তু একটা কল্যানমূলক রাস্ট্রের মানুষের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা অবশ্য কর্তব্য। জাপানের মতো দেশেরও মোট অর্থের ৮৭ ভাগই সঞ্চিত অর্থাৎ মাত্র ১৩ ভাগ বিনিয়োগকৃত। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সঞ্চিত অর্থের বেশি মুনাফা প্রদান সব সময় এই শ্রেণীর মানুষ প্রত্যাশা করে না। সেক্ষেত্রে সিলিং অনুযায়ী মুনাফার হার পরিবর্তন করা যেতে পারে।
প্রথম ৫০ লাখ পর্যন্ত বর্তমান রেট, পরের এক কোটি ব্যাংক রেটে মুনাফা প্রদান করলে জনগণ আস্থার সাথে টেনশন বিহীন সঞ্চয়ে উৎসাহিত হতো। অন্যদিকে সরকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে ঋণ না নিয়ে এই উৎস থেকেই ঘাটতি বাজেট মেটাতে সক্ষম হতো। জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে ২০২২-২৩ সালের দিকে তাদের অতিরিক্ত অর্থ মার্কেটে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি সহ নানা জটিলতা দেখা দিতে পারে।
করোনার দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে যেখানে আগামীকাল বেঁচে থাকতে পারবো কিনা জানি না সেখানে এতসব মনিটরি পলিসি, ফিসকেল পলিসি নিয়ে না ভেবে বরং আশির দশকের ওই গানের বাস্তবায়ন আমরা সবাই মনোনিবেশ করি।
সঞ্জিত চন্দ্র পন্ডিত, বাংলাদেশ
সঞ্জিত চন্দ্র পন্ডিত, বাংলাদেশ
লেখক:
ডেপুটি পোস্টমাস্টার জেনারেল
ডাক অধিদপ্তর,ঢাকা
২৯শে মে ২০২০