Type Here to Get Search Results !

পুষ্পাঞ্জলি " ......... শিক্ষক দিবসে ত্রিপুরা থেকে টিংকু রঞ্জন দাস এর অনুভব

মনে পড়ে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে সেই প্রথম দিন স্কুলে প্রবেশের কথা। মুখে 'যাবোনা' 'যাবোনা' বললেও হৃদয়ে অদম্য শিহরণ। বাবাও নাছোড়বান্দা। কি আর করা? অগত্যা ভয়ে ভয়ে বিদ্যালয়ের চার দেয়ালের আবদ্ধ গন্ডিতে প্রথম পা রাখা। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা আর প্রথম দিনের সেই আদর ভালোবাসা আজও কি ভুলতে পারি? অথচ বিদ্যালয়ে আসার আগে মনে আঁকা সেই চিরাচরিত চিত্রপট-
সিড়ি বারান্দায় এদিক থেকে ওদিকে লাল চক্ষু স্যারদের ক্রমাগত পদচারণা, পড়া না শিখলে বেঞ্চের উপর উঠে দাঁড়ানো, একটু দুষ্টুমি করলেই কানে ধরা, আর বাঁশ কেটে সরু করে সযত্নে বানিয়ে আনা সেই কঞ্চিটা তো আজও চোখে ভাসে, কখন যে সেটা ছলাৎ করে পিঠের উপর কালশিটে দাগে নিজের অস্তিত্বের জানান দেয়। কঞ্চি আর স্যারদের মধ্যে অদৃশ্য এক অটুট দীর্ঘমেয়াদি মেলবন্ধন।
এমনি করে দিন যায়। গ্রাম্য বুনিয়াদী বিদ্যালয় এর গণ্ডি পার হয়ে ক্রমশ শহরের উচ্চতর বিদ্যালয়ে প্রবেশ। এতে শিক্ষাদানের প্রকৃতিতে তেমন কোন ইতর বিশেষ পরিবর্তন না ঘটলেও দুষ্টুমির প্রকৃতি অনেকটা বদলে যায়। পেছন থেকে শার্টের কোনায় টান মারা, লুকিয়ে চিমটি কাটা, মুখে ভেংচি দেওয়া কেমন যেন সেকেলে সেকেলে মনে হতো। শুরু হয় নতুন ধরনের দুষ্টুমি। কখনো পেট ব্যথা, কখনো মাথা ধরা, কখনো বা বাহুমূলে পেঁয়াজ রেখে মিথ্যে জ্বরে শরীর গরম করে ছুটি নেওয়ার আকুল চেষ্টা। আর কোনো রকমে ছুটিটা পেয়ে গেলে সে কি আনন্দ। স্যার এবং অভিভাবকদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকজন বন্ধু মিলে সিনেমা হলের এক কোণে চুপটি করে বসে অমিতাভ, মিঠুনের ডায়লগ মুখস্ত করে পরদিন অন্য বন্ধুদের সামনে নিজেকে অমিতাভ, মিঠুনের পর্যায়ে তুলে ধরা।
নিজেকে তখন অত্যন্ত চালাক বলে মনে করতাম। স্যার, দিদিমনিরা যে আমাদের চালাকি টের পেতেন কোনদিন সেটা চিন্তায়ও আসেনি। ওদেরকে ফাঁকি দিয়ে নিজেকে খুব গর্বিত মনে হতো। মাঝেমধ্যে যে উনারা কিছু বলতেন না তা নয়। যেদিন কিছু বলতেন, সেদিন মনে হতো, আমাদের থেকেও স্যার দিদিমণিরা অনেক বেশি চালাক। বকাঝকায় তেমন কোনো আমল দিতাম না। কিছুক্ষণ মনটা খারাপ থাকলেও পরক্ষণেই আবার যে কে সেই। আবার পড়া, আবার ফাঁকি, আবার সেই অমিতাভ, মিঠুন।
কোনরকমে স্কুলের গণ্ডি পার হয়ে অবশেষে মহাবিদ্যালয়। বাড়ির অভিভাবকের চোখ রাঙানি থেকে মুক্তি। স্যার ম্যাডামদের বকাঝকা থেকে মুক্তি। বাঁধনহারা মুক্তির আনন্দে জীবন যেন নদীর স্রোতের মতো বয়ে চলে। সমস্ত বাধাই যেন সেদিন মনে হতো শক্তিহীন। নিজে নিজেকে বন্ধনে আবদ্ধ না করলে অন্য সমস্ত বাধা সেদিন ছিল তুচ্ছ। আনন্দ! সে কি আনন্দ! মুক্তির আনন্দ!
বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে কিছু টের না পেলেও আজ যখন একান্তে সেই দিনগুলোর কথা মনে হয়, প্রতিটি স্মরণীয় ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভেবে দেখি, বুঝতে পারি সবখানেতেই ছিল স্যার দিদিমণিদের ছায়া। নিজেকে যতটা চালাক ভাবতাম আসলে ঠিক ততটাই বোকা ছিলাম। স্যার দিদিমনিরা ভালোবাসতেন বলেই আমাদের সেদিনের দুষ্টুমিগুলোকে উনারা সন্তানসুলভ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতেন। প্রকট কিংবা প্রচ্ছন্নভাবে এই যে মায়া। দুষ্টুমি যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করা যায় উনারা যেমন প্রশ্রয় দিতেন আবার নিয়ন্ত্রণহীন দুষ্টুমিতে রক্তচক্ষুও হতেন। সঠিক সময় সঠিক উপদেশ প্রদান করে সঠিক পথের দিশা পরিদর্শনে উনারাইতো ছিলেন সেদিনকার রথের সারথি।
ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের জন্মদিন তথা জাতীয় শিক্ষক দিবসের এই মহান শুভদিনে আমি সেই সখা, দার্শনিক তথা নিয়ন্ত্রকদের স্মরণ করে তাদের পাদপদ্মে আমার হৃদয়ের পুষ্পাঞ্জলি অর্পণ করছি।

টিংকু রঞ্জন দাস,ত্রিপুরা
৫ই সেপ্টেম্বর ২০২০


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.