"গুরু ব্রহ্মা গুরু বিষ্ণু গুরুদেব মহেশ্বরঃ
গুরু সাক্ষাত পরম ব্রহ্ম তস্মৈ শ্রী গুরুবে নমঃ।"
প্রাচীনকালে আধ্মাত্মিক এই গুরুবন্দনা দিয়েই গুরুকূলে বা গুরুগৃহে পাঠদান করতেন গুরুদেবরা।বর্তমান সময়ে শিক্ষকরা পাঠদান করছেন বিদ্যালয়ে। সময়ের ধারায় গুরুকূল পরিবর্তিত হয়েছে বিদ্যালয়ে আর গুরু পরিবর্তিত হয়েছে শিক্ষকে।কিন্তু নীতি ও আদর্শ এক রয়ে গেছে।
আজ সারা ভারতবর্ষ জুড়ে শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে।এদেশের মত সারা বিশ্বেও শিক্ষক দিবসকে বিশেষ দিন হিসাবে পালন করা হয়।ভারতবর্ষে প্রাচীনকালে গুরুদের উদ্দেশ্য গুরু পূর্ণিমা পালন করা হত পূর্ণচন্দ্র দিবসে।হিন্দু ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বাংলা আষাঢ় এবং ইংরেজী জুন জুলাই মাসে।
1962 সাল থেকে ভারতবর্ষে শিক্ষক দিবস পালনের কাজটি চলে আসছে ধারাবাহিকভাবে।এই দিনে কেবলমাত্র শিক্ষক শিক্ষিকারাই নন,মা বাবা ,ভাই বোন যাদের কাছ থেকেই আমরা শিক্ষা গ্রহন করছি ,সবাইকেই সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করার দিন।
1994 সালের 5th Oct.UNESCO এই দিনটি পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করে।এর পর থেকে সারা বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তারিখে দিনটিকে উদযাপন করা হয় শিক্ষকদের সম্মানার্থে।কিন্তু ভারতবর্ষে এই দিনটি পালিত হয় 5th Sep.
ওই দিনটিতে তৎকালীন ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণান জন্মগ্রহণ করেছিলেন।তিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক ও পন্ডিত ব্যক্তি।এবং অন্যদিকে প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ।শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অপরিসীম।তাঁর ভাবধারাতেই প্রতিফলিত হয়েছিল,একজন শিক্ষকই বন্ধু,দার্শনিক এবং পথ প্রদর্শক হতে পারেন।তাঁর ধারণায় শিক্ষকই পারেন আমৃত্যু কাউকে শিক্ষার দোড়গোরায় হাত ধরে নিয়ে যেতে।জ্ঞানের আলোকবর্তিকায় মনের চক্ষু উন্মিলীত করতে এবং হৃদয়ের সাথে একাত্ম হতে।পারিবারিক ব্যবস্হা হতে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববোধ গঠন একমাত্র শিক্ষকের মাধ্যমেই সম্ভব এ বিশাল যাত্রা পাড়ি দেওয়া ,এ ভাবনা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত।
এহেন কিংবদন্তী ব্যক্তিটি ছিলেন অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন শিক্ষক এবং ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব।ছাত্রছাত্রিরা তাঁর জন্মদিনকে খুব জাকজমকপূর্ণভাবে পালন করতে চাইলে তিনি ছাত্রদের বলেছিলেন,তিনি খুব গর্ববোধ করবেন যদি তাঁর জন্মদিনকে শিক্ষকদের সম্মানে উৎসর্গ করা হয়।তখন থেকেই দিনটি শিক্ষক দিবস হিসাবে পালন করা হচ্ছে।আজ ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণানের 130 th জন্মদিন।
উদাত্ত কন্ঠে তিনি আওয়াজ তুলেছেন যে শিক্ষাদান প্রক্রিয়া হচ্ছে মানুষের মনকে প্রভাবিত করার জন্য উৎকৃষ্ট পন্হা।জীবিকা নির্বাহ সেখানে গৌন,মূখ্য হয়ে উঠে সেবা।উৎসর্গীকৃত মন ছাড়া শিক্ষাদান প্রক্রিয়া ব্যহত হয়।শিক্ষাদানকে তাই ডঃ রাধাকৃষ্ণান সেবা বলে চিহ্নিত করে গেছেন।শিশু কিশোর অবস্হা থেকে যুবা বয়স পর্যন্ত মনকে গড়েপিটে নেয়া শিক্ষকের কাজ।অনেকটা কাঁচা মাটিকে ছাঁচে ফেলে আকৃতি দেওয়ার মত।একসময় তা নিরেট হবে শিক্ষকের ছোঁয়ায়।জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে ছাত্রসমাজকে আলোর দিশা দেবেন শিক্ষক।তাঁর ধারণায় শিশুদের মধ্যে মূল্যবোধের জাগরণ ঘটাবেন শিক্ষক।সমাজ গঠনের কারিগর শিক্ষকরাই পারেন সমাজে ছেলেমেয়েদের চিন্তা,চেতনায় ও মননে শিক্ষার প্রবাহকে উজ্জীবিত করার মহান দায়িত্ব নিতে পারেন সেবাব্রতের দ্বারা।
ডঃ রাধাকৃষ্ণাণের মতে একজন শিক্ষক শুধু পাঠক্রমের ধারণাই তৈরী করেন না,সেই সাথে জীবনের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার পন্হাপদ্ধতিরও নির্দেশ দান করেন।শিক্ষকরাই পারেন একটা এবড়োথেবরো পাথরকে প্রকৃত গড়ন দিয়ে সুন্দর মূর্তি গড়তে।ছেলেমেয়েদের মধ্যে সুপ্ত অন্তর্নিহীত শক্তিকে জাগ্রত করে অমিতশক্তির অধিকারী করে তুলতে পারেন শিক্ষকই।কোন সময় শিক্ষক হবেন ছাত্রের বন্ধু,কখনো দার্শনিকের ভূমিকায় আবার প্রয়োজনে নির্দেশকের ভূমিকায়।শিক্ষার কোন শেষ নেই,এ জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া।শিক্ষক তার সাধ্যের অতীত ছাত্রদের শিক্ষাদানে ব্যপৃত থাকবেন ,তবেই শিক্ষকরা ছাত্রদ্বারা সঠিক মূল্যায়িত হবেন বলে ডঃ রাধাকৃষ্ণান বিশ্বাস করতেন।
তাঁর রচিত "Political thinkers of modern India" বইটিতে তিনি শিক্ষকদের গুরুত্ব সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন।ভারতবর্ষের মত গনতান্ত্রিক দেশে শিক্ষকদের তিনি জাতি গঠনের কারিগর হিসাবে উল্লেখ করেছেন।এবং এজন্য শিক্ষকদের উদাত্ত কন্ঠে সম্মান জানানোর আহ্বান জানিয়েছেন।নীতি ও মূল্যবোধের নিরীখে শিক্ষকরাই জাতি গঠনে অগ্রনী ভূমিকা নিতে পারেন বলে তাঁর ধারণা ছিল।
প্রতিবেদনঃ রীণা দাস,শিক্ষিকা,ত্রিপুরা
ছবিঋণঃ ইন্টারনেট হইতে সংগৃহীত
৫ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ইং