Type Here to Get Search Results !

আজকের গল্প.... "ম্যাজিক"

বয়স তখন চার বা পাঁচ হবে। মায়ের মুখে প্রথম ওই শব্দটা শোনে অভি। ম্যাজিক।
মা বলতো, " সোনা আমার, এইটুকু খেয়ে নাও। তাহলেই ম্যাজিক দেখাবো"
খাওয়া শেষ হতে না হতেই ছোট্ট অভির বায়না,
ম্যাজিকটা কি তা না বুঝলেও মা যখন বলেছে ভালো কিছুই হবে, এই ভেবে টপাটপ খেত সে। " মা।ও মা। এবাল ম্যাদিক????"
কি যে খুশি হতো অভি! ও চকলেট চিনতো না।ওর কাছে ওইটাই ম্যাজিক।
হাত বুলিয়ে চোখদুটো ঢেকে দিত মা। এরপর হাতে ধরিয়ে দিতো সিলসিলা কাগজে মোড়া একটা চকলেট।
এক দুপুরে চুপিচুপি দোকানে গিয়ে পঞ্চাশ টাকার নোটটা অভি বললো, " একটা ম্যাদিক দেন তো!"
একবার বাসায় বেড়াতে এসে রাহেলা ফুপু হাতে পঞ্চাশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে গেল অভির হাতে। মায়ের অগোচরে। শুধু বলেছিল, " আব্বু, দোকান থেকে কিছু কিনে খেও"
অভি ভাবলো, ওর "ম্যাদিক" মনে হয় কেড়ে নিতে চায় দোকানী। পেছনে না তাকিয়ে একদৌঁড়ে বাসায়।মা ঘুমাচ্ছে।
দোকানদার তিনবার বলার পর বুঝলো এবং একটা প্যাকেটে ভরে দিলো। প্যাকেটটা পেয়েই দিল দৌঁড়। ভাংতি টাকা দেয়ার জন্য দোকানদার চিৎকার করতে লাগলো পেছন থেকে, " এই বাবু, তোমার টাকা নিয়ে যাও"
হঠাৎ মা আসে। দৌঁড়ে এসে ছিনিয়ে নেয় অভির হাতের কৌটোটা। ছেলে ম্যাজিক খাচ্ছে। ম্যাজিক টুথ পাউডার। মা তো হইহই করে বাসা মাথায় তোলে,
এই তো সুযোগ। আজ নিজে নিজে "ম্যাদিক" করবে অভি। নিজেই নিজের চোখটা ঢেকে প্যাকেটটা খুললো ছোট্ট অভি।ওমা এতো মায়ের দেয়া ম্যাদিক না! একটা কৌটায় সাদা সাদা কি যেন। কি আসে যায়। এটাও নিশ্চয়ই ম্যাদিক। মুখ ভর্তি করে খাওয়া শুরু করে অভি। " ওরে কে কোথায় আছিস, কে দিল এই দাঁত মাজা গুড়া আমার বাবাকে!" কতবার যে কুলি করিয়েছিল মা তা গুনতির বাইরে।
আজ আবার ম্যাজিকের খুব প্রয়োজন অভির। এসএসসির রেজাল্ট আজ।গণিতের পরীক্ষায় একমাত্র ম্যাজিক ছাড়া পাশ করা সম্ভব কি? আনসার করেছে মোটে ৩৮। মাকে যেয়ে বললো,
দোকানদার ছোট্ট অভির মুখে "ম্যাদিক" শুনে ম্যাজিক টুথ পাউডার ধরিয়ে দিয়েছিল!!! ওই শেষ।আর কখনো নিজে নিজে "ম্যাদিক" করার সাহস করতো না অভি। ওটা মায়েরই থাক। অভির বয়স বেড়ে ১০। এখন নিজ হাতেই খায় সে। ম্যাজিক শব্দের অর্থ জানে। চকলেটও চেনে। এখন আর ম্যাজিক দেখাতে হয় না মা কে। তবে ম্যাজিক শব্দটা মনে ধরে থাকে। "আম্মু, একটু ম্যাজিক করে দাও না। অঙ্কে মনে হয় পাশ হবে না"
আম্মু ম্যাজিক করেছে। আমার বিশ্বাস,অবশ্যই করেছে। নাহ্ আফসানাকে পায় নি অভি। ওকে বেমালুম ভুলে গেছে সে। কোন অনুভূতিই আর নেই হঠাৎ করে। এ ম্যাজিক ছাড়া কি?তবে, এর পেছনে আরেকটা অবচেতন কারণও থাকতে পারে। ক্লাসের সবচেয়ে বড় মাস্তান শহীদ আফসানার পেছনে লেগেছে। অভি হয়তো সাহসেই কুলাতে পারে নি...
- ধুর পাগল। ম্যাজিক না। প্রানভরে দোয়া করেছি। তুই পাশ করবিই। দোয়া, ম্যাজিক,মা। অভি এসএসসি পাশ। আনন্দে যে কাঁদা যায়, আজকের আগে কি অভি জানতো? তবে, সবসময় ম্যাজিক হয় না। এই যে কলেজের সবচেয়ে সুন্দরী আফসানাকে যে ভালোবাসে, কোনো ম্যাজিকের বলে সে কি পারবে তা জানাতে? এর জন্য লাগবে সাহস। এ কথা সে মা কে বলতে পারছে না তাই। তা না হলে আম্মুই ম্যাজিক করে দিতো।
ইস্। যদি বাবা বদল করা যেত, তাহলে তৃষাকে বলতো, বদলে ফেলো প্লিজ। ওসব বাস্তবে হয় না। বাস্তবে আনোয়ার সাহেবের অজানা ম্যাজিকে প্রিন্সিপ্যালের রুমে ডাক পড়ে অভির।দুটি লাল টেপ প্যাঁচানো বেত ভাঙ্গে অভির পিঠে।
তবে ক্ষতি তেমন একটা হয় নি। তৃষাকে পেয়েছে অভি।এখন ম্যাজিক যা করার তৃষাই করে। চোখ বন্ধ করতে বলে প্রতিদিন হাতে একটি চিঠি দিয়ে যায়। এই তো আবার ফিরে এসেছে শৈশবের "ম্যাদিক"। সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। এমন সময়ে জীবনে আছড়ে পড়লো "ব্ল্যাক" ম্যাজিকের ভয়াল থাবা। তৃষার বাবা। আনোয়ার। ব্ল্যাকেস্ট আনোয়ার। এর চেয়ে কালো আর মোটা মানুষ জীবনে দেখেনি সে।তাই ওনার ম্যাজিককে ব্ল্যাক ম্যাজিক না বলে উপায় আছে?
সব ঠিকঠাক চলে না। তৃষার ডেলিভারি ডেট আজ। একদম ভালো নেই তৃষা। ডাক্তার এসে বলে গেলো, তৃষার জীবনের শঙ্কা আছে। আজ ম্যাজিক চাই অভির।মায়ের কাছে বললো, " আম্মা, ম্যাজিক করে দাও প্লিজ। তৃষাকে ফিরে চাই আম্মা"
এমনিতে এই বেদম মারের পর তৃষাকে ভুলে যাওয়ার কথা ছিল। আম্মা নিশ্চয়ই ম্যাজিক করেছে। ভালোবাসা বেড়েছে। আশঙ্কাজনক হারে।লাভ কিন্তু হয়েছে আরও একটা। পড়াশোনার মনযোগ বেড়েছে।ফল?ইন্টারে ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে অভি। আর তৃষা এস্টার। বিয়ের আগে পরে আর ম্যাজিক হয় নি। প্রাইভেট ফার্মে চাকরিটা পেয়ে ব্ল্যাকেস্ট আনোয়ারের মেয়েকেই বিয়ে করে অভি। সবকিছু ঠিকঠাক চললে লেখকের লেখার কিছু থাকে কি? আম্মা কিছু বলছে না কেন আজ? অভি কাঁদতে কাঁদতে চোখ বন্ধ করে আম্মার দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়।মা কাঁদছে। অভির হাতের ওপর একফোঁটা অশ্রু এসে পরে। তৃষা নেই।
চার বছরের ছোট্ট জাদু চোখ বন্ধ করে হাতটা বাড়িয়ে বললো, " বাবা, এত্তা ম্যাদিক দেখাও"একটা চকলেট খুঁজছে অভি।শৈশবের ম্যাজিক হারাতে দেবে না সে।কক্ষনো না।
মা ম্যাজিক করেছে আজও। তৃষা আর অভির শেষ চিহ্ন টা প্রাণ পেয়েছে। এই দেবশিশুটা ম্যাজিক ছাড়া কি? জীবনের সব হারিয়ে সব ফিরে পেল অভি। অভি তার ছেলেটার নাম রেখেছে জাদু। এর চেয়ে ভালো নাম কি আর হতে পারতো ওর? এখন আর অভির জীবনে ম্যাজিক নেই। মা গত হয়েছেন ঠিক ঠিক এক বছর। জীবনের শেষবেলায় মা হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, " বাবা, একটা ম্যাজিক কর। আমার দাদুভাই যে একা হয়ে যাবে। " অভি পারেনি। হাতটা শক্ত করে ধরে শুধু বলেছিলো, " মা, তুমি যেও না" ম্যাজিক হয় নি। আর হবেও না কখনো। ম্যাজিকের চিন্তা বাক্সটাকে বেধে টেধে একেবারে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে অভি। আজ তিন বছর হলো।
আজ জাদুর জন্মদিন। অভি বললো, বাবা, তোমার কি চাই এই জন্মদিনে?

মনদীপ ঘরাই, বাংলাদেশ

১৯শে নভেম্বর ২০১৮ইং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.