এলাহাবাদ ইউনিভার্সিটি ভারতের চতুর্থ প্রাচীনতম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়,যাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ডও বলা হয়ে থাকে ,দেখার বড় পিপাসা ছিল,এবার সুযোগ হল দেখার।আপ্লুত হওয়ার মত এর গড়ন শৈলী দেখে।গ্রীক শৈলীতে নির্মিত এই বিদ্যাভবনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু,বিখ্যাত অভিনেতা বিগ বি অমিতাভ বচ্চনের মত আরো অনেক ব্যক্তিত্ব পড়াশুনা করে গেছেন জানতে পারলাম।তারপর গেলাম আনন্দ ভবনে,জওহরলাল নেহেরুর পৈতৃক বাসভবন,যা এখন জাতীয় সংগ্রহশালায় পরিণত করা হয়েছে,ঘুরে ঘুরে দেখলাম,ভারতের রাজনীতিতে তাদের কর্মকান্ডের বিবরণগুলো দলিল হিসাবে সুরক্ষিত করা সংগ্রহশালার দেয়ালের গায়ে।
পড়তে পড়তে অনুভব করেছিলাম সেই মূহুর্তে রাজ্য রাজনীতির পট পরিবর্তনের ইতিহাস।ফেরার পথে ভরদ্বাজ মুণির আশ্রম দর্শণে গেলাম।খুব একটা সুখকর মনে হয়নি।বাতাবরণ এমনটাই যেন সাজানো মন্দিরে ঈশ্বর নেই।আছে মানুষরূপী অর্থ কামানোর দল।ধর্মের প্রতি অনীহা বোধহয় এমন মানুষেরাই সৃষ্টি করে।ধর্মের ব্যাখ্যার চাইতে রুটি রুজির ধান্দা বেশি।আবহ অনুকূলে নয় ভেবে আর দেরী করি নি।অটো নিয়ে সোজা পৌঁছে গেলাম আমাদের সেবাধামে।সেখানে সন্ধ্যায় সবার সান্নিধ্যে সৎ সঙ্গের পর কর্তাবাবুকে নিয়ে গঙ্গার পাড়ে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সেবাধামের নির্ধারিত ডেরায় আশ্রয় নিলাম রাত্রি যাপনের জন্য।
গা এলিয়ে দিলেও ঘুম আসার জো নেই।চোখের উপর বাল্ব জ্বলছে অষ্টপ্রহর।এর মাঝে মেলা প্রাঙ্গনের চেঁচামেচি শুনতে না চাইলেও কানে আসবে।রাত আর দিনের মাঝে কোন ব্যবধান বুঝার কোন উপায় থাকত না যদি না কুয়াশা আর ধোঁয়ার আবরণ না থাকত।বাইরের লাইটগুলো ঝাপসা ধোঁয়া আর কুয়াশার দাপাদাপিতে।আধো ঘুমে আধো জাগরণেই কাটাতে হল কয়েক ঘন্টা।তারপর উঠে মুখ হাত ধুয়ে চা টিফিন নিয়ে রওনা হলাম ত্রিবেণীর দিকে।উদ্দেশ্য সঙ্গমে স্নান সেরে তারপর ঘুরে ফিরে মেলা স্হান দেখা।
তাবু ছেড়ে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম দুজনে মেলাপ্রাঙ্গনের দিকে।মনে হয়েছিল কেবল আমরা নই,যে কোন জনকেই থমকে থামতে হবে একটু সময়।সমুদ্রের মত বিশাল ব্যপ্তি।কম জলে থাকা মাছগুলোকে বেশি জলে ফেললে যেমন অবস্হা হয়,আমাদেরও তেমন অবস্হা।যেদিকে চোখ যায় শুধু তাবু আর তাবু।এ মানুষের তৈরী না স্বয়ং ঈশ্বরসৃষ্ট ঠাহর করতে পারছিলাম না।কোথায় শুরু কোথায় শেষ! এমন ধরার বুকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল --"ধরার খুশি ধরে না গো,ওই যে উথলে,মরি হায় ,হায়,হায়----"।কবিগুরুর গানের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলাম।মনে হলো ,এত আনন্দধ্বনির মাঝে আমি আমার কর্তাবাবু দাঁড়িয়ে।কিন্তু কারো মুখে রা নেই।কেবল চোখে চোখে তাকিয়েছিলাম।
চারদিকে উচ্চৈঃস্বরে বৈদিক স্তোত্র পাঠ চলছে ।মহলটাই যেন অন্যরকম।জীবনে বহুবিধ মেলা দেখেছি।কিন্তু এ মেলার সাথে অন্য কোন মেলার তুলনা দেওয়া বৃথা।
আমরা কোনদিক দিয়ে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না।তিথি অনুযায়ী সবাই আমাদেরই মত প্রথম শাহী স্নানে এসছেন বলে সবার অবস্হা আমাদের মতই।বুঝলাম জিজ্ঞেস করে করেই এগুতে হবে।বিশালতার ভীড়ে পথঘাট হারিয়ে ফেলি কিনা এই ভয়ে বেঞ্চমার্ক হিসাবে আমাদের সেবাধামের পাশেই একটা শিবমন্দির "শিবালয়"কে টার্গেট করে নিলাম।এবার জিজ্ঞেস করে করে এগুচ্ছি।যত এগুচ্ছি তত বিস্ময়।ঘোর লাগছে সব।মাইলের পর মাইল লোহার পাত পাতানো অস্হায়ী রাস্তা তৈরী হয়েছে বালির উপর।ছয় লেনের রাস্তা হবে।ঠিকানা নির্ধারণের জন্য পুরো এড়িয়াকে জোনে ভাগ করা হয়েছে।জোনগুলোকে সেক্টরে।আর সেক্টরগুলোকে বিভিন্ন মার্গে নামকরণ করা হয়েছে।এত কিছুর পরেও এই ভুলভুলাইয়ার ভিতর আপনাকে একটু সময়ের জন্য হলেও হারাতে হবেই।খুঁজে পেতে ঠিকানা ভোলানাথকে ও স্মরণ করতেই হবে।মেলার মজা নাকি এতেই।হারাতে হারাতেই অনেক মণি, মুক্ত,জহুরত পাওয়া যায়।সব ঢেলে দেওয়া আছে প্রকরণ,কেবল খুঁজে নেওয়া।
ভাবতে আশ্চর্য লাগছিল ,মেলা প্রাঙ্গনে এত লোকের ভীড় কিন্তু কারো গায়ে আঁচটি লাগছে না।হুড়োহুড়ি নেই।মনে হচ্ছিল সবাই কদিনের জন্য নিজেকে হারাতেই উন্মত্ত।এ এক অদ্ভুত খেল।রাস্তার পাশেই যে যার মত কাপড় বিছিয়ে শোয়া বসার জায়গা করে নিচ্ছে।সাধু সন্তরা দলে দলে মেলা প্রাঙ্গনে ঢুকছে। সবার মুখেই এক নাম "হর হর মহাদেব"।আসল সাধু ,নকল সাধু চেনার জো নেই এই ভবের সংসারে।কেউ বা শ্বেতবসনে কেউ বা গেরুয়া বসনে,কেউ বা বসনহীন,উলঙ্গ।হাতে ত্রিশূল,গলায় রুদ্রাক্ষের মালা,মাথা জটাধারী।
মেলার ভেতরে দাবারের কোন ভাবনা করতে হয় না কোমড়ে জোর থাকা চাই,হাঁটতে হবে প্রচুর।তবেই দেখার পিপাসা মিটবে।রাস্তার দুপাশ জুড়ে আশ্রম আখড়াগুলোতে চা টিফিন দানে বসেছেন আশ্রম নিবাসী ভক্তরা।লাইনে দাঁড়িয়ে পথ চলতি তীর্থ যাত্রীরা।
পুরো রাস্তা জুড়ে অজস্র জলের পাইপ লাইন টেপসহ বসানো,সাড়ি সাড়ি লেট্রিন,বাথরুম বসানো।মোভেবল ব্যাঙ্ক,এ টি এম,ট্রান্সমিশন,অস্হায়ী হাসপাতাল,প্রতি দুই সেক্টরের জন্য একটি করে পুলিশ চৌকি।কি নেই এর ভেতর।সাথে স্বেচ্ছাসেবক/সেবিকার দল।মেলা প্রাঙ্গনে সাফাই কর্মীরা ব্যস্ত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে সঙ্গম স্হলে যাওয়ার দু নম্বর গেইট দিয়ে এগিয়ে গেলাম ।পৌঁছে গঙ্গার ঘাট থেকে নৌকা নিয়ে চলে গেলাম ত্রিবেণী সঙ্গমে।ভাবনা এক ঘটনা আরেক।ভেবে গেছি স্নান সেরে চলে আসবো।পৌঁছে দেখি পরিবেশ অন্যরকম।পূজারী বসে আছেন আরেক নৌকোয়।আমাদের হ্যান্ডওভার করে দেওয়া হলো পূজারীজীর কাছে।একই ফল ,ফুল ও অর্থে একই মায়ের পূজা হচ্ছে।অনেকটা গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজোর মত।বিশ্বাসে কৃষ্ণ মিলে,তর্কে বহুদূর।গঙ্গা মায়ের প্রতি বিশ্বাস রেখে পূজা হয়ে গেছে এমন উপাচারে আমরাও মায়ের পূজো দিয়ে জলে ডুব দিলাম।জগতের মঙ্গল কামনায়।স্নান সেরে আবার নৌকায় গঙ্গার ঘাটে।ফিরে এসে দেখি যে কাপড়ে স্নান সেরেছিলাম সেই কাপড়টা আর ফিরে আসে নি।দান ভেবে আর মায়া জাগে নি মনে।
ফেরার পথে দানে চা চলছে দেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম।চা নিয়ে এগুতেই দেখি প্রসাদ বিলি চলছে।সারা ভারত থেকে লাখো লাখো আশ্রম,আখড়া বসেছে এই পূণ্যভূমিতে।ছোট ছোট তাবু গেড়ে বসেছে লাখো লাখো সাধু সন্ত।কেউ বা সরব,কেউ নীরব।সবাই দান দক্ষিণাতে ব্যস্ত।কেউ দাতা কেউ গ্রহীতা।চক্রাকারে চলছে।কথিত আছে,কুম্ভমেলায় যা কিছু বিলি সবটাই দান হিসাবে ঈশ্বর গ্রহণ করেণ।সবটাই জীবের সেবার জন্য।যা কিছু দান সবটাই দাতার কাছে ফিরে আসে আশীর্বাদ স্বরূপ।এই বিশ্বাসে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রয়াগে দান দক্ষিণা করতে আসেন।নীরবে প্রত্যক্ষ করলাম সব বিষয়।বর্ণণাময় হয় না সব।কিছু বিষয় অনুভবের।অন্তরাত্মার সাথে যখন অনুভব মিলে যায় তখন তা আর ভাষায় ফোটে না।দেখলাম সবাই পেট পুড়ে প্রসাদ খাচ্ছে।আমরাও সবার সাথী হলাম।
সময় যাচ্ছে।থামলে চলবে না।বিচিত্র এ ভূমির কোথায় কি লুকিয়ে আছে কে জানে--আবার হাঁটা।মাঝে মাঝে পথের পাশে বসে বিশ্রাম নেওয়া আর তীর্থযাত্রীদের সাথে যেচে কথা বলা।চেনা জানার এক মোক্ষম ক্ষেত্র।দেশী বিদেশী লোকের সমাগম।এমন ক্ষেত্র ছেড়ে আসতে মন চায় না।
শেষটা কোথায় ?
হাঁটতে হাঁটতে দিনের শেষে এসে দেখি ষোল কি. মি হাঁটা হয়ে গেছে।এবার ধামে পৌঁছে শীতবস্ত্র নিয়ে আবার -------
(ক্রমশঃ)
রীণা দাশ, শিক্ষিকা
ত্রিপুরা
২৪শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং