সন্ধ্যায় শীতবস্ত্র গায়ে জড়িয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম মেলা প্রাঙ্গনের দিকে।দেখার শেষ নেই,নেই জানারও।আগ্রহ ছিল নাগা সন্ন্যাসীদের নিয়ে।গল্পকথায় শোনা,কিন্তু স্বচক্ষে দেখব এই ভাবনাটাই শিহরিত করছিল আমাদের।কৌতূহলবশতঃ টার্গেট ছিল সন্ধ্যায় নাগা সন্ন্যাসীদের ডেরায় যাওয়া।লোকমুখে অনেক কিছুই শোনা,বাস্তবে পরখ করে নেওয়ার মাঝে আনন্দ আছে।দেখলাম সত্যিই তাই।নাগা সন্ন্যাসীদের আখড়ার সামনে ভীড়ের মৌরসিপাট্টা।শোনা কথাকে পাত্তা না দিয়ে ঢুকে গেলাম আখড়াতে।আশ্চর্য্য হবার মত সব কথা।কথা বলে অনেক তথ্য জানতে পারলাম,যা কিনা এতদিন লোকমুখে ভয়ঙ্কর রূপে চর্চিত ছিল।নিজের কানে না শুনলে হয়ত অশ্রাব্যই থাকত।উনাদের মুখেই শুনলাম লাখো লাখো নাগা সন্ন্যাসী প্রতি কুম্ভে আসেন স্নান করতে।সামাজিক প্রথায় এনারাও নাকি আবদ্ধ এনাদের সমাজে।কথায় কথায় জানতে পারলাম এঁঁরা বছরের অন্য সময়ে গেঁরুয়া পরেই থাকেন।শাহি স্নানের জৌলুসে এসে ছাই ভস্ম মেখে নাগা হয়ে যান।মহিলা সন্ন্যাসিনীও আছেন তবে মহিলারা বস্ত্রহীন থাকেন না।
পদবিভাজন আছে আখড়ার পরিবেশেও।শুনলাম প্রত্যেকটা আখড়ার ইষ্ট দেবতাও নাকি আলাদা আলাদা।সে যাই হোক সবার মুখে দেবাদিদেব মহাদেবের নামই উচ্চারিত হচ্ছে 'হর হর মহাদেব' নামে।এবার আশ্চর্যের বাঁধ ভাঙার পালা।শ্রী অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের মোহান্ত মহারাজের আখড়ায় প্রবেশ করতেই নাগা সন্ন্যাসীর আতিথেয়তা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।আমন্ত্রণ জানালেন জম্মুর কাটরা আশ্রমে যাওয়ার জন্য।ওখান থেকে বৈষ্ঞুদেবীর মন্দির দর্শণ করিয়ে দেবেন বললেন।ফোন নম্বরও ধরিয়ে দিলেন। আখড়া ছেড়ে বের হয়ে এসে ভাবলাম নিজে এই পরিক্রমা না করলে জানতাম না অনেক কিছুই।
পদবিভাজন আছে আখড়ার পরিবেশেও।শুনলাম প্রত্যেকটা আখড়ার ইষ্ট দেবতাও নাকি আলাদা আলাদা।সে যাই হোক সবার মুখে দেবাদিদেব মহাদেবের নামই উচ্চারিত হচ্ছে 'হর হর মহাদেব' নামে।এবার আশ্চর্যের বাঁধ ভাঙার পালা।শ্রী অমরনাথ শ্রাইন বোর্ডের মোহান্ত মহারাজের আখড়ায় প্রবেশ করতেই নাগা সন্ন্যাসীর আতিথেয়তা মুগ্ধ হয়ে গেলাম।আমন্ত্রণ জানালেন জম্মুর কাটরা আশ্রমে যাওয়ার জন্য।ওখান থেকে বৈষ্ঞুদেবীর মন্দির দর্শণ করিয়ে দেবেন বললেন।ফোন নম্বরও ধরিয়ে দিলেন। আখড়া ছেড়ে বের হয়ে এসে ভাবলাম নিজে এই পরিক্রমা না করলে জানতাম না অনেক কিছুই।
রাত নটা।ফিরে আসলাম আমাদের জন্য নির্দ্দিষ্ট সেবাধামে। রাতের খাবারের ঘন্টা বাজলো।সাধু মহারাজজীরা সেবায় নেমে গেলেন।নিজের হাতে পরিবেশন করছেন সবাইকে।অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।খাবারের শেষে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেন।এরপর নিজ নিজ স্হানে এসে গা এলিয়ে দিলাম।কর্তাবাবু মোবাইল চেক করে বললেন আজ পনের কি মি হাঁটা পথে যা কিছু দেখেছ সব মগজে ষ্টোর করেছি কিনা।বলে খুশির হাসি হাসলেন।তৃপ্ত হলাম হাসিমাখা মুখ দেখে।বহুদিনের বাসনার ফসল যে এই হাসি।
পরের দিন পূন্যপ্রভাতে মকর সংক্রান্তির শাহি স্নান।তাপমাত্রা আট ডিগ্রী সেলসিয়াস।রওনা হলাম সঙ্গম ঘাটের উদ্দেশ্যে।ঘড়িতে চারটা।পৌঁছে দেখি সঙ্গম ঘাটের রাস্তা ততক্ষণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।সাধু সন্ন্যাসীরা এর আগেই সাজ সাজ রবে ঘাটে পৌঁছে গেছেন।খবর নিয়ে জানা গেল সর্বসাধারণের জন্য অন্য দিকে গেইট খুলে দেওয়া হয়েছে।আবার শুরু হল হাঁটা।ছয় কিমি হেঁটে সঙ্গম ঘাটে পৌঁছালাম।চলতি পথের এ আরেক দৃশ্য।চতুর্দিক থেকে লক্ষ লক্ষ লোক পিঁপড়ের মত ঢুকছে স্নানের ঘাটে।মাইকে অনবরত হারানো ব্যক্তির ঘোষণা চলছে।ভয়ে কর্তাবাবুর হাত পাকড়ে ধরলাম।এমন জনসমুদ্রে হারানোর ভয় থাকেই।যদিও নিঃশ্চিদ্র নিরাপত্তা এবং সাহায্যের হাত বাড়ানো ছিল সবারই।
আমরা ছয়জন একসাথে গেছিলাম ঘাটে।আমাদের রুম পার্টনার আগরতলা জয়নগর নিবাসী রায় মহাশয় ,উনার ছেলে ,ভাতিজা এবং এল আই সিতে কর্মরত আরেক ভদ্রলোক ছিলেন।পাড়ে দাঁড়িয়ে দুজন আর বাকীরা স্নানে গেলেন।এরই মাঝে একজন হারিয়ে গেলেন।এবার আরো ভয় ।তবে শেখার উপকরণ ছড়ানো চারদিকে।শিক্ষা পেলাম।হারানো সাথি ফিরে এলেন।এবার বেঞ্চ মার্ক দিয়ে আমরা স্নানের উদ্দেশ্যে জগতের মঙ্গল কামনায় ত্রিবেণীতে ডুব দিলাম।ঘাটের পাড়ের দৃশ্য একটু ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করছে সবার সাথে।অভূতপূর্ণ দৃশ্য।ঘাঁট ঘেঁসে দাঁড়ানো হাজার হাজার পুরুষ ও মহিলা স্বেচ্ছাসেবির দল হাতে ঝুপড়ি নিয়ে।লাখো লাখো ভক্তবৃন্দের ছোরা ফল ফুল এক নিমেষে তুলে নিয়ে গঙ্গাকে ঝাঁ চকচক করে রাখছে ।স্বচ্ছতার এক অপরূপ নিদর্শণ স্বচক্ষে দেখে এলাম।ইচ্ছে থাকলেই আমরা এ পৃথিবীকে আবর্জনামুক্ত রাখতে পারি নিজেদের প্রয়োজনে। স্নানে যাওয়ার আগে আতঙ্ক ছিল ভিজে কাপড় ছাড়ার বিষয়ে।দেখলাম এরও কোন ত্রুটি নেই।পাড় ধরে কাপড় ছাড়ার সুবন্দোবস্ত।সঙ্গমস্হলে বসানো হয়েছে দেশ বিদেশ থেকে আগত বড় বড় ক্যামেরা সহ মিডিয়ার লোকদের।বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ বিশ্ব ধর্মমহামিলনকে প্রত্যক্ষ করবেন এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে।আমরা দুজন এর দোরগোড়ায় একটু সময় হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম।
স্নান পর্ব শেষ করে ফেরার পথে অগুনিত মানুষের ভীড়ে হারিয়ে গেলাম।সারা ভারতের সাধু সন্তরা সাজোয়া বাহনে ঢাক ঢোল পিটিয়ে স্নান সেরে ফিরছেন।মুখে সবার হর হর মহাদেব নিনাদ।আকাশ বাতাস সেই নিনাদে প্লাবিত হচ্ছে।ফৌজি বেষ্টিত সন্ত।জীবনে ভাবিনি কখনো এমন দৃশ্য চোখের সামনে ।জানতে পারলাম অখিল ভারতীয় সন্ত কমিটির সন্ত এঁরা।ভাবলাম।কি ভাবলাম--বলতে পারব না।অনেক ভাবনা ব্যক্ত করা যায় না।কেবল চিন্তনে ছাপ রেখে যায়।কেউ বা বস্ত্রে আবৃত,কেউ বা এর উর্দ্ধে।অর্থ একেকজনের কাছে একেক রকম।সংসার ত্যাগীরা সংসারে ফিরে আসলে সংসারী আত্মারা ত্যাগী আত্মাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন মাত্র,দেখেন না।দৃষ্টিপাতে ঐহিক জগত যতটা দৃষ্টিতে আসে পরমার্থ জগত ততটাই দূরত্বে অবস্হান করে।যাই হোক সৃষ্টি যার যার দৃষ্টিতে,এই ভেবে সামনের দিকে এগুলাম।
মকর সংক্রান্তির স্নান সেরে ফেরার পথে মনে হলো এই দিনে পিঠে পুলি খাওয়ার কথা।যেমন ভাবা তেমন কাজ।শুনেছিলাম কায়মনো বাক্যে ডাকলে ঈশ্বর তা শুনেন।ফল পেলাম হাতে হাতে।সাধু সন্তরা প্রসাদ দান করছেন ভক্তদের মাঝে।আশ্চর্য্য হয়েছিলাম সেই প্রসাদ পিঠেতে সাজানো ছিল।ভুলার নয় এ দৃশ্য।সবাই যে যার মত করে দানে ব্যস্ত।কেউ বা কাপড়,কেউ ফল,কেউ অর্থ,কেউ অন্ন,চাল ডাল দিচ্ছেন ভক্তজনদের।চলতে চলতে সন্ধ্যা নেমে এল।আমাদের হাঁটা থেমে নেই।
সন্ধ্যের পর মেলা প্রাঙ্গনের আকাশ পুরো আবছায়া চাদরে ঢাকা পরে যায়।লক্ষ লক্ষ কুন্ডুর ধোঁয়া আর কুয়াশা চোখে জ্বালা ধরিয়ে দেয়।রাত্রি যত গভীর হয় হাজার হাজার বাতিগুলো চোখ বুজতে শুরু করে ।পথঘাট ঠাহর করার উপায় থাকে না।তখন ভুলভুলাইয়ার চক্করে পড়ার চান্স থাকে বেশি।আমরাও পড়লাম এই ফ্যাসাদে।শেষে নিরাপত্তা কর্মীদের সহায়তায় মাথা পিছু দশ টাকার রাস্তা দেড়শ টাকা দিয়ে ,আরেকটা শিক্ষা নিয়ে তাবুতে পৌঁছলাম।
তাবুর সাথী কোলকাতার মূখার্জী পরিবার ও সাহা পরিবারের সাথে সারাদিনের কাহিনী ভাগ করে শুতে যাব এমন সময়ে পাশের রুম থেকে কূটকাঁচালি এসে ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিল।এনারা ধর্মকর্ম সেরে রাতে সংসারের আবর্জনার স্তুপ খুলে বসেছিলেন।ভাবছিলাম আমরা সংসারী মানুষ।আমরা গাছেরও খেতে চাই,তলারও কুড়াতে চাই।শেষে পাই না কিছুই।"চোরে না শুনে ধর্মের কাহিনী"--এই আপ্তবাক্যটি মাথায় চক্কর কাটতে লাগল।এত দূর বয়ে আসা কেন ? --প্রশ্ন ঘুরে।ভাবতে ভাবতে কখন ঘুম আসল বলতে পারিনি।
সকাল হতেই আবার দৌড় ।সময় ফুরিয়ে আসছে,দেখার অনেক বাকী।
এবার গন্তব্য বৈদিক গ্রাম ও টেন্ট সিটি।পত্র পত্রিকায় পড়ে বড় সাধ ছিল এগুলো চাক্ষুষ করার।ইচ্ছেরা মরে না কখনো।রওনা হলাম দুজনে।খোঁজ নিয়ে নিয়ে চলা।সাহায্যের হাত চারদিকে প্রসারিত।কেবল জানার ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে হবে। গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্হলের ওইপাড়ে তৈরী করা হয়েছে বৈদিক গ্রাম আর টেন্ট সিটি।সেক্টর আঠারো থেকে কুড়ি।আঠারোতে বৈদিক গ্রাম আর কুড়িতে টেন্ট সিটি।।আমরা যমুনা নদীর উপর তৈরী অস্হায়ী সেতু ধরে চলে এলাম এপারে।একশ বিরানব্বইটি পিপা দিয়ে তৈরী একেকটা সেতু।অকল্পনীয় সব ব্যবস্হাপনা।এমন সেতুর সংখ্যা কয়েক শ।
এবার গন্তব্য বৈদিক গ্রাম ও টেন্ট সিটি।পত্র পত্রিকায় পড়ে বড় সাধ ছিল এগুলো চাক্ষুষ করার।ইচ্ছেরা মরে না কখনো।রওনা হলাম দুজনে।খোঁজ নিয়ে নিয়ে চলা।সাহায্যের হাত চারদিকে প্রসারিত।কেবল জানার ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে হবে। গঙ্গাযমুনার সঙ্গমস্হলের ওইপাড়ে তৈরী করা হয়েছে বৈদিক গ্রাম আর টেন্ট সিটি।সেক্টর আঠারো থেকে কুড়ি।আঠারোতে বৈদিক গ্রাম আর কুড়িতে টেন্ট সিটি।।আমরা যমুনা নদীর উপর তৈরী অস্হায়ী সেতু ধরে চলে এলাম এপারে।একশ বিরানব্বইটি পিপা দিয়ে তৈরী একেকটা সেতু।অকল্পনীয় সব ব্যবস্হাপনা।এমন সেতুর সংখ্যা কয়েক শ।
কয়েক কি মি হেঁটে পৌঁছে গেলাম বৈদিক গ্রামে,যেখানে প্রজেক্ট করা আছে প্রাচীন যুগ থেকে এখন পর্যন্ত সব ধরণের সনাতন ধর্ম শাস্ত্রের রূপরেখা।তৎকালীন সমাজের সামাজিক,রাজনৈতিক,অর্থনৈতিক,ধর্ মীয় অবস্হান সবই ফুটানো হয়েছে ওই গ্রামে।
পাশেই সংস্কৃৃৃত গ্রাম।ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করা হচ্ছে সুচারুরূপে। এরপর চলা লাখোয়ারি স্বপ্নের টেন্ট সিটির উদ্দেশ্যে।।নেই গাড়ি নেই ঘোড়া ।কেবল পায়ে হেঁটে চলা।উদ্দেশ্য থাকা নয় দেখা।দেখে এলাম চক্ষু জুড়িয়ে।জেনে এলাম বিশদভাবে।মেলা থেকে পাওনা ওইটুকুই।মনে রাখার মত আমৃত্যু এমন অভিজ্ঞতা,যা সঞ্চয় করে রাখতে চাই মনের প্রকোষ্টে।
পাশেই সংস্কৃৃৃত গ্রাম।ভারতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে লালন করা হচ্ছে সুচারুরূপে। এরপর চলা লাখোয়ারি স্বপ্নের টেন্ট সিটির উদ্দেশ্যে।।নেই গাড়ি নেই ঘোড়া ।কেবল পায়ে হেঁটে চলা।উদ্দেশ্য থাকা নয় দেখা।দেখে এলাম চক্ষু জুড়িয়ে।জেনে এলাম বিশদভাবে।মেলা থেকে পাওনা ওইটুকুই।মনে রাখার মত আমৃত্যু এমন অভিজ্ঞতা,যা সঞ্চয় করে রাখতে চাই মনের প্রকোষ্টে।
ফিরব স্বদেশে পরের দিন।তাই এবার ধামে ফিরে গোছগাছ করা।
রীণা দাশ, ত্রিপুরা
২৭শে মার্চ ২০১৯ইং
Darun likhle
উত্তরমুছুন