পারুল যখন বাসায় ফিরল ঘড়ির কাঁটায় ঠিক তখন রাত ন'টা বাজে। তার ছোট্ট রুমের বাতি জ্বলেনি এখনো। অন্ধকার ঘরে পা টিপে টিপে হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ করে একটি পাতিলে লাথি মারল পারুল নীরব রুমটা হঠাৎ যেন চিৎকার করে উঠল। সেই সাথে বুড়িটাও-
-দিলি তো মাগী আমার ঘুমাখানা নষ্ট করি। সারারাত ঘুামইতে পারিনা। এখন যা একটু ঘুমাই ছিলাম, তুই মাঘীর সহ্য অইলনা।
মাঘী শব্দটা পারুলের কানে যেন বাজ হয়ে বাজল। তবুও সেকোন প্রত্যুত্তর দিলনা। নীরবে হেঁটে গিয়ে রুমের বাতি জ্বালায় সে। ততক্ষণে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। পারুলের পায়ের আঘাতে ডালের পাতিলের পুরোটাই মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ আলো জ্বলায় ঝাপসা চোখে বুড়ি প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি, কিন্তু যখন ভালোমতো দেখতে পেল তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠার বিপরীতে আশ্চর্য রকম ঠাণ্ডা হয়ে গেল সে। আর চোখে পানি এসে গেল তার বললো- 'ঘরেতো খানি আাধাকাড় ডাইল আছিল তাই রানছি। এখন কি দিবি মাঘী?' পারুলের শ্যাম বর্ণের মুখটি কালো রং ধারণ করলো কোন কথা না বলে একটি ন্যাকড়া নিয়ে ভেজা ঘরটি মুছতে লাগল সে। এখন কোন কথা বললেই ঝগড়া হবে। কেননা ডালের পাতিল ঠিকমতো রাখলে এই অঘটনটি ঘটত না আর।
মাজেদা বুড়ির সাথে পারুল আছে প্রায় তিন বছর হল। এই ঘরেই তাদের দুজনার বসবাস। বুড়ির কথাবার্তার ধরন খারাপ হলেও মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। সে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছুটা কাজ করে। তবে এ কাজ করতে তার মন এখন আর সায় দেয় না। শুধুমাত্র পেটে কিছু দানা-পানি দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই পরম যুদ্ধ করে যায় সে। পৃথিবীর লাখো দুঃখী মানুষদের মধ্যে সেও একজন । স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। আর ছেলেমেয়েরা কেউই তার খবর রাখেনি। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ কাজে নেমেছে সে। পারুল বুড়িকে দাদী বলে ডাকে।
ঘর মুছা শেষ করেই পারুল যাবে গোছল করতে। সারাদিন গার্মেন্টসের সেলাই এর শব্দ, ঘাম আর ধুলাবালি তার গায়ে এক অদৃশ্য আবরণ পরিয়ে দেয়। পারুল গার্মেন্টসে চাকরি করে তার বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে। তার বাবা ময়মনসিংহে থাকে পরিবার পরিজন সহ। নয় সদস্যের পরিবরে পারুলের আয়ই তার বাবাকে কিছুটা অবলম্বন দেয়। তবে গত চারমাস হলো সে বাবাকে কোন টাকা পয়সা দেয়নি। পারুল এস.এস.সি পাস করেও গার্মেন্টস ছাড়া অন্য কোথায় কোন চাকরি পায়নি। তাই সে কিছু টাকা জমিয়ে গার্মেন্টসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কোন ব্যবসা শুরু করবে।
ছপছপ শব্দ হচ্ছে গোছলখানায় পারুল একটি মগ দিয়ে বালতি সেচে পানি ঢালছে তার অর্ধ নগ্ন শরীরে। ওদের গোছলখানার উপরের অংশের টিন অনেকটা সরে গেছে। সবার নজরে পড়লেও আমলে নেয়না কেউ। উপরতলার বাবুরা ইচ্ছে করলেই উকি মেরে দেখে নিতে পারে একবারে তাদের শরীর। ওরা গরীব বলেই হয়তো তাদের সম্ভ্রমের মূল্য দেয়না ওরা অতটা।
গোছল করার সময় একটা উৎকট ডিম ভাজার গন্ধ এসে ক্ষুধাটা বাড়িয়ে দেয় ওর। মনে করিয়ে দেয় সে আজ দুপুরেও খায়নি। এখন খেতে হবে। কিন্তু এখন কি খাবে সে?
উদরপূর্তি দেয়ার জন্য সিদ্ধ ভাত ছাড়ে। ঘরে আরতো কিছুই নেই।
পারুল যখন গোছল শেষে একটা গামছা দিয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করল তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক যেন বর্ষার মেঘে ঢাকা আকাশ ভেদ করে সদ্য উঠা একচিলতে রোদ। তাকে অনেক সুন্দর লাগছে এখন। গদিও সে এমনিতেও সুন্দর। শ্যামবর্ণের চেহারায় মায়াবী ভাবটা তার চোখে মুখে সবসময় লেগে থাকে।
বুড়ি প্লেটে ভাত আর ডিম নিয়ে বসে আছে পারুলের জন্য। পারুল তাড়াতাড়ি এসে খেতে বসে। বলে-'দাদী, তুমি খুব ভালো মানুষ।'
-হ, ভালোতো ক্যাবিই, মুখে তুইলা দিবার পারলে উত্তর ঘরের নানীও ভালা।
পারুল হাস তে;তার মনের মানুষটার কথা মনে পড়ে যায় তার। ভাবে মানুষটা এখনো খেয়েছে কিনা কে জানে? পারুলকে আবার বাস্তবে ফিরায় মাজেদা বুড়ি। বলে-
-আইডা তোর দাদীর খোয়াব দেখছিলাম বইন, দেখলাম মানুষটা আমার কাছে আইল, আমারে কইল, বউ তিরাশ পাইছে, আমারে এক গ্লাস পানি দিবি?
-তারপার দাদী?
-আমি যেইনা মানুষটার জন্য পানি আনতে গেলাম তুই আইসা আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিলি।
-আমার ভুল হইয়া গেছে দাদী। আমারে মাফ কইরা দাও।
বুড়ি কান্না জুড়ি দিল। ডিম মাখা ভাত নাড়তে নাড়তে সে বলে-
-আমি বান্ধবী, মানুষটারে আটকাইয়া রাখতে পারি নাই। মানুষটা আমার উপর অভিমান কইরা চলে গেল। ঢুকরে কেঁদে উঠে মাজেদা বুড়ি।
রাত যখন প্রায় একটা বাজে, তখনও পারুল দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা। সে বারবার বিছানার এপাশ ওপাশ হয়। বুড়িও এখনো ঘুমায় নি বুঝতে পারে পারুল। কেননা বুড়ি ঘুমালে যে নাক ডাকার শব্দ করে তা ঘুমের চরম ব্যাঘাত ঘটায়। বিগত প্রায় একমাস যাবত পারুল ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা। হঠাৎ কোন ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে। সবসময়ই একটা ভয় পারুলকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই সময় ঘনিয়ে আসছে। ওদের হাতে সময় খুবই কম। যা কিছু করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। নইলে যে কোনো মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এই সমস্ত চিন্তায় সারাদিন মগ্ন থাকে ও। চিন্তা করতে করতে ইদানীং ওর কাজে অনেক ভুল হয়ে যায়। পরে আবার বকা শুনতে হয়। পারুলে অবচেতন মনে হঠাৎ চেতনা ফিরে মাজেদা বুড়ির আচমকা একটি প্রশ্নে- নূরুলের খবর কি রে বইন?
-দাদী, তোমারে কতদিন কইছিনা ওনারে নূরা কইবানা। ওনার একটা সুন্দর নাম আছে কাজী নুরুল আলম।
-এত রাতে মরদের নাম নিয়া আমার লগে ঝগড়া করবিনা। দেখনা তোর নূরা পাখি আবার ফুড়ুৎ কইরা উড়াল দেয়।
পারুল থমকে যায়। এই ভয়টাই তার মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই সময় নুরু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তা হলে কি হবে তার। নুরু তার মনের মানুষ। তার উপর পারুলের শতভাগ আস্থা আছে। তবুও ভয় হয় তার, অনেক ঝড়-ঝণ্ডা, বাঁধা অতিক্রম করে তারা আজ এই পর্যন্ত এসেছে। নূরুর সাথে পারুলের পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। ময়মনসিংহের একই গ্রামে বাস তাদের। নূরুর বাবা কাজী সূরুয পেশায় পানের ব্যবসা করলেও বংশের জোড়ে গাজী বাড়ী কাউকে মূল্যায়ন করেনা। পারুলরা গাজী বাড়ির লোক। তার বাবার নাম শহীদ গাজী। এই দুই পরিবারের লোকদের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। কখনো কখনো তুচ্ছ কোন কারনেই দুই পরিবারের লোকদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়।
তবে নূরু তার বাপের মত হয়নি কথাবার্তা শালীন, আচার আচরণ ভালো। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। অনেক লম্বা সে। পারুল নূরকে বলে-তুমি আমার বাংলা সিনেমার সাকিব খান।
নুরু বলে , "তুমি আমার শাবনূর।"
নূরু সাভারে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। তার পোষ্ট ভাল। সুপার ভাইজার। তাই তার ব্যস্ততা পারুলের চেয়ে একটু বেশি। পরের দিন অনেক দেরি করে বিছানা ছাড়ল পারুল কেনান আজ শুক্রবার। সপ্তাহের এই একটি মাত্র দিন ছুটি তার নুরুকে কাছে পাওয়ার এই একটি মাত্র দিন এই দিনটির প্রতীক্ষায় সপ্তাহের বাকি ছয়টি দিন তার কাছে মনে হয় ছয় যুগ। কিন্তু বুড়ির জন্য একটু কষ্ট হয় পারুলের। সপ্তাহের এই দিনটিতেও তার ছুটি নেই। বরং আজ তার কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি।
যাওয়ার আগে বুড়ি পারুলের জন্য সাদা ভাত আর আলুভর্তা তৈরি করে রেখেছে। এতেই মহাখুশি পারুল। কিন্তু সে এটাও ভাবে যে তার আরো ভালো কিছু খাওয়ার দরকার ছিল।
আজ বিকেলে নূরুর সাথে দেখা করবে পারুল। আজই একটা বিহিত করতে হবে। নতুবা অনেক সমস্যা হয়ে যেতে পারে।
পারুল চন্দ্রিমা উদ্যানের চিরচেনা গাছটির নীচে বসে নূরুর জন্য অপেক্ষায় আছে। সে আজ তার একমাত্র শাড়িটি পড়েছে। নীল রংয়ের পাতলা শাড়ি সে হাতে চুড়িও পড়েছে, গত পহেলা বৈশাখে নূরু তাকে কিনে দিয়েছিলো। কয়েকটি চুড়ি ভেঙ্গেও গেছে। সেগুলোও পারুল যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মুখে পাউডার মেখে মুখটাকে অনেকটা সাদা করে ফেলেছে পারুল। সাথে কপালে একটি লাল টিপও পড়েছে। আসার আগে ভাঙ্গা আয়নায় নিজেকে দেখে এসেছে একবার। ভালোই লেগেছিলো তাকে।
নুরুল আসল কিছুক্ষণ পর। এসে পাশে বসে পারুলের। পারুল কিছুটা আবেগহীন হয়ে বলে -এতো দেরী হইল ক্যান? আমি কখন থেইক্যা অপেক্ষায় আছি।
-রাস্তায় জ্যাম ছিল। আবেগহীন উত্তর দেয় নূরুও। পারুলের পাতলা কাপড় ভেদ করে তাকে ভালভাবে দেখে থমকে যায় নূরু। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে করে সে। পারুল যে এত সেজে আসলে সেদিকে খেয়াল নেই নূরুর।
আইজ কিন্তু একটা সমাধানে তোমার পৌছাইতে হইবো।
-হুঁ
-সময় কিন্তু ঘনাইয়া আসতেছে। আমার কিন্তু ভাল্লাগেনা এখন আর।
শুকনা একটা গাছের ডাল দিয়ে মাটি খোঁচাতে খোঁচাতে নূরু সায় দেয়-'হুঁ।'
নূরুর এমন হতাশাজনক আচরণে স্বপ্ন ভগ্ন হয় পারুলের। তবুও সে বলে-'আমি কিন্তু গলায় ফাঁস দিমু কইলাম। আমার আর কোন উপায় নাই।'
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে নূরু। তারপর বলে-'-আগামী শুক্রবার তোমারে ঘরে নিমু্। রেডি থাইকো।'
হুট করে এ ধরনের উত্তর আশা করেনি পারুল। তাই প্রথমে অবাক হলেও ক্ষণিক পরেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। মনের আনন্দে সে জড়িয়ে ধরে নূরুকে। যখন একে অপরকে জড়িয়ে আছে ওরা। পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা যেন আজ ভিড় করেছে তাদের দুজনার মাঝে।
মঙ্গলবার গার্মেন্টস থেকে ছুটি পেয়ে গেল পারুল। তবে সপ্তাহের গত তিনটি দিন মোটেও অবসর ছিলনা সে। নূরুর কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ভাবনা চিন্তায় কেবল নূরু আর নূরু। পারুল নূরুর জন্য একটা পাঞ্জাবী, বুড়ির জন্য একটি শাড়ি এবং নিজের জন্য কিছু প্রসাধন সামগ্রী কিনল। তবে পারুলকে সবচেয়ে বেশী অবাক করে মাজেদা বুড়ি। সে পারুলের জন্য দুই হাজার দিয়ে একটি লাল শাড়ি কিনে আনে। পারুল বলে,
-দাদী, ক্যান তুমি আমার জন্য এতটাকা দিয়া শাড়ি কিনলা?
-আমার তো এখন তুই ছাড়া আর কোন আওলাদ নাইরে বইন। আমি টাকা জমাইয়া রাখুম কার জন্য?
পারুল ছুটি পেলেও নূরু ছুটি পাবে বৃহস্পতিবার। তবে মাজেদা বুড়ি ছুটি পেয়েছে। নাতনীর বিয়েতে আনন্দ করবে সে। একদিন হল পারুল বুড়িকে নিয়ে ভাবছে। নূরুর সাথে বিয়ের পর সে নূরুর সাথে এক বাসায় উঠবে। তখন বুড়ির কাছে কে থাকবে? কে খোঁজ খবর নিবে তার।
দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার চলে এল। কাল বিয়ে। পারুল আর দাদী কারো চোখেই ঘুম নেই। বিশেষ করে বুড়ি অনেক ব্যস্ত। কাল তার নাতনী জামাই আসবে তাদের ছোট ঘরটিতে এখন অনেক ভিড়। পাশের ঘর থেকে ছোট বড় অনেকেই এসেছে। এসেছে পারুলের গার্মেন্টসের কিছু বান্ধবীও। তারা কেউ পারুলকে মেহেদি পড়াচ্ছে আবার কেউ দিচ্ছে হলুদ। পারুলের মনে অনেক আনন্দ। শুধু একটাই অপূর্ণতা। আজ এমন সুখের দিনে বাপ-মার আশীর্বাদ তার সঙ্গী হলনা। বাসার সব মানুষকে মিষ্টি বিতরণ করছে বুড়ি। এতসব আয়োজন তারই করা।
পারুল এই কয়দিনে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় ঘরে একা বসে আছে সে। মাঝে মাঝে অন্য বাড়ী থেকে দুই একটা বাচ্চা সঙ্গী হয় তার। সন্ধ্যার পর থেকে বুড়ির খবর নেই। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে সে। সাভার থেকে কেউ একজন এসে খবরটা দিয়ে গেল। তাই শুনে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে বুড়ি। কিন্তু যখন বুড়ি আসল সত্যটি জানতে পারল এখন তার পা আর চলছেনা। কিভাবে এর মর্মান্তিক খবরটি পারুলকে বলবে সে। বুড়ি জানে পারুল নূরুকে জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসে। হয়তোবা সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার ক্ষমতা আর ভাষা কিছুই নেই তার। কিন্তু নূরুর প্রতি তার যে ভালবাসা তা অন্ধ ভালবাসা। তা কখনো ফুরাইবার নয়।
বুড়ি যখন ঘরে ফিরল তখন রাত প্রায় এগারোটা, ঘরে ফিরে সে পাথরের মত দাড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলেনা। অথচ পারুল উদগ্রীব হয়ে আছে দাদীর এতো দেরী করে ঘরে ফেরার কারণ কি তা জানার জন্য। সে বুড়িকে জিজ্ঞেস করে।
-কি হইছে দাদী? কথা কওনা কা?
বুড়ি কথ বলে না। সে একবার ভাবে কুছপরোয়া না করে সব জানিয়ে দেবে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। এখন আর গোপন করে কী লাভ? আবার ভাবে কোন অজানা পরিস্থিতি না জানি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
পারুল আবারো বলে-'ও দাদী? কি হইছে তোমার কথা কও।'
এইবারও কোন কথা বলেনা বুড়ি। কোন অঘটন ঘটেছে বুঝে এইবার কেঁদে ফেলল পারুল। অজানা ভয়ে থমকে যায় সে। বুড়ি মুখ খুলল তখন-'তোর নূরু আর নাইরে বইন।'
-'কি কইলেন দাদী? কি কইলেন?'
-'হ, নূরুদের গার্মেন্টসে আইজ আগুন ধরছিল। সতেরো জন মানুষ পুইড়া মরছে। তার লগে নূরু ও একজন।'
কথাগুলো বেশ সাবলীল ভাবে বলতে পারলেন মাজেদা বুড়ি। ততক্ষণে "না" বলে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো পারুল।
ঠিক দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল পারুলের। অথচ এক সপ্তাহ পরও পারুলের মুখে ভাষা ফোটেনি। কঠিন পাথর হয়ে গেছে সে। খাওয়া দাওয়া করেনা। নূরুর লাশ শেষবারের মত দেখতে পারেনি বলে কোন আফসোস নেই তার। সারাক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। অথচ কাউকে কিছু বলেনা। এখন নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে পারুল তার অনাগত সন্তান যে কিনা পাঁচ মাস ধরে পৃথিবীর আলো দেখার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে তাকে কি জবাব দেবে সে। পৃথিবী কি তাকে স্বাদরে করেনি। পারুল বুঝতে পারে নূরুর প্রতি তার এমন অন্ধ ভালোবাসা আজ তার গর্ভের সন্তানকে জারজ এবং নিজেকে নষ্টা হিসেবে পৃথিবীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিলো। অথচ পারুল মোটেও সেরকম মেয়ে ছিলনা। পারুলের সামনে এখন মাত্র দুটি পথই খোলা। একটি হলো নষ্ট মেয়ে পরিচয়ে পৃথিবীতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। অপরটি হলো অসহায় অথচ নিরপরাধ দুটি অথবা একটি জীবনের নির্মম আত্মহনন। এখন কোন পথের পথিক হবে তাই ভাবছে পারুল।
-দিলি তো মাগী আমার ঘুমাখানা নষ্ট করি। সারারাত ঘুামইতে পারিনা। এখন যা একটু ঘুমাই ছিলাম, তুই মাঘীর সহ্য অইলনা।
মাঘী শব্দটা পারুলের কানে যেন বাজ হয়ে বাজল। তবুও সেকোন প্রত্যুত্তর দিলনা। নীরবে হেঁটে গিয়ে রুমের বাতি জ্বালায় সে। ততক্ষণে যা ঘটার তা ঘটে গেছে। পারুলের পায়ের আঘাতে ডালের পাতিলের পুরোটাই মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হঠাৎ আলো জ্বলায় ঝাপসা চোখে বুড়ি প্রথমে ঠাওর করতে পারেনি, কিন্তু যখন ভালোমতো দেখতে পেল তখন তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠার বিপরীতে আশ্চর্য রকম ঠাণ্ডা হয়ে গেল সে। আর চোখে পানি এসে গেল তার বললো- 'ঘরেতো খানি আাধাকাড় ডাইল আছিল তাই রানছি। এখন কি দিবি মাঘী?' পারুলের শ্যাম বর্ণের মুখটি কালো রং ধারণ করলো কোন কথা না বলে একটি ন্যাকড়া নিয়ে ভেজা ঘরটি মুছতে লাগল সে। এখন কোন কথা বললেই ঝগড়া হবে। কেননা ডালের পাতিল ঠিকমতো রাখলে এই অঘটনটি ঘটত না আর।
মাজেদা বুড়ির সাথে পারুল আছে প্রায় তিন বছর হল। এই ঘরেই তাদের দুজনার বসবাস। বুড়ির কথাবার্তার ধরন খারাপ হলেও মানুষ হিসেবে মন্দ নয়। সে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে ছুটা কাজ করে। তবে এ কাজ করতে তার মন এখন আর সায় দেয় না। শুধুমাত্র পেটে কিছু দানা-পানি দিয়ে বেঁচে থাকার জন্য এই পরম যুদ্ধ করে যায় সে। পৃথিবীর লাখো দুঃখী মানুষদের মধ্যে সেও একজন । স্বামী মারা গেছে অনেক বছর আগে। আর ছেলেমেয়েরা কেউই তার খবর রাখেনি। তাই পেটের দায়ে বাধ্য হয়ে এ কাজে নেমেছে সে। পারুল বুড়িকে দাদী বলে ডাকে।
ঘর মুছা শেষ করেই পারুল যাবে গোছল করতে। সারাদিন গার্মেন্টসের সেলাই এর শব্দ, ঘাম আর ধুলাবালি তার গায়ে এক অদৃশ্য আবরণ পরিয়ে দেয়। পারুল গার্মেন্টসে চাকরি করে তার বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করতে। তার বাবা ময়মনসিংহে থাকে পরিবার পরিজন সহ। নয় সদস্যের পরিবরে পারুলের আয়ই তার বাবাকে কিছুটা অবলম্বন দেয়। তবে গত চারমাস হলো সে বাবাকে কোন টাকা পয়সা দেয়নি। পারুল এস.এস.সি পাস করেও গার্মেন্টস ছাড়া অন্য কোথায় কোন চাকরি পায়নি। তাই সে কিছু টাকা জমিয়ে গার্মেন্টসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কোন ব্যবসা শুরু করবে।
ছপছপ শব্দ হচ্ছে গোছলখানায় পারুল একটি মগ দিয়ে বালতি সেচে পানি ঢালছে তার অর্ধ নগ্ন শরীরে। ওদের গোছলখানার উপরের অংশের টিন অনেকটা সরে গেছে। সবার নজরে পড়লেও আমলে নেয়না কেউ। উপরতলার বাবুরা ইচ্ছে করলেই উকি মেরে দেখে নিতে পারে একবারে তাদের শরীর। ওরা গরীব বলেই হয়তো তাদের সম্ভ্রমের মূল্য দেয়না ওরা অতটা।
গোছল করার সময় একটা উৎকট ডিম ভাজার গন্ধ এসে ক্ষুধাটা বাড়িয়ে দেয় ওর। মনে করিয়ে দেয় সে আজ দুপুরেও খায়নি। এখন খেতে হবে। কিন্তু এখন কি খাবে সে?
উদরপূর্তি দেয়ার জন্য সিদ্ধ ভাত ছাড়ে। ঘরে আরতো কিছুই নেই।
পারুল যখন গোছল শেষে একটা গামছা দিয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করল তার মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল। ঠিক যেন বর্ষার মেঘে ঢাকা আকাশ ভেদ করে সদ্য উঠা একচিলতে রোদ। তাকে অনেক সুন্দর লাগছে এখন। গদিও সে এমনিতেও সুন্দর। শ্যামবর্ণের চেহারায় মায়াবী ভাবটা তার চোখে মুখে সবসময় লেগে থাকে।
বুড়ি প্লেটে ভাত আর ডিম নিয়ে বসে আছে পারুলের জন্য। পারুল তাড়াতাড়ি এসে খেতে বসে। বলে-'দাদী, তুমি খুব ভালো মানুষ।'
-হ, ভালোতো ক্যাবিই, মুখে তুইলা দিবার পারলে উত্তর ঘরের নানীও ভালা।
পারুল হাস তে;তার মনের মানুষটার কথা মনে পড়ে যায় তার। ভাবে মানুষটা এখনো খেয়েছে কিনা কে জানে? পারুলকে আবার বাস্তবে ফিরায় মাজেদা বুড়ি। বলে-
-আইডা তোর দাদীর খোয়াব দেখছিলাম বইন, দেখলাম মানুষটা আমার কাছে আইল, আমারে কইল, বউ তিরাশ পাইছে, আমারে এক গ্লাস পানি দিবি?
-তারপার দাদী?
-আমি যেইনা মানুষটার জন্য পানি আনতে গেলাম তুই আইসা আমার ঘুম ভাঙ্গাইয়া দিলি।
-আমার ভুল হইয়া গেছে দাদী। আমারে মাফ কইরা দাও।
বুড়ি কান্না জুড়ি দিল। ডিম মাখা ভাত নাড়তে নাড়তে সে বলে-
-আমি বান্ধবী, মানুষটারে আটকাইয়া রাখতে পারি নাই। মানুষটা আমার উপর অভিমান কইরা চলে গেল। ঢুকরে কেঁদে উঠে মাজেদা বুড়ি।
রাত যখন প্রায় একটা বাজে, তখনও পারুল দুচোখের পাতা এক করতে পারছেনা। সে বারবার বিছানার এপাশ ওপাশ হয়। বুড়িও এখনো ঘুমায় নি বুঝতে পারে পারুল। কেননা বুড়ি ঘুমালে যে নাক ডাকার শব্দ করে তা ঘুমের চরম ব্যাঘাত ঘটায়। বিগত প্রায় একমাস যাবত পারুল ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা। হঠাৎ কোন ভয়ানক স্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে জেগে উঠে সে। সবসময়ই একটা ভয় পারুলকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যতই দিন যাচ্ছে ততই সময় ঘনিয়ে আসছে। ওদের হাতে সময় খুবই কম। যা কিছু করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। নইলে যে কোনো মুহূর্তে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এই সমস্ত চিন্তায় সারাদিন মগ্ন থাকে ও। চিন্তা করতে করতে ইদানীং ওর কাজে অনেক ভুল হয়ে যায়। পরে আবার বকা শুনতে হয়। পারুলে অবচেতন মনে হঠাৎ চেতনা ফিরে মাজেদা বুড়ির আচমকা একটি প্রশ্নে- নূরুলের খবর কি রে বইন?
-দাদী, তোমারে কতদিন কইছিনা ওনারে নূরা কইবানা। ওনার একটা সুন্দর নাম আছে কাজী নুরুল আলম।
-এত রাতে মরদের নাম নিয়া আমার লগে ঝগড়া করবিনা। দেখনা তোর নূরা পাখি আবার ফুড়ুৎ কইরা উড়াল দেয়।
পারুল থমকে যায়। এই ভয়টাই তার মনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এই সময় নুরু যদি তাকে ছেড়ে চলে যায় তা হলে কি হবে তার। নুরু তার মনের মানুষ। তার উপর পারুলের শতভাগ আস্থা আছে। তবুও ভয় হয় তার, অনেক ঝড়-ঝণ্ডা, বাঁধা অতিক্রম করে তারা আজ এই পর্যন্ত এসেছে। নূরুর সাথে পারুলের পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। ময়মনসিংহের একই গ্রামে বাস তাদের। নূরুর বাবা কাজী সূরুয পেশায় পানের ব্যবসা করলেও বংশের জোড়ে গাজী বাড়ী কাউকে মূল্যায়ন করেনা। পারুলরা গাজী বাড়ির লোক। তার বাবার নাম শহীদ গাজী। এই দুই পরিবারের লোকদের মধ্যে অহি-নকুল সম্পর্ক। কখনো কখনো তুচ্ছ কোন কারনেই দুই পরিবারের লোকদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যায়।
তবে নূরু তার বাপের মত হয়নি কথাবার্তা শালীন, আচার আচরণ ভালো। দেখতে শুনতেও মন্দ নয়। অনেক লম্বা সে। পারুল নূরকে বলে-তুমি আমার বাংলা সিনেমার সাকিব খান।
নুরু বলে , "তুমি আমার শাবনূর।"
নূরু সাভারে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। তার পোষ্ট ভাল। সুপার ভাইজার। তাই তার ব্যস্ততা পারুলের চেয়ে একটু বেশি। পরের দিন অনেক দেরি করে বিছানা ছাড়ল পারুল কেনান আজ শুক্রবার। সপ্তাহের এই একটি মাত্র দিন ছুটি তার নুরুকে কাছে পাওয়ার এই একটি মাত্র দিন এই দিনটির প্রতীক্ষায় সপ্তাহের বাকি ছয়টি দিন তার কাছে মনে হয় ছয় যুগ। কিন্তু বুড়ির জন্য একটু কষ্ট হয় পারুলের। সপ্তাহের এই দিনটিতেও তার ছুটি নেই। বরং আজ তার কাজের চাপ সবচেয়ে বেশি।
যাওয়ার আগে বুড়ি পারুলের জন্য সাদা ভাত আর আলুভর্তা তৈরি করে রেখেছে। এতেই মহাখুশি পারুল। কিন্তু সে এটাও ভাবে যে তার আরো ভালো কিছু খাওয়ার দরকার ছিল।
আজ বিকেলে নূরুর সাথে দেখা করবে পারুল। আজই একটা বিহিত করতে হবে। নতুবা অনেক সমস্যা হয়ে যেতে পারে।
পারুল চন্দ্রিমা উদ্যানের চিরচেনা গাছটির নীচে বসে নূরুর জন্য অপেক্ষায় আছে। সে আজ তার একমাত্র শাড়িটি পড়েছে। নীল রংয়ের পাতলা শাড়ি সে হাতে চুড়িও পড়েছে, গত পহেলা বৈশাখে নূরু তাকে কিনে দিয়েছিলো। কয়েকটি চুড়ি ভেঙ্গেও গেছে। সেগুলোও পারুল যত্ন করে রেখে দিয়েছে। মুখে পাউডার মেখে মুখটাকে অনেকটা সাদা করে ফেলেছে পারুল। সাথে কপালে একটি লাল টিপও পড়েছে। আসার আগে ভাঙ্গা আয়নায় নিজেকে দেখে এসেছে একবার। ভালোই লেগেছিলো তাকে।
নুরুল আসল কিছুক্ষণ পর। এসে পাশে বসে পারুলের। পারুল কিছুটা আবেগহীন হয়ে বলে -এতো দেরী হইল ক্যান? আমি কখন থেইক্যা অপেক্ষায় আছি।
-রাস্তায় জ্যাম ছিল। আবেগহীন উত্তর দেয় নূরুও। পারুলের পাতলা কাপড় ভেদ করে তাকে ভালভাবে দেখে থমকে যায় নূরু। নিজেকে অনেক অপরাধী মনে করে সে। পারুল যে এত সেজে আসলে সেদিকে খেয়াল নেই নূরুর।
আইজ কিন্তু একটা সমাধানে তোমার পৌছাইতে হইবো।
-হুঁ
-সময় কিন্তু ঘনাইয়া আসতেছে। আমার কিন্তু ভাল্লাগেনা এখন আর।
শুকনা একটা গাছের ডাল দিয়ে মাটি খোঁচাতে খোঁচাতে নূরু সায় দেয়-'হুঁ।'
নূরুর এমন হতাশাজনক আচরণে স্বপ্ন ভগ্ন হয় পারুলের। তবুও সে বলে-'আমি কিন্তু গলায় ফাঁস দিমু কইলাম। আমার আর কোন উপায় নাই।'
খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে নূরু। তারপর বলে-'-আগামী শুক্রবার তোমারে ঘরে নিমু্। রেডি থাইকো।'
হুট করে এ ধরনের উত্তর আশা করেনি পারুল। তাই প্রথমে অবাক হলেও ক্ষণিক পরেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। মনের আনন্দে সে জড়িয়ে ধরে নূরুকে। যখন একে অপরকে জড়িয়ে আছে ওরা। পৃথিবীর সমস্ত ভালবাসা যেন আজ ভিড় করেছে তাদের দুজনার মাঝে।
মঙ্গলবার গার্মেন্টস থেকে ছুটি পেয়ে গেল পারুল। তবে সপ্তাহের গত তিনটি দিন মোটেও অবসর ছিলনা সে। নূরুর কাছে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার ভাবনা চিন্তায় কেবল নূরু আর নূরু। পারুল নূরুর জন্য একটা পাঞ্জাবী, বুড়ির জন্য একটি শাড়ি এবং নিজের জন্য কিছু প্রসাধন সামগ্রী কিনল। তবে পারুলকে সবচেয়ে বেশী অবাক করে মাজেদা বুড়ি। সে পারুলের জন্য দুই হাজার দিয়ে একটি লাল শাড়ি কিনে আনে। পারুল বলে,
-দাদী, ক্যান তুমি আমার জন্য এতটাকা দিয়া শাড়ি কিনলা?
-আমার তো এখন তুই ছাড়া আর কোন আওলাদ নাইরে বইন। আমি টাকা জমাইয়া রাখুম কার জন্য?
পারুল ছুটি পেলেও নূরু ছুটি পাবে বৃহস্পতিবার। তবে মাজেদা বুড়ি ছুটি পেয়েছে। নাতনীর বিয়েতে আনন্দ করবে সে। একদিন হল পারুল বুড়িকে নিয়ে ভাবছে। নূরুর সাথে বিয়ের পর সে নূরুর সাথে এক বাসায় উঠবে। তখন বুড়ির কাছে কে থাকবে? কে খোঁজ খবর নিবে তার।
দেখতে দেখতে বৃহস্পতিবার চলে এল। কাল বিয়ে। পারুল আর দাদী কারো চোখেই ঘুম নেই। বিশেষ করে বুড়ি অনেক ব্যস্ত। কাল তার নাতনী জামাই আসবে তাদের ছোট ঘরটিতে এখন অনেক ভিড়। পাশের ঘর থেকে ছোট বড় অনেকেই এসেছে। এসেছে পারুলের গার্মেন্টসের কিছু বান্ধবীও। তারা কেউ পারুলকে মেহেদি পড়াচ্ছে আবার কেউ দিচ্ছে হলুদ। পারুলের মনে অনেক আনন্দ। শুধু একটাই অপূর্ণতা। আজ এমন সুখের দিনে বাপ-মার আশীর্বাদ তার সঙ্গী হলনা। বাসার সব মানুষকে মিষ্টি বিতরণ করছে বুড়ি। এতসব আয়োজন তারই করা।
পারুল এই কয়দিনে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় ঘরে একা বসে আছে সে। মাঝে মাঝে অন্য বাড়ী থেকে দুই একটা বাচ্চা সঙ্গী হয় তার। সন্ধ্যার পর থেকে বুড়ির খবর নেই। এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে সে। সাভার থেকে কেউ একজন এসে খবরটা দিয়ে গেল। তাই শুনে ঘটনার সত্যতা যাচাই করার জন্য ছুটে বেড়াচ্ছে বুড়ি। কিন্তু যখন বুড়ি আসল সত্যটি জানতে পারল এখন তার পা আর চলছেনা। কিভাবে এর মর্মান্তিক খবরটি পারুলকে বলবে সে। বুড়ি জানে পারুল নূরুকে জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসে। হয়তোবা সেই ভালোবাসা প্রকাশ করার ক্ষমতা আর ভাষা কিছুই নেই তার। কিন্তু নূরুর প্রতি তার যে ভালবাসা তা অন্ধ ভালবাসা। তা কখনো ফুরাইবার নয়।
বুড়ি যখন ঘরে ফিরল তখন রাত প্রায় এগারোটা, ঘরে ফিরে সে পাথরের মত দাড়িয়ে থাকে। কোন কথা বলেনা। অথচ পারুল উদগ্রীব হয়ে আছে দাদীর এতো দেরী করে ঘরে ফেরার কারণ কি তা জানার জন্য। সে বুড়িকে জিজ্ঞেস করে।
-কি হইছে দাদী? কথা কওনা কা?
বুড়ি কথ বলে না। সে একবার ভাবে কুছপরোয়া না করে সব জানিয়ে দেবে। যা হবার তাতো হয়েই গেছে। এখন আর গোপন করে কী লাভ? আবার ভাবে কোন অজানা পরিস্থিতি না জানি তার জন্য অপেক্ষা করছে।
পারুল আবারো বলে-'ও দাদী? কি হইছে তোমার কথা কও।'
এইবারও কোন কথা বলেনা বুড়ি। কোন অঘটন ঘটেছে বুঝে এইবার কেঁদে ফেলল পারুল। অজানা ভয়ে থমকে যায় সে। বুড়ি মুখ খুলল তখন-'তোর নূরু আর নাইরে বইন।'
-'কি কইলেন দাদী? কি কইলেন?'
-'হ, নূরুদের গার্মেন্টসে আইজ আগুন ধরছিল। সতেরো জন মানুষ পুইড়া মরছে। তার লগে নূরু ও একজন।'
কথাগুলো বেশ সাবলীল ভাবে বলতে পারলেন মাজেদা বুড়ি। ততক্ষণে "না" বলে চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো পারুল।
ঠিক দুই দিন পর জ্ঞান ফিরল পারুলের। অথচ এক সপ্তাহ পরও পারুলের মুখে ভাষা ফোটেনি। কঠিন পাথর হয়ে গেছে সে। খাওয়া দাওয়া করেনা। নূরুর লাশ শেষবারের মত দেখতে পারেনি বলে কোন আফসোস নেই তার। সারাক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন সে। অথচ কাউকে কিছু বলেনা। এখন নিজেকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে পারুল তার অনাগত সন্তান যে কিনা পাঁচ মাস ধরে পৃথিবীর আলো দেখার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছে তাকে কি জবাব দেবে সে। পৃথিবী কি তাকে স্বাদরে করেনি। পারুল বুঝতে পারে নূরুর প্রতি তার এমন অন্ধ ভালোবাসা আজ তার গর্ভের সন্তানকে জারজ এবং নিজেকে নষ্টা হিসেবে পৃথিবীর কাছে পরিচয় করিয়ে দিলো। অথচ পারুল মোটেও সেরকম মেয়ে ছিলনা। পারুলের সামনে এখন মাত্র দুটি পথই খোলা। একটি হলো নষ্ট মেয়ে পরিচয়ে পৃথিবীতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা। অপরটি হলো অসহায় অথচ নিরপরাধ দুটি অথবা একটি জীবনের নির্মম আত্মহনন। এখন কোন পথের পথিক হবে তাই ভাবছে পারুল।
মো.শামছুল আরেফিন, বাংলাদেশ
ছবিঋণঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
ছবিঋণঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
১৩ই জুলাই ২০১৯