আবু আলী, ঢাকা ॥
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির ২২ বছর পূর্তি কাল। দুই দশকের বেশি সময় পর শতভাগ সফলতা না এলেও ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে রক্তাক্ত অধ্যায়ের সফল অবসান ঘটিয়ে সূচিত উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের ধারা অব্যাহত আছে। তবে পুরোপুরি শান্তি ফিরেনি পাহাড়ে। অশান্ত এই পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য শান্তিচুক্তির কিছু ধারা সংশোধনের দাবি রয়েছে বাঙালিদের। অপরদিকের পাহাড়িরাও চান শান্তিচুক্তি পুরোপুরি বাস্তবায়নে সরকারের আন্তরিকতা। সরাকরি সূত্র বলছে, শান্তিচুক্তির মোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৫টির আংশিক বাস্তায়ন হয়েছে এবং নয়টি ধারা বাস্তবায়ন চলমান রয়েছে।
১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তৎকালীন চিফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি শীর্ষ নেতৃবৃন্দের পক্ষে সন্তু লারমা। উল্লেখ্য, কোন প্রকার তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই এবং কোন বিদেশি শক্তিকে যুক্ত না করেই এ শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছিল যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে তৎকালীন সশস্ত্র গ্রুপ শান্তিবাহিনীর দীর্ঘ প্রায় দুই দশকের সংগ্রামের।
শান্তি চুক্তির শর্তানুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে ভারত থেকে প্রত্যাগত ১২,২২৩ টি পরিবারের মোট ৬৪,৬১২ জন শরণার্থীকে পুনর্বাসন করেছে। চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি সম্পুরণরূপে এবং বাকী ধারাগুলির ১৫ টি ধারা আংশিক বাস্তবায়নসহ কিছু ধারার বাস্তবায়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের বিভিন্ন বিভাগ/বিষয়ের মোটামুটি সব বিভাগ/ বিষয় তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এসব বিভাগে লোকবল নিয়োগে চুক্তির শর্তানুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিসত্তার সদস্যদের প্রাধান্য দেওয়ায় স্থানীয়ভাবে তাদের বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত একটি ব্রিগেড এবং প্রায় অনধিক আড়াইশ অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প গুটিয়ে ফেলা হয়েছে।
শান্তি চুক্তির পর পাহাড়ে উন্নয়ন প্রবল্ভাবে গতি পেয়েছে। সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ করে ইতিমধ্যে পাহাড়ের সব উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যন্ত পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৮ কিমি রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নির্মাণ করেছে প্রায় ১৫৩৫ কিমি রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। এ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারী, আধাসরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, কলকারখানাসহ সম্পন্ন হয়েছে অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম। পার্বত্য চট্টগ্রামে মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ১৯৭০ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামে মাত্র ছয়টি উচ্চবিদ্যালয়/কলেজ ছিল যার বর্তমান সংখ্যা ৪৭৯ টি। প্রাথমিক বিদ্যালয় এখন প্রায় প্রতিটি পাড়ায়। এ ছাড়াও ৫টি স্টেডিয়াম, ২৫টি হাসপাতাল এবং বর্তমানে ১৩৮২টি বিভিন্ন কটেজ ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শিক্ষার হার ১৯৭০ সালে মাত্র ২% শতাংশ ছিল যা বেড়ে এখন ৪৪.৬% হয়েছে। নীলগিরি ও সাজেকের মতো উন্নত পর্যটন কেন্দ্রে গড়ে ওঠায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন আরও অনেক আকর্ষণীয় ও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৫টি নয়নাভিরাম পর্যটন স্পট রয়েছে। সেগুলো সঠিকভাবে বিকাশ করতে পারলে প্রতিবছর ১০-১৫ হাজার কোটি টাকা উপার্জন করা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হলে চাঁদাবাজি/সন্ত্রাসী কার্যকলাপ অনেকাংশে কমে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হলেও গত ৬ বছরে পাহাড়ে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপের অর্ন্তকোন্দলের কারণে খুন হয়েছেন ৩২১ জন। পার্বত্য এলাকার আঞ্চলিক দলগুলোর আধিপত্যের কারণে মূলধারার রাজনীতিবিদরাও রয়েছেন হুমকির মধ্যে। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অনেক পদধারী নেতাও আঞ্চলিক এসব সংগঠনের হাতে খুন হয়েছেন। তাদের হুমকিতে বিভিন্ন সময়ে ৩৫৫ আওয়ামী লীগ নেতা বিভিন্ন সময় দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চার আঞ্চলিক দলের চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার এবং অভন্তরীণ কোন্দলে গত ৬ বছরে পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২০৭ জন এবং ১১৪ জন বাঙালি খুন হয়েছেন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ ও ২০১৫ সালে। ২০১৮ সালে ৬৮ জন এবং ২০১৫ সালে ৬৯ জন খুন হন। ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত খুন হয়েছেন ৫৬ জন। এছাড়া ২০১৪ সালে ৫৪ জন, ২০১৬ সালে ৪১ জন এবং ২০১৭ সালে ৩৩ জন খুন হয়েছেন।
ছবিঋণঃ সৌজন্যে সারা বাংলা ডট নেট
২রা ডিসেম্বর ২০১৯