Type Here to Get Search Results !

করোনা-যুদ্ধে মানুষই তো জয়ী হবে, নাকি ! --- ড. কাজল রশীদ শাহীন,বাংলাদেশ

পৃথিবী করোনার মতো দুর্যোগ দেখেনি কখনো। অস্ত্রবাজ পৃথিবীর দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকলেও করোনার মতো দুর্যোগের অভিজ্ঞতা নেই। তবে এ অভিজ্ঞতায় পৃথিবীকে আবারও পড়তে হবে কিংবা করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সঙ্গে লড়তে হবে, যদি তা না পৃথিবী করোনা দুর্যোগের অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগায়। করোনার এই আঘাত পৃথিবীর জন্য বড় একটা বার্তা, এই বার্তাকে পৃথিবী যদি আমলে নেয়, তা হলে ভালোই। আর যদি আমলে না নেয় তা হলে পৃথিবীর সমূহ ধ্বংস হয়তো হয়ে উঠবে অনিবার্য। করোনা-যুদ্ধে মানুষই তো জয়ী হবে, নাকি? এই প্রশ্নের নৈর্ব্যক্তিক উত্তর দেওয়া দুরূহ। কারণ এই উত্তরের সঙ্গে যদি, তবে, কিন্তু জড়িত আছে। এই লেখায় আমরা ইতিহাস, সভ্যতার অভিঘাত ও মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক কতিপয় বৈশিষ্ট্যের আলোকে দেখার চেষ্টা করব করোনা-যুদ্ধে কে জয়ী হবে, কার জয়ী হওয়া উচিত আর জয়ী না হলে কী হবে? ০১. চীনে করোনার উৎপত্তি হলেও তা আর চীনের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই। এখন পর্যন্ত ১৯৭টা দেশে করোনা তার আঘাত হেনেছে। চীনের আক্রান্ত সংখ্যা, মৃত্যুর হার সবকিছু ছাড়িয়ে যাচ্ছে। চীনের পর ইতালি, স্পেন এবং এখন আমেরিকা হচ্ছে করোনার আঘাতে সবচেয়ে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত। চীনে যখন করোনা তার তা-ব চালাচ্ছিল, তখন এই ভাইরাসটি যে সারাবিশ্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে এবং দাঁড়াচ্ছে তা কিন্তু উচ্চারিত হয়েছে বারবার। কিন্তু দুঃখজনক হলো, কেউ আমলে নেয়নি। কোনো রাষ্ট্রই এই ভাইরাস রোধে কী করা যেতে পারে, কী করণীয় হতে পারে তা নিয়ে মোটেই বিচলিত যেমন হয়নি, এটাকে মোকাবিলা করার জন্য সামান্যতম পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। ০২. এমনকি চীন থেকে করোনা যখন ইউরোপে তার ঘাঁটি গেড়েছে তখনো ট্রাম্প প্রশাসন এটাকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেয়নি। এখন সেই আমেরিকা করোনার আঘাতে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত, বিশেষ করে আমেরিকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহর নিউইয়র্কের অবস্থা একেবারেই করুণ। যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর কোথায় কী হবে আর কী হবে না তাই নিয়ে মাথা ঘামায় সর্বক্ষণ। এমনকি পৃথিবী নামের গ্রহের বাইরেও কোথায় কী হচ্ছে, আর কী হচ্ছে না তা জানতে সর্বদা বজ্র আঁটুনির পর্যবেক্ষণে ব্যতিব্যস্ত। তারা পর্যন্ত করোনা সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতার পরিচয় দিতে পারেনি। ইতালি, স্পেনের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়নি। করোনা যদি বাস্তবিকই তাদের দেশে আঘাত করে তা হলে তারা কী করবে, তার কোনো রোডম্যাপ ছিল না তাদের কাছে, এখনো যে আছে তাও খুব একটা জোর দিয়ে বলা যায় না। পিপিইর সংকটে রয়েছে তারা এবং আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, তারা এখন পিপিইর জন্য দ্বারস্থ হয়েছে বাংলাদেশের কাছেও। অর্থাৎ করোনা-পরবর্তী আমেরিকাকে নতুন করে ভাবতে হবে তারা যদি বিশ্বের মোড়লিপনা বজায় রাখতে চায়, তা হলে সেখানেও আনতে হবে আমূল পরিবর্তন। পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে পৃথিবীর মোড়লিপনার দিন বোধ করি শেষ করে দিল করোনা ভাইরাস। ০৩. প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বস্তুত পৃথিবীর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ ঘটালেও শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির যে পৃথিবী তাতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটায়। নব-নব ইজম, নব-নব আন্দোলন মনন ও সৃজনবিশ্বকে পাল্টিয়ে দেয় অনেকখানি। এ কারণে ক্ষেত্র বিশেষে এমনও বলা হয়, যুদ্ধ শুধু অনিবার্য বিনাশ ঘটায় না, নতুন বিন্যাসকেও আমন্ত্রণ জানায়। তবে যুদ্ধ কখনই কাম্য নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ও পূর্ববর্তী পৃথিবীর দিকে যদি আমরা একটু গভীরভাবে লক্ষ করি তা হলে কী দেখা যায়? জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থার জন্ম হয়েছে এ রকম একটা বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলার ওপর। জাতিসংঘ কতটা কার্যকর আর কতটা কার্যকর নয় সেই বিতর্ক পৃথক ও স্বতন্ত্র। ঔপনিবেশিক পৃথিবী যে পাততাড়ি গোটাল, ব্রিটিশ যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এক প্রকার আপসের ভেতরেই স্বাধীনতা দিয়ে সটকে পড়ল তা তো ওই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই। তাই যুদ্ধও কখনো কখনো মঙ্গলের বারতা ডেকে আনে, কিছু অভিজ্ঞতা তো সেটাই বলে, নাকি?

০৪.প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা তো পরোক্ষ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা কি নেই? বেশিদূরে যাওয়ার দরকার নেই। সম্রাট অশোকের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। কলিঙ্গ যুদ্ধেও অভিজ্ঞতা পুরোটাই পাল্টে দেয় সম্রাটকে। কলিঙ্গ যুদ্ধের হানাহানি, রক্তপাত, ধ্বংসলীলা আর মানবতার বিপর্যয় দেখে এক সময় তিনি উপলব্ধি করেন, যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। তার ভেতরে জেগে ওঠে মানবিকতার জয়গান। তিনি উপলব্ধি করেন, খুনোখুনি নয়, হিংসা নয়, বিদ্বেষ নয়, শুধু ভালোবাসা দিয়ে মানুষের বিবেককে জাগ্রত করতে হয়। আর ক্ষমা করে জয় করতে হয় শত্রুর মন। আর হিংসায় হিংসা বাড়ায়, রক্ত, রক্তপাত ডেকে আনে। এই উপলব্ধি পাল্টে দেয় অশোককে। বাকি জীবন তিনি হয়ে যান অন্য এক মানুষ। মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সূতিকাগার তো মহামতি অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতা। ০৫. করোনা ভাইরাসের দুর্যোগ সবেমাত্র শুরু হয়েছে, এর প্রভাব থাকবে বেশকিছু দিন। যে কোনো দুর্যোগ, মহামারীর বাস্তবতা হলো, এটা যখন থেমে যায় কিংবা কমে আসে তখন শুরু হয় গভীরতর সংকট। মহামারী ডেকে নিয়ে আসে মন্বন্তর, দেখা দেয় দীর্ঘমেয়াদি দুর্ভিক্ষ। উন্নত বিশ্ব এই সংকট নিজেদের সামর্থ্যে কাটিয়ে উঠলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সম্পদের অপ্রতুলতা ও ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে এই সংকট কাটিয়ে উঠতে হিমশিম খায়। এবং এই হিমশিম খাওয়া অবস্থাকে আড়াল করতে তারা নানা টালবাহানার আশ্রয় নেয়, আমলাতন্ত্র নিজেদের ব্যর্থতা ও অযোগ্যতাকে আড়াল করতে পুরো পরিস্থিতিকে গোয়েবলসের থিওরির আলোকে মোকাবিলা করতে চান। আর এসবের মধ্য দিয়ে মানুষের ভাগ্যে ঘটে ভয়ঙ্কর ট্র্যাজেডি। এসব থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব তা ভেবে দেখার এখনই সময়। ০৬. বিজ্ঞান নানামুখী আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে পৃথিবীকে যেমন হাতের মুঠোয় বন্দি করেছে, তেমনি অজানাকে করেছে জ্ঞেয়। কিন্তু এসবই যে মামুলি তা বোধ করি করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। প্রতিবছর বিস্ময়কর সব আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন অনেকেই। অথচ জনস্বাস্থ্যের বিষয়টা কতখানি উপেক্ষিত তা বোধ করি অজানাই থেকে যেত করোনার প্রাদুর্ভাব না দেখা দিলে। স্বাস্থ্যই সম্পদ কথাটা একাডেমিকভাবেই শুধু বিশ্বাস করা হয়, নাকি? পৃথিবীর দেশে দেশে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির অপ্রতুলতা এত বেশি? চন্দ্রজয়ী আমেরিকার পিপিই পর্যন্ত নেই, ভেন্টিলেটর নেই। এগুলো একটু বেশি থাকলে কী এমন ক্ষতি? ০৭. খেয়ালিপনার দিন শেষ। করোনা ভাইরাস বলছে, পৃথিবীকে আরও সতর্ক হতে হবে। পৃথিবীকে সবার বাসযোগ্য করে তুলতে হবে। লেখার শুরুতে বলেছিলাম, বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকলেও পৃথিবীর এ রকম দুর্যোগ দেখার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কারণ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ বলি আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলি তাতে যুক্ত হয়েছিল হাতেগোনা কয়েকটা দেশ। প্রতি শতাব্দে নিদেনপক্ষে একটা করে যে মহামারীর কথা আমরা জানি, তা তো দেখা যায়, তার প্রভাব গোটা বিশ্বে পড়েনি। মহামারী রাষ্ট্রের প্রধানকে ছোবল দেয়নি, করোনা যেমনটা দিয়েছে, ক্ষমতাধর দেশ য্ক্তুরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে, কাঁদছে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, আকাশের কাছে আশ্রয় খুঁজছেন ইতালির সরকারপ্রধান। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার অভিঘাত এত তীব্র, মারাত্মক ও ভয়াবহ যে, পৃথিবীর সব দুর্যোগকে ছাড়িয়ে গেছে সে। করোনার আঘাত যেমন, তার শিক্ষাটাও তেমন হওয়া উচিত। নিউটনের তৃতীয় সূত্র তো সেটাই বলে, পৃথিবীর প্রত্যেকটা ক্রিয়ার একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। করোনার আঘাতে পর্যুদস্ত পৃথিবী জেগে উঠবে সেভাবেই, এই প্রত্যাশা এ কারণে মোটেই অমূলক নয়। ০৮. করোনা কি পাল্টে দেব পৃথিবীর খোলনলচে? পৃথিবীর রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতি-সংস্কৃতিনীতি কি বদলে যাবে? পৃথিবীর মানুষ কি কখনই ভাবতে পেরেছিল পুরো বিশ্ব লকডাউন হয়ে যেতে পারে? মানুষের মৃত্যু হবে স্বজনহীন অবস্থায়? ভাবতে পারেনি নিশ্চয়। কিন্তু বাস্তবে সেটাই হলো, সেটাই হচ্ছে। আমরাও হয়তো ভাবতে পারছি না, যুদ্ধবাজ পৃথিবী কীভাবে বদলাবে? খেয়ালি রাষ্ট্রপ্রধানরা সব খেয়াল ছেড়ে মনোযোগ দেবে বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ার দিকে, যার কেন্দ্রে থাকবে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে জেনেও, ফি বছর জলবায়ু সম্মেলন হওয়ার পরও, জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পরও কার্বন নির্গমন হ্রাসে একটা দেশও পালন করেনি ইতিবাচক ভূমিকা। সেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা কী ভাবছেন এখন, এই করোনা ভাইরাসের কালে? ০৯. ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান-পতন কি আমরা ভুলে গেছি? ব্যবসা করতে এসে দেশ করায়ত্ত করার হীন মানসিকতা আখেরে যে ভালো হয়নি, তার সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। অন্যদিকে নেসলে পৃথিবীর দেশে দেশে যার প্রডাক্টের দাপট একচেটিয়া। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নেসলে তাদের ব্যবসার নীতিনির্ধারণে বড় রকমের পরিবর্তন আনে, যাতে এ রকম যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিকেও সামলে উঠতে পারে। বাস্তবে হয়েছেও তাই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সংকটকে সামলিয়ে নিয়েছিল। পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখ আজ। জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন যেমনটা। পৃথিবীর গভীরতর অসুখে এখন পরবর্তী করণীয় ভাবাটা জরুরি। মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার এই পঙক্তি এখন মানবতায় উদ্বুদ্ধ সব মানুষের প্রার্থনা, ধ্যান-জ্ঞান সব কিছু। করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে চলমান এই যুদ্ধ দীর্ঘমেয়াদি এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধ কোনো একক মানুষের, একক পরিবার, একক সমাজ, একক ধর্ম, একক রাষ্ট্র, একক মহাদেশের যুদ্ধ নয়। এ যুদ্ধ পুরো পৃথিবীর যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া জরুরি। কারণ এই যুদ্ধে জিতলে জিতবে সবাই, আর হারলেও সবাই-ই হারবে। ট্রাম্প থেকে টাকলু আক্কাচ, করোনা-যুদ্ধে সবারই জয়ী হওয়া অবশ্যম্ভাবী।

লেখক: ড. কাজল রশীদ শাহীন
সাংবাদিক, লেখক ও গবেষক
বাংলাদেশ

১লা এপ্রিল ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.