Type Here to Get Search Results !

সমাজ সেবিকা" ---- কলকাতা থেকে পারমিতা রাহা হালদার এর ছোট গল্প

তিন বছর পর মিনু নার্সিং ট্রেনিং কমপ্লিট করে নিজের গাঁয়ের সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ইনচার্জ হয়ে ফিরল । অবশ্য নামেই সরকারি, অচল হয়ে কোনো রকমে পরিষেবা ধুঁকছিলো। মিনুর নার্স হয়ে গাঁয়ে আসার খবরে একঘরে করেছে গাঁয়ের মানুষ মিনুর বিধবা মা মিনতি দেবী কে। ছিঃ মেয়ে হয়ে এইসব ম্লেছ কাজ করবে এ কি কথা! যত্তসব বেয়াদবি , বেহায়াপণা! মিনু পৌঁছাতেই ঢিল বর্ষণে মাথা ফাটালো গাঁয়ের মানুষ । রক্তাক্ত মিনু কে বাঁচাতে মিনতি দেবী ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। সব কিছু হাসি মুখে উপেক্ষা করে মিনু , মানুষের সেবাকেই তো স্বেচ্ছায় জীবনের পথ হিসেবে বরণ করে নিয়েছে । গাঁয়ের অচল স্বাস্থ্যকেন্দ্র কে সচলাবস্তায় ফিরিয়ে যে আনতেই হবে তাকে। তার জন্য যতো রকম লড়াই আছে করতেই হবে। "নার্সের চাকরি তো নিচু মানের !!! এইসব কাজ ভদ্র বাড়ির মেয়েদের মানায় না "। তিন বছর আগেও নাসিং ট্রেনিংয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করার সময় গাঁয়ের মানুষদের তীব্র নিন্দার মুখোমুখি হয়েছিল মিনু, আজও। কিন্তু কোন কাজই উঁচু বা নীচু হয়না সেটা বোঝাতে মিনু সত্যিই অক্ষম। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কখনও কখনও শহর থেকে ডাক্তার আসলেও নার্সের অভাবে অনেক বিপদের সম্মুখীন হয়েছে গাঁয়ের মানুষ । বাবা কে হারিয়েছে, নিজের দিদিকে আঁতুর ঘরেই মরতে দেখেছে নিজের চোখে। প্রিয়জনের মৃত্যুর আঘাতে দূঢ় প্রতিজ্ঞ মিনু যেকোনো বাঁধার সম্মুখীন হতে প্রস্তুত। গাঁয়ের সবার আপত্তি,অবশেষে মা সেদিন একমাত্র সাথ দিয়েছিল মিনুর। মায়ের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে নার্স হয়ে মানুষের সেবা করার ব্রত স্বপ্নই থেকে যেতো । সরকারের সহযোগিতা নিয়ে কিছু দিনের মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বেশ কিছু উন্নতি ঘটিয়েছে সে দায়িত্ব পালন ও নিষ্ঠায়। এখন প্রায় প্রতি দিন শহর থেকে ডাক্তার আসে। বেশ কিছু বেডের ব্যবস্থা হওয়ায় আপৎকালীন চিকিৎসা হয়। দরকারে মিনু রাত দিন জেগে সেবা করে রুগির । আঁতুর ঘরে কোন দায়ীমার হাতে মা ও বাচ্চার সমস্যার কথা জানতে পারলে বাঁচাবার জন্য নিজেই ছুটে যায় মিনু । তবুও গাঁয়ের মানুষরা মেনে নেয় না মিনু কে। মিনুর বাবা গাঁয়ের স্কুলের মাস্টারমশাই ছিলেন। সবাই খুব সন্মান করতেন। হঠাৎ সাতদিনের জ্বরে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার না থাকলেও যদি কোন নার্স থাকতো সেদিন তবু ও বাঁচানো যেতো । কারণ নার্সরাই আসল সেবিকার কাজ করে । ডাক্তারের থেকে তারাও এখন কোন অংশে কম নয় । কিন্তু গাঁয়ের বেশির ভাগ অশিক্ষিত মানুষ কে বোঝানো দায়। নার্স হয়ে সেবা করব বললেই তো আর সমাজ সেটা মেনে নেবে না । কিছু মানুষের কথার আক্রমনে মাঝে মধ্যে ভেঙে পড়ে মিনু । কিন্তু মিনতি দেবী কখনও মেয়ে কে ভেঙে পড়তে দেয় না । যেকোনো পরিস্থিতিতে পাশে থেকে মনের জোর বাড়ায়। "তুই পারবি মিনু, তোকে যে পারতেই হবে। আমি অকালে তোর বাবা আর দিদি কে হারিয়েছি । আর কোন গাঁয়ের মানুষদের অকালে মরতে দেব না। আজ না বুঝলেও একদিন ঠিক বুঝতে পারবে দেখিস মা। তুই আমার একমাত্র সম্বল তোকে আমি কিছুতেই হারতে দেবো না"।মায়ের কথা গুলো শুনে মিনু আবার মনের জোর ফিরে পেতো আবার উৎসাহের সাথে নিজের কাজ শুরু করতো। কিন্তু ভগবানের ইচ্ছা বোঝা দায়, কখন যে কি বিপদ ঘনিয়ে আসে কেউ বলতে পারে না । গাঁয়ের মানুষদের মধ্যে ছড়ালো মহামারী । গাঁয়ের মানুষরা এসে এবার মিনুর হাতে পায়ে ধরল, মিনু মা বাঁচাও আমাদের । তুমি কিছু করো, না হলে আমরা সবাই প্রাণে মারা যাবো। মিনু গাঁয়ের মানুষদের আশ্বাস দিল যে,"ও বেঁচে থাকতে গাঁয়ের একজন মানুষের ও কোন ক্ষতি হতে দেবে না"। ডাক্তারদের সাথে তাল মিলিয়ে মিনুর নিরলস প্রচেষ্টায় প্রাণ ফিরল গাঁয়ের মানুষদের। কিন্তু ভাগ্যের চাকা এবার উল্টো পথে ঘুরলো, গাঁয়ের মানুষদের সেবায় মহামারী গ্রাস করলো মিনু কে। ডাক্তারদের অনেক চেষ্টার পরেও মিনু কে ফেরানো গেল না । গাঁয়ের মানুষদের ভুল ধারনা ভাঙিয়ে মিনু বিদায় নিল চিরদিনর মতো । আজ সবাই ক্ষমাপ্রার্থী মিনুর কাছে সসম্মানে মিনুকে শেষ বিদায় দিল গাঁয়ের মানুষ।সেরা সমাজসেবিকা হিসাবে গ্রামের চৌরাস্তায় মিনুর প্রস্তর মূর্তি তার স্মরণে বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রাম পঞ্চায়েত ও গ্রামের লোকেরা। ভদ্র বাড়ির মেয়েরা নার্স হয়ে সেবা করলে সেই কাজ নিচু মানের হয় না সেই ভুল ধারনা থেকে বেরিয়ে গাঁয়ের অনেক মেয়েরাই আজ নার্সিং ট্রেনিং করে মানুষের সেবা তে নিজেদের নিয়োজিত করছে । মিনতি দেবী আজ তার সেরা সম্পদ মিনুকে অকালে হারিয়ে পাথর হয়ে গেছে । অনেক চেষ্টার পরে ও তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে নি কারণ তিনিও গর্বিতা সেরা সমাজ সেবিকার মা রূপে।

পারমিতা রাহা হালদার
ব্যারাকপুর,কলকাতা

১৭ই মে ২০২০

إرسال تعليق

0 تعليقات
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.