আমার একটি উপন্যাসের নাম হাচিকো। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে খ্যাতিমান লেখক আনিসুল হককে। প্রচ্ছদে রয়েছে একটি কুকুরের ছবি। দেশে একুশে গ্রন্থমেলায় প্রায় প্রতিবছর আমি আমার প্রকাশকের স্টলে থাকি। হাচিকো বইটি প্রকাশের পর দুবছর পেরিয়ে গেল। দুবারই কিছুদিন মেলায় স্টলে থাকার সুযোগ হয়েছে। মেলায় (স্টলের সামনে) আগতদের যখন এই বইটি বাড়িয়ে দিয়েছি তখন অধিকাংশ পাঠক বইটি ধরে না নিয়ে ফেরেন নি। একটি বিষয় খেয়াল করেছি, যারা বইটি কিনেছেন তাদের সবায় হাচিকো সম্পর্কে জানেন। যে জন্য বইটি সম্পর্কে আগ্রহের কমতি ছিল না। কেউ কেউ না ধরেই সরে গেছেন আবার অল্প কিছু লোক বলেছে, ” টাকা দিয়ে বই কিনে নেবো, এই কুকুরের ছবি ওয়ালা হবে কেন? কুকুরের বই পড়ে কি লাভ ”?
আমি জাপান আসার পর পরই এই হাচিকো সম্পর্কে জেনেছি। লিখেছিও পত্রিকায়। হাচিকো একটি কুকুরের নাম। মূলতঃ হাচি হলো জাপানি শব্দ আট (৮) আর কো শব্দটি বিশেষ ভাবে মেয়েদের নামের বেলায় নামের পর ব্যবহার করা হয়। আবার সম্মান প্রদর্শণের জন্যও ব্যবহার করা হয় কো শব্দটি।
জাপানের রাজধানী টোকিও-র শিব্যুইয়া ওয়ার্ডের একটি রেল স্টেশনের নাম এই শিব্যুইয়া ওয়াডের নামানুসারে। এই শিব্যুইয়া রেল স্টেশনের রয়েছে পাঁচ (৫) টি প্রবেশ/ বাহির হওয়ারপথ। পাঁচটি পথের একটির নাম করণ করা হয়েছে হাচিকো গুচি বা হাচিকো এনট্রেন্স বা প্রবেশ/বাহির হবার পথ। এই এনট্রেন্সের সামনে পুরো স্থানটি হাচিকো নামেই পরিচিত। স্থানটি একটি এপোয়েন্টমেন্ট প্লেস হিসেবে যেমন পরিচিতি লাভ করেছে তেমনই জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছে সকল বয়সীদের কাছে।
হাচিকো প্রবেশ/বাহির হবার পথের অদূরে রয়েছে একটি কুকুরের মূর্তি, যেটির স্মরণে এই স্থানের নাম করণ করা হয়েছে হাচিকে। হাচিকোকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে, নির্মিত হয়েছে অনেক ডকুমেন্টারি ফিল্ম, নাটক, সিনেমাও। কেবল দেশের (জাপান) ভিতরই নয়, দেশের বাইরেও তা হয়েছে একই ভাবে। এথেকেই বোঝা যায় হাচিকো যে কত খ্যাতি অর্জন করেছে তার বেঁচে থাকার সময়কালে। হাচিকোকে আমরা কেবল যদি একটি কুকুর মনে করি তাহলে ভুল মনে করা হবে। এর আগে অনেক বিশেষণ লাগানো যায়, যা হাচিকো তার জীবদ্দশায় করে যাওয়া কর্মের ফল হিসেবে প্রাপ্য মনে করি। হাচিকোর করে যাওয়া কাজই তাঁকে এই খ্যাতি পাইয়ে দিয়েছে জাপান তথা সাড়া বিশ্বে, যা আমরা মানুষ হয়েও করতে ব্যর্থ হই।
জাপানের আকিতা প্রিফেকচারের ওদাতে নামক এলাকায় এক কৃষকের বাড়িতে একটি কুকুরের অনেক গুলো বাচ্চা হয়। তখন টোকিওর শিব্যুইয়াতে ”টোকিও ইমপেরিয়াল ইউনিভার্সিটি”-র এক প্রফেসর থাকেন। প্রফেসরের নাম হিদেসাবুরো উয়েনো। তিনি আকিতা গিয়ে সেই কৃষক পরিবার থেকে (১৯২৪ সনে) একটি কুকুরের বাচ্চা নিয়ে আসেন সখ করে পোষার জন্য। অনেকগুলো কুকুর শাবকের মধ্যে সেটির সংখ্যা ছিল আট (৮) এজন্যই কুকুরটির নাম করণ করা হয় হাচি আর ভালোবেসে ডাকা হতো কো অর্থাৎ হাচিকো। হাচিকোর জন্ম হয় ১৯২৩ সনের ১০ নভেম্বর।
প্রফেসর হিদেসাবুরো উয়েনো প্রতিদিন এই স্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে কাজে যেতেন আবার কাজ শেষে ট্রেনে চড়ে এই স্টেশনে এসে নেমে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর সাথে স্টেশন পর্যন্ত হাচিকো আসতো, আবার কাজ শেষে ফিরে আসার সময় হলে হাচিকো স্টেশনের সামনে এই স্থানটিতে এসে তার মনিবের জন্য অপেক্ষা করতো। মনিব এলে তাঁর সাথে বাসায় ফিরতো। এটি ছিল ১৯২৫ সনের ২১শে মে পর্যন্ত তাদের নিত্যদিনের ঘটনা।
একদিন প্রফেসর হিদেসাবুরো উয়েনো তাঁর ক্লাস নেবার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে সেখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটে। যে কারণে তাঁর আর এই স্টেশন হয়ে বাড়ি ফেরা হয় নি। বিষয়টি হাচিকোর জানা ছিল না, যে কারণে সেদিন থেকে প্রতিদিন কাজের শেষে প্রফেসরের ফেরার সময় হলে স্টেশনে এসে অপেক্ষা করতো। এই অপেক্ষা করার সমাপ্তী ঘটে ১৯৩৫ সনের ৮ মার্চ হাচিকোর মৃত্যুর মাধ্য দিয়ে। মৃত্যুকালে হাচিকোর বয়স হয়েছিল এগার (১১) বছর।
প্রতিদিন এই স্টশন থেকে বহু লোক ট্রেনে চড়ে কাজে বা অন্য কোথাও আসা যাওয়া করেন। এদের অনেকই মনিব ভক্ত এই কুকুরটিকে তার মনিবের সাথে দেখেছে এখানে আসা যাওয়া করতে। একে জাপানিরা চ্যুকেন হাচিকো বা বিশ্বস্ত কুকুর হাচিকো বলে জানেন। হাচিকোকে নিয়ে প্রথম আশাহি শিমবুন (আশাহি পত্রিকা) ১৯৩২ সনের ৪ অক্টোর ছোট একটি সংবাদ প্রকাশ করেছিলেন। তখন থেকেই এই হাচিতোর মনিবের ভক্তি নিয়ে বিভিন্ন জন আলাপ আলোচনা করতে থাকেন।
তাতে অনেকেই হাচিকোকে স্টেশনের সামনে দেখেছেন। সে সময় সম্ভবত মনিবকে না ফিরতে দেখে মনের যন্ত্রণায় না খেয়ে হাটাচলা করতো। অনেকে আবার এগিয়ে এসে হাচিকোকে খাবার খেতে দিতেন। বিশেষ করে স্টেশনের সামনে ইয়াকতরীর (মাংস পোড়া) মালিক বা কর্মচারী হাকিকোকে ইয়াকতরী খেতে দিতেন। যা হাচিকোর মৃত্যুর পর তার পেট থেকেও ইয়াকতরী পোড়ার পর যে বাঁশের শলায় মাংস গাঁথা থাকে সেই শলা পাওয়া যায়। পরে অবশ্য মনে করা হয় এই শলা হজম না হওয়ায় তার পেটে ঘা হয় যার কারণে হাচিকোর মৃত্যু হয়।
হাচিকোর মৃত্যুর পর মরদেহ পোড়ানোর পোড়ানো হয়, পরে ছাই নিয়ে রাখা হয় টোকিওর মিনাতো ওয়ার্ডের আওইয়ামাতে, যেখানে তার মনিবকে কবর দেওয়া হয়েছে সেখানে এবং ঠিক তার পাশে।
১৯৩৪ সনের এপ্রিল মাসে তেরো আনদো নামের এক ভদ্রলোক শিব্যুইয়া স্টেশন সংলগ্ন এই স্থানটিতে প্রথম হাচিকোর অবিকল আকৃতির একটি মুর্তি স্থাপন করেন। যা পরবর্তীতে ১৯৪৮ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভেঙ্গে যুদ্ধ সামগ্রীর কাজে ব্যবহার করা হয়। যুদ্ধ শেষে ১৯৪৮ সনেই আবার মূল শিল্পির ছেলে মিঃ তাকেশি আনদো দ্বিতীয়বার হাচিকোর মূর্তি পুণরায় স্থাপন করেন। ২০০৪ সনে হাচিকোর জন্মভূমি আকিতা প্রিফেকচারের ওদাতে রেল স্টেশনের সামনে একই ধরনের আরো একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়।
২০০৩ সনে শিব্যুইয়া ওয়ার্ড হাচিকোর নামানুসারে এই এলাকা থেকে একটি রুটে মিনি বাস চালু করেছিল যা এখন কয়েকটি রুটে নিয়মিত চলছে। উল্লেখ্য যে, এই মিনি বাসেরও নামকরণ করা হয় হাচিকো বাস। দিন যত যায় ততই যেন জাপানে এই হাচিকোকে নিয়ে নানা ধরণের স্মৃতিচারণ এবং বিভিন্ন কর্মকান্ড গ্রহণ করছে কর্তপক্ষ। শুধু তাই নয়, প্রতিবছর হাচিকোর মৃত্যু দিবসটিও ঘটা করে উদযাপন করা হয়।
মানুষের প্রতি কুকুরের কতটা যে ভক্তি হতে পারে সেটি এই হাচিকোর কথা না শুনলে বা পড়লে আমার ধারণাই হতো না। ১৯৯১ সনে জাপান আসার পর আমি প্রথম যখন এই হাচিকোর কথা শুনি তখন সত্যিই আপ্লুত হয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে হাচিকোকে নিয়ে যখন কিছুটা কাজ করেছি তখন লাইব্রেবীতে বসে হাচিকোকে নিয়ে লেখা বই পড়তে পড়তে চোখের পানি ফেলেছি। আর হাচিকোর প্রতি এই ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবেই আমার একটি উপন্যাসের নাম করণ করি হাচিকো। এটি একটি ভালোবাসার উপন্যাস।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটকরা এসে প্রায় অধিকাংশ পর্যটকই হাচিকোর এই মূর্তি দেখতে এসে এর পরশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে নিয়ে যান। আপনাদেরকেও হাচিকো দেখার আমন্ত্রণ রইলো।
পি.আর. প্ল্যাসিড
জাপান প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক
১৭ই মে ২০২০
পি.আর. প্ল্যাসিড
জাপান প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক
১৭ই মে ২০২০