Type Here to Get Search Results !

কথা দিলাম......" পি.আর. প্ল্যাসিড,জাপান

ভারতের একটি প্রদেশের নাম ত্রিপুরা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় গুলোতে ত্রিপুরা রাজ্যের মানুষদের বিভিন্ন সহযোগিতার কারণে এই ত্রিপুরা রাজ্যের কথা বাংলাদেশিদের কাছে গুরুত্ব সহ স্মরণীয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা যখন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জণগনের উপর হামলে পরে তখন প্রাণ বাঁচানোর জন্য অনেক বাংলাদেশি এই ত্রিপুরায় এসে আশ্রয় নিয়েছিল। ত্রিপুরা এবং আসামে বাংলাদেশিদের শুধুই আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলা হয় নি। এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থাও করা হয়েছিল। এ সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বস্তরের মানুষ এই যুদ্ধে অংশ নেয়। প্রতিবাদীর বাবাও ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। প্রতিবাদীর বাবার এই যুদ্ধে যাবার কারণ ছিল বাড়িতে তার মা এবং অন্য পিসিমনিদের বাবার সামনে পাকসেনারা অত্যাচার করেছিল। চোখের সামনে এসব সহ্য করতে না পেরে প্রতিশোধ নেবার জন্য যুদ্ধে অংশ নেন। কিন্তু কয়েকমাস পর সংবাদ পান প্রতিবাদীর মার শরীর খারাপ করেছে, যে কারণে সমূহ বিপদ জেনেও রাতের অন্ধকারে বাড়ি এসেছিলেন তার মাকে দেখতে। প্রতিবাদীর বাবা তার মাকে দেখে ফেরার সময় বর্ডারের ওপারে রাজাকারদের হাতে ধরা পড়েন। পরে তাকে ক্যাম্পে নিয়ে অনেক অত্যাচার করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে তথ্য নেবার জন্য। তার বাবা কোনভাবেই তথ্য দিতে রাজী না হওয়ায় তাকে অত্যাচার করে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলা হয়। এই সংবাদ বাড়িতে জেনেছিল স্বাধীনতার মাত্র কিছুদিন আগে। স্বাধীনতা অর্জনের পর প্রতিবাদীর জন্ম হয়। তার মা তার বাবার সেই প্রতিবাদী চেহারার কথা মনে করেই নাম রাখেন প্রতিবাদী। প্রতিবাদী বড় হয়ে কখনও তার বাবার আদর ভালোবাসা পাওয়া দূরের কথা সে কখনও তার বাবাকে দেখেওনি। যখন কিছুটা বুঝতে শিখলো তখন পাড়ার ছেলেমেয়েদেরকে তার বাবা স্কুলে নিয়ে যান দেখে সেও তার মার কাছে জানতে চায়, তার বাবা কোথায়? তার বাবাকে কেন সে দেখে না। কেনই বা তাকে অন্যদের মত স্কুলে নিয়ে যায় না তার বাবা? এমন প্রশ্নের উত্তরে তার মা বলতেন, তোমার বাবা ত্রিপুরা গেছেন। সময় হলেই ফিরে আসবেন। কিন্তু ত্রিপুরা থেকে তার বাবা আর ফিরে আসে না। যখন প্রতিবাদী নিজেই বুঝতে শিখে, তার বাবা আসলে ত্রিপুরাতেও নেই, আর কখনও ফিরে আসবেন না তার বাবা, তখন নিজেই চিন্তা করে কখনও সুযোগ হলে সে একবার হলেও ত্রিপুরা জায়গাটি দেখে আসবে। মায়ের সাথে যখনই তার বাবা প্রসঙ্গে কথা বলে তখনই মা তার শাড়ির আঁচলে মুখ ঢাকে দেখে একসময় আর জানতে চাইতো না। বাড়ির বড়দের কাছে সে তেমন ভালো আচরণও পেত না যে অন্যদের কাছে জেনে নিবে তার বাবা সম্পর্কে। সবাই কেমন যেনো তাদের অবহেলার চোখে দেখে, তাই ছোট সময় থেকেই সে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে শুরু করে। দিন যত যায়, প্রতিবাদী নিজেই সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজে। সে জানে দেশ স্বাধীন হবার ইতিহাস। সর্বত্র সম্মাণ দেয় দেশের জন্য শহীদ হওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অথচ কোথাও তার বাবার নাম খোঁজে পায় না। এতে তার কাছে বাবার বিষয়টি আরো বেশী খারাপ লাগে। মনে মনে ভাবে, যে লোকটি দেশের জন্য জীবন দিল তার কোন স্বীকৃতি মিলল না, অথচ অন্য যাদের এই স্বীকৃতি পাবার কথা নয় তারা দিব্যি বহাল তবিয়তে। ওরা দেশ স্বাধীন হোক সেটা চায়নি, যে কারলে লক্ষ লক্ষ লোকের জীবন দিতে হলো সেই যুদ্ধে, মা বোনের ইজ্জত দিতে হয়েছিলো, এ কি করে হয়? শুরু করে প্রতিবাদী এ নিয়ে পড়াশোনা। আসলে কোন লেখকের কোন বইটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, বই পড়লে কি হবে, তা নিশ্চিত হতে পারে না। বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বই পড়ে সে যেনো আরো মিস গাইড হয়ে যায়। ইতিহাস লেখা যত কঠিনই হোক ইতিহাস রচনা করাতে হয় উদার মনের মানুষদের দিয়ে। যা কিনা হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস রচনার বেলায়। এতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পরবে বিপদে। নিজের দেশের সঠিক ইতিহাস না জানার কারণে বিশ্বের বুকে এই জাতি মাথা উচু করে দাঁড়াতে পারবে না। নিজের দেশের ভিতরেও যে একটা বিভক্তির সৃষ্টি হবে যা দেশের ও দেশের মানুষদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। তা অনুমান করতে পারে প্রতিবাদী। এরমধ্যে সে কলেজ পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডিতে পা রাখে। প্রতিবাদীর মা একসময় অন্যর বাড়িতে কাজ করে তাকে পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে। এখন তাকে আর অন্যের বাড়িতে সেই কাজ করতে হয় না। প্রতিবাদী তার মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে টিউশনী যুগিয়ে নিয়েছে ঢাকা শহরে। টিউশনী পড়িয়ে অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেছে প্রতিবাদী।

একবার তাদের কয়েক বন্ধু মিলে আলোচনা করে ভারত যাবে তারা শিক্ষা সফরে। সিদ্ধান্ত হয় আসাম যাবে তারা। প্রতিবাদী বিষয়টি জানার পর দলের সাথে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেয় আসাম যেতে। এ বিষয় অন্য কারো সাথে আলাপ না করে তার শিক্ষককে আগ্রহের কথা সব খুলে বলে। তার সেই শিক্ষকও জানতেন না যে প্রতিবাদীর বাবা নেই। তবে মাঝে মধ্যে তার এই নাম নিয়ে শিক্ষকও ক্লাসে রসিকতা করে বলতেন এটা তোমার কেমন নাম হে? প্রতিবাদী অবশ্য কখনও তার এই নামের রহস্য বা কোন কিছুই ক্লাসের কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করে নি। শিক্ষককে তার বাবার যুদ্ধে শহীদ হবার ঘটনা মায়ের কাছে যতটা শুনেছে সেদিন সবটাই খুলে বলেছে। সে সাথে তার এই প্রতিবাদী নাম রাখার পিছনের কারণটাও বলেছে সে। শিক্ষক মনে মনে ভাবেন, আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলা কালে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের নাম গুলোর অধিকাংশ এমনই হয়েছে। যেমন- জয়, জয়া, বিপ্লব, প্রতিবাদ, প্রতিবাদী, মজিবর এমন সব নাম। প্রতিবাদী তার শিক্ষক যিনি সবকিছুর দায়িত্বে রয়েছেন তাকে বলল, তার বাবা যেহেতু ত্রিপুরাতে ছিলেন তাই তার ত্রিপুরা যাবার ইচ্ছে খুব এবং সে যুদ্ধের সময় ত্রিপুরায় বাংলাদেশী শরণার্থীদের অবস্থা নিয়ে রিচার্স করবে। শিক্ষক খুশী হয়ে বলেন তার এবারের শিক্ষা সফরে যাবার পুরো খরচ বিভাগ থেকে দেওয়া হবে। বিষয়টি জানার পর সে তখনই তার মাকে জানায় বাড়িতে ফোন করে। তার মা মহা খুশী, যখন জানতে পারে তার প্রতিবাদী ত্রিপুরাতেও যাবে। প্রতিবাদীর মা তখনই আবার বলল, বাবা তুই যাবি ত্রিপুরা? সত্যি বলতাছছ তো? আমার কপালে তো নাই বাবা, তোর বাবারে যেখানে মাডি দিছে ওইখানে একটা ফুল গাছ লাগাইয়া দিয়া আহিছ। আর আমি তোর যাইবার সময় কিছু ফুল দিমুনে। ফুল গুলা তোর বাবার কবরে দিয়া আহিছ। প্রতিবাদী তার মায়ের কথা শুনে একা একাই চোখের পানি ফেলে। কোন কথার উত্তর দেয় না সে। মায়ের কথা শুনে বলে, আমি মা বাড়িতে এসে তোমাকে সব বলবো। আজ রাখি, বলে ফোন রাখে। একসময় মায়ের সাথে কথা বলে সত্যি সত্যি মায়ের দেয়া ফুল নিয়ে ঢাকা আসে। যদিও সে এই ফুল ত্রিপুরা নিয়ে যায় নি, তবে তার ঘরে বিছানার পাশে ফুল গুলো রেখে সুন্দর করে পানি দিয়ে সেখানে বাবার ছবির বদলে একটি ধর্মীয় গ্রন্থ রাখে। ভারত যাবার আগে সে প্রার্থণা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে ত্রিপুরা গিয়ে যেনো সে তার বাবার কবরের সন্ধান পায়। এজন্যই ফুলের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে সেই গ্রন্থটি রেখে যাওয়া। কয়েকজন মিলে আসাম যায় ওরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলা কালীন সময়ের অনেক স্থান দেখে সেই সময়কার বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সাথে দেখা করে কথা বলতে। সফর শেষে সবাই ফিরে এলেও প্রতিবাদী এবং তার শিক্ষক সেখান থেকে ত্রিপুরা যায়। দুজন ত্রিপুরা গিয়ে প্রথমে বয়ষ্কদের সাথে যোগাযোগ করে। তারা যেখানেই যায় সেখানেই বেশ আতিথেয়তা পায়। সেখানে সবাইকে তাদের ত্রিপুরা যাবার উদ্দেশের কথা বলে। এর মধ্যে প্রতিবাদীরই বয়সের এক মেয়ের সাথে তার পরিচয় হয়। নাম কবিতা। কবিতা সাহা। সেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কবিতা নিজে থেকে তাদের দুজনের সাথে থেকে গাইড হিসেবে কাজ করার কথা বললে তারা রাজী হয়ে প্রথমেই তার বাড়ি যায়। গল্পে গল্পে কবিতার দাদু সেই যুদ্ধকালীন সময়ের অনেক তথ্যই দেন। সেই সূত্র ধরেই প্রতিবাদী ত্রিপুরায় তার কাজ শুরু করে। কবিতা তাকে যখন যেদিকে যেতে বলেন, যার সাথে দেখা করে কথা বলতে বলেন তাই করছে। ত্রিপুরায় তারা দুই সপ্তাহ থাকার কথা বললেও প্রায় তিন সপ্তাহ সময় কাটায়। এই সময়ের মধ্যেও প্রতিবাদী তার বাবার কবর বা অন্য কোন তথ্য জানতে পারেনি। অন্যদিকে তার ক্লাস শুরু হয়ে যাবার সময় হয়ে যায়। তারা ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে যাবার আগের দিন কবিতাদের বাড়িতে শেষ ডিনারের আয়োজন করে। সেখানে এ কয়দিনে যাদের সাথে দেখা করে কথা বলেছে তাদের সবাইকে আমন্ত্রণ করলে তাদের অনেকেই উপস্থিত হন। সেখানে এমন একজন বয়স্ক লোক উপস্থিত হন যার সাথে প্রতিবাদীদের এই কদিনে দেখা হয়নি। লোকটি প্রতিবাদীদের ত্রিপুরা ভ্রমণের উদ্দেশ্যের কথা জানার পর যুদ্ধ চলাকালে পুরোনো দিনের কথা স্মরণ করে বলতে শুরু করেন। উনিও ছিলেন বাংলাদেশি। রাজাকারদের হামলার শিকার হয়ে সব ফেলে চলে আসেন ভারত। ভারতের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এই ত্রিপুরাতেই শিকড় গাড়েন। দেশে আর ফিরে যান নি। ওনিও যুদ্ধের সময় আশ্রিতদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন। প্রতিবাদী তার মায়ের মুখে বাবার সম্পর্কে যে গল্প শুনেছে সব মিলে যায় এই বয়ষ্ক লোকটির অনেক কথার সাথে। এটুকু নিশ্চিত হয়, লোকটিই তার বাবার কবর সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানাতে পারবেন। তার কথা মন দিয়ে সব শুনলেন। শোনার পর বলল, পরদিন সেই জায়গাটি সে দেখতে যেতে চায় যেখানে কিছু লাশ বর্ডার থেকে এনে কবর দেওয়া হয়েছিল। অনেকের সাথে যে তার বাবারে লাশও কবর দেওয়া হয়েছে তা অনুমান করে সে। পরেরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই তারা রওনা হয় সেই ঠিকানা অনুযায়ী। গিয়ে আশে পাশের লোকজনদের সাথে কথা বলে প্রতিবাদী আর তার শিক্ষক। সাথে কবিতাও। আগের রাতে শোনা কথার সাথে সব মিলিয়ে নেয় তারা। এরপর স্মরণ করে মায়ের কাছে শোনা তার বাবার সম্পর্কে। সবকিছু মিলে গেলে সে নিজে কবিতাকে নিয়ে গ্রামের এক বাড়িতে গিয়ে কিছু ফুলের গাছ চেয়ে নিয়ে আসে। নিয়ে এসে কবিতা সহ গাছ গুলো কবরের পাশে লাগিয়ে পানি দেয়। এরপর বাবার আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থণা করে কবিতাকে অনুরোধ করে বলে, কবরে লাগানো গাছ গুলোর যত্ন নেবার ব্যবস্থা করে দিতে। কবিতা প্রতিবাদীর সব কথা শোনার পর এতদিনে দেখা তার আবেগ ও আন্তরিকতা দেখে কান্না জড়িত কন্ঠে অনুরোধের কথা শুনে ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলে, প্রতিবাদী আপনি দেশে যান। আমি আপনাকে কথা দিলাম এর দায়িত্ব আমি নিলাম। আমি সময় করে নিজে থেকে এসেই কবরে নিয়মি আগর বাতি জ্বালাবো। আর কাউকে দিয়ে এই গাছ গুলোর যত্ন নেওয়াবো। আবার যখন আপনি ত্রিপুরা আসবেন তখন এসে দেখবেন আপনার বাবার কবরে লাগানো এই গাছে ফুল ফুটেছে। এরপর সেখানেই তারা বিদায় নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসার জন্য চলে যায় নির্ধারিত বাস স্ট্যান্ডে।

------------------------ পি.আর. প্ল্যাসিড, জাপান
প্রবাসী লেখক-সাংবাদিক

৩১শে মে ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.