বাঙালি জাতি, বাংলা সাহিত্য ও সমগ্র বিশ্বসাহিত্যের জন্যই বাইশে শ্রাবণ বিয়োগ-বেদনার তীব্র দহন আর সন্তাপে
ভরা একটি দিন। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শে শ্রাবণ দিনটিতেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পৃথিবীর
মায়া কাটিয়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন অমৃতলোকে। মর্তলোকের সাথে তার সম্পর্কের মেয়াদ ৮০ বছর
তিন মাস হতে তখন বাকি ছিল মাত্র দু’টি দিন। ঘড়িতে তখন দুপুর ১২টা বেজে ১০ মিনিট। পৃথিবীর বাতাসে শেষ
নিঃশ্বাস ফেললেন আমাদের প্রাণের অমূল্য সম্পদ । চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল গভীর শোকের কান্নামথিত
বার্তা।
রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য সমাপ্ত করে এসে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সে দিন একটা কবিতা লিখেছিলেন। বেদনার রঙে রঙিন সেই কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি তখন সেই মুহূর্ত গুলিকে তুলে ধরছিল আমাদের সামনে ...।।
বাইশে শ্রাবণের সেই বেদনামথিত মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন জোড়াসাঁকোর আঙিনায় নেমে দেখি জনসমুদ্র পার হয়ে ওপরে যাওয়া অসম্ভব। ওই বাড়ির অন্যান্য অংশও চিনি বলে অন্য রাস্তায় সহজেই ওপরে উঠতে পারলাম। কিন্তু ঘরের ভেতরে পৌঁছার কয়েক সেকেন্ড আগেই শেষ নিঃশ্বাস থেমে গেছে। ভাগ্যের এ কী নিদারুণ চক্রান্ত। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কাছে থাকব বলে যে সত্য করেছিলেন এত প্রাণপণ চেষ্টা করেও তা রক্ষা করতে পারলাম না।
জোড়াসাঁকোতে রোজই ফোন করি। ওরা সর্বদা বলে ভালো আছেন। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি কবির জ্বর আছে অস্থিরতা বেড়েছে। এখন তুই কী করবি? আমার মতে দার্জিলিং ঘুরে চলে আয়। আর যদি সে রাস্তাও বন্ধ থাকে, তবে আর কী করবি। ভগবানের নাম নিয়ে পড়ে থাক।শুধু শেষ সময় যদি এসে থাকে। সে সময়ে কাছে না থাকলে তোর তো কষ্ট হবেই, আর ভালো হয়ে উঠলেও উনি কিন্তু মনে মনে খুব দুঃখ পাবেন।
"পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব, তুমি আছ আমি আছি।।"
রবীন্দ্রনাথের শেষকৃত্য সমাপ্ত করে এসে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় সে দিন একটা কবিতা লিখেছিলেন। বেদনার রঙে রঙিন সেই কবিতার প্রতিটি পঙ্ক্তি তখন সেই মুহূর্ত গুলিকে তুলে ধরছিল আমাদের সামনে ...।।
‘বাঁচারগর্বে মাটিতে তার পা পড়ছিল না বলে
গানগাইতেগাইতেআমরা তাকে সপাটে তুলে দিয়ে এলাম
আগুনেরদোরগোড়ায়
লোকটার জানা ছিল কারুকল্পের জাদু
ধুলোকে সোনা করার ছুঁ-মন্তর
তার ঝুলিতে থাকত
যত রাজ্যের ফেলে দেওয়ারকমারি পুরনো জিনিস
যখন হাত ঢুকিয়ে বার করত
কী আশ্চর্য
একেবারে ঝকঝকে নতুন...
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের শ্মশানযাত্রার ছবিটি বেদনার রসে সিক্ত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ...।।
বাইশে শ্রাবণ শিরোনামে অসাধারণ একটা গ্রন্থ লিখেছেন নির্মল কুমারী
মহালনবিস। বাইশে শ্রাবণের আনুপূর্বিক ঘটনার বিস্তৃত এবং বিশ্বস্ত বর্ণনা রয়েছে এই
গ্রন্থে। অসুস্থ অবস্থায় রবীন্দ্রনাথের পরিচর্যার দায়িত্বে যারা নিয়োজিত ছিলেন, নির্মল কুমারী তাদেরই একজন। তাই বাইশে শ্রাবণ নিয়ে
তার কলম থেকে যা লেখা হয়েছে অনেক লেখার ভিড়েও তা সমধিক উজ্জ্বল। এই গ্রন্থের কোনো বিকল্প নেই।গানগাইতেগাইতেআমরা তাকে সপাটে তুলে দিয়ে এলাম
আগুনেরদোরগোড়ায়
লোকটার জানা ছিল কারুকল্পের জাদু
ধুলোকে সোনা করার ছুঁ-মন্তর
তার ঝুলিতে থাকত
যত রাজ্যের ফেলে দেওয়ারকমারি পুরনো জিনিস
যখন হাত ঢুকিয়ে বার করত
কী আশ্চর্য
একেবারে ঝকঝকে নতুন...
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথের শ্মশানযাত্রার ছবিটি বেদনার রসে সিক্ত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ...।।
বাইশে শ্রাবণের সেই বেদনামথিত মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন জোড়াসাঁকোর আঙিনায় নেমে দেখি জনসমুদ্র পার হয়ে ওপরে যাওয়া অসম্ভব। ওই বাড়ির অন্যান্য অংশও চিনি বলে অন্য রাস্তায় সহজেই ওপরে উঠতে পারলাম। কিন্তু ঘরের ভেতরে পৌঁছার কয়েক সেকেন্ড আগেই শেষ নিঃশ্বাস থেমে গেছে। ভাগ্যের এ কী নিদারুণ চক্রান্ত। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কাছে থাকব বলে যে সত্য করেছিলেন এত প্রাণপণ চেষ্টা করেও তা রক্ষা করতে পারলাম না।
অমিতা আমাকে বলল, আর একটু আগে এসেও যদি আপনি পৌঁছতে পারতেন। ঠিক শেষ মুহূর্তের আগে
ডান হাতখানা কাঁপতে কাঁপতে ওপরে তুলে কপালে ঠেকাতেই হাত পড়ে গেল।
ঘর লোকে লোকারণ্য। দেখি বনমালী দূরে এক কোনো দাঁড়িয়ে নীরবে চোখের
জল ফেলছে। এই অসুখের ক’দিন দিনে-রাতে ছায়ার মতো সে তার বাবা
মশাইর ঘরের আশপাশে ঘুরেছে। যখন যা দরকার করে দিয়ে গেছে।...
একটু পরে সেবক-সেবিকারা ছাড়া আর সবাইকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলা হলো। গুরুদেবকে
স্নান করানো, সাজিয়ে দেবার কাজ
এখনো তো বাকি আছে ...
সেবা তো সমাপ্ত হয়নি।...
জনতার উন্মত্ত কোলাহল সমুদ্র গর্জনের মতো কানে আসছে। ঘরের মধ্যে
অপরিসীম শান্তি বিরাজ করছে। কবি চিরনিদ্রায় মগ্ন। মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম, সেই শান্ত সমাহিত মুখশ্রীতে দেহের কোনো কষ্টের
চিহ্নমাত্র নেই। সাদা বেনারসির জোড়, কপালে চন্দন। আজানুলম্বিত চাদরখানা পাট করে গলায় ঝুলিয়ে দেয়া
হয়েছে। গোড়ের মালার ফুলের গন্ধে ঘর আমোদিত। শুভ্র কেশ। শুভ্র বেশ। নিশ্চিন্ত হয়ে
শান্তিতে ঘুমুচ্ছেন। কোথায় গিয়েছে আমাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা!
অতৃপ্ত নয়নে শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছি।...
বেলা ৩ টের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের
সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত কবির দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। যেখানে বসেছিলাম, সেইখানেই স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম।
নির্মল কুমারী মহালনবিশের মতো মৈত্রেয়ী দেবীও ছিলেন রবীন্দ্রনাথের
অতি কাছের মানুষ। তবে রাণী রবীন্দ্রনাথের শেষের দিনগুলোর পুরোটা সময় তিনি
রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি থাকতে পারেননি। এমনকি পুত্রবধূ প্রতিমা দেবীও পারেননি।
খানিকটা অভিমান আর অনেকখানি আদর মিশিয়ে রবীন্দ্রনাথ আখ্যায়িত করেছিলেন তার শেষের
বন্ধু বলে। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের যখন অপারেশন হয় সেই সময়টাতে মৈত্রেয়ী
দেবী ছিলেন হিমালয় পাহাড়ের নিভৃত অঞ্চল মংপুতে তার স্বামীর সংসারে। তখন বর্ষাকাল। পাহাড়ি রাস্তায়
প্রচণ্ড ধস নেমেছিল। তাই যোগাযোগব্যবস্থা প্রায় অচল হয়ে পড়েছিল। মৈত্রেয়ী দেবীর মন
পড়ে ছিল রবীন্দ্রনাথের রোগশয্যার পাশে। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তিনি
পাহাড় থেকে নামতে পারছিলেন না। রেডিও, টেলিফোন, টেলিগ্রাম ও
চিঠিপত্রের মাধ্যমে তিনি রবীন্দ্রনাথের খোঁজখবর নেয়ার সার্বিক চেষ্টা চালিয়ে
যাচ্ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি কলকাতা থেকে লেখা তার এক মাসির চিঠি পান। চিঠিটি এই
রকম ...জোড়াসাঁকোতে রোজই ফোন করি। ওরা সর্বদা বলে ভালো আছেন। কিন্তু আমি জানতে পেরেছি কবির জ্বর আছে অস্থিরতা বেড়েছে। এখন তুই কী করবি? আমার মতে দার্জিলিং ঘুরে চলে আয়। আর যদি সে রাস্তাও বন্ধ থাকে, তবে আর কী করবি। ভগবানের নাম নিয়ে পড়ে থাক।শুধু শেষ সময় যদি এসে থাকে। সে সময়ে কাছে না থাকলে তোর তো কষ্ট হবেই, আর ভালো হয়ে উঠলেও উনি কিন্তু মনে মনে খুব দুঃখ পাবেন।
এই চিঠি পাওয়ার পর মৈত্রেয়ী দেবী আর দেরি করেননি। সমস্ত দুর্যোগ
মাথায় নিয়ে। সমস্ত প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে শিশুকন্যা মিস্টকে কোলে নিয়ে পাহাড় থেকে
নেমে এসেছিলেন। কিন্তু শিলিগুড়ি রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছেই জানতে পারলেন কবি আর বেঁচে
নেই। সব শেষ হয়ে গেছে। সেই উন্মত্ত ও দিশেহারা অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে মৈত্রেয়ী
লিখেছেন ট্রেন চলছে। আমার
কোলের ওপর অভুক্ত কন্যাশিশু ঘুমাচ্ছে। আমি বসে বসে আমার আবাল্য সুহৃদ মাসির কথা ভাবছি। সে
লিখেছেন। উনি যদি জেগে ওঠেন, কষ্ট পাবেন। ভাবছি পেয়েছিলেন কি?
কোনো মুহূর্তে চোখ খুলে ওর মনে হয়েছিল কি, যে পাশে বসে পশম বোনে,
সে তো এখানে নেই।
সারা জীবন ধরে মৈত্রেয়ী দেবী এই প্রশ্নটিকে তার বুঝের মধ্যে জাগিয়ে
রেখেছিলেন। কিন্তু কোনো উত্তর খুঁজে পাননি। কেননা দেয়ার মানুষটি আর কোনো দিন
জাগেননি।
যুগে যুগে আমরা খুঁজে চলেছি ...বয়ে চলেছি ... ধারণ করে চলেছি
আমাদের প্রাণের সেই অমুল্য স্পন্দনকে ...... তার ভাবনায় প্রাণিত হয়ে মন প্রাণ
সিক্ত করি সুন্দর চিরসবুজ অনুভবের বৃষ্টিতে ... তাঁর চরণে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বাসে
লক্ষ কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ......
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব, তুমি আছ আমি আছি।।"
তথ্যঋণ ও ছবিঃ ইন্টারনেট
গ্রন্থনাঃ শান্তনু শর্মা
২২শে শ্রাবণ, ২০২০ইং