Type Here to Get Search Results !

" প্রতিটি জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব তার মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার " ঃ আরশিকথা হাইলাইটস

মাতৃভাষার অধিকার মূলত মানবাধিকার।জাতিসংঘে সনদ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্রে মাতৃভাষাকে মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবিধানে মাতৃভাষা মৌলিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত।ভারতবর্ষে সংবিধান স্বীকৃত অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত মোট ২২টি ভাষা স্বীকৃত হলেও বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত মোট ভাষা হলো ১৬৫২টি।বাংলাদেশের সংবিধানে মাতৃভাষা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃত।ইসলাম মাতৃভাষাকে শুধু মানবাধিকার হিসেবেই স্বীকার করেনি,মৌলিক অধিকার হিসেবেও ঘোষণা করেছে।মাতৃভাষা ধর্মের জন্য সংরক্ষিত হয় না।ধর্ম দ্বারা বিভাজ্যও নয়।এটা দুঃখজনক হলেও সত্যি যে,পৃথিবীর বহু ভাষা ও ভাষাকেন্দ্রিক সংস্কৃতি আজ মৃত বা মৃতবৎ।বিলুপ্তির পথে।ইউরোপের ল্যাটিন,মধ্য প্রাচ্যের হিব্রু ইতিমধ্যেই মানুষের বোধগম্যতা হারিয়েছে।ভারতের সংস্কৃত ভাষা ধর্মীয় খাঁচায় বন্দি।পালি,প্রাকৃত,এখন অতীতের স্মৃতিচিহ্ন।ব্রিটেনের কোর্ণিশ ভাষা জানা একমাত্র মহিলার মৃত্যুর কারণে উক্ত ভাষাটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে।সারা পৃথিবীতে ২৫০টি'র বেশি ভাষা পরিবার বিদ্যমান।৬,৮০০ ভাষায় কথা বলে পৃথিবীর মানুষ (till 2016 report)ভাষাবিদরা অনুমান করছেন,আগামী শতাব্দীতে ৫০-৮০ শতাংশ ভাষা বিপন্নতার ঝুঁকিতে বা বিলুপ্ত হয়ে যাবে।মাত্র ৫-৭টা ভাষায় কথা বলবে মানুষ।মাতৃভাষার বদলে তাকেই বলা হবে গ্লোবাল ল্যাঙ্গুয়েজ।এটা সত্যি দুঃখজনক হবে। কেউ কি জানতো হাজার হাজার বছর আগে বর্তমানে তুরস্কে হিট্টিট ( Hittite) ভাষাটি রাজত্ব করেছিলো ? মাতৃভাষার প্রতি প্রত্যেক মানুষেরই অনুভূতি অত্যন্ত গভীর।এর কোন ভৌগলিক সীমারেখা নেই।যেকোনো ভাষিক জনগোষ্ঠী, যত ক্ষুদ্রই হোক তার জনসংখ্যা নিজস্ব ভাষায় বিকশিত হতে চায়।ফুল ফোটাতে চায় তারা।নীরবে আর বিরতিহীনভাবে চলে সকল ভাষাভাষীদের মধ্যে ফুল ফোটানোর যুদ্ধ।জীবিকা ও উচ্চশিক্ষার জন্য মানুষ ভিন্ন ভাষাকে আয়ত্ব করে নেয়।এই ধারা চিরকাল চলে আসছে।মানুষের সংস্কৃতি ভাষা নির্ভর।ভাষায় আঘাত এলে সংস্কৃতিতেও তার প্রভাব পড়ে।মাতৃভাষার চর্চা কমে গেলে সংস্কৃতিও দুর্বল হয়ে যায়।সেই সঙ্গে মানুষের হৃদয়বৃত্তির কাজও মন্দীভূত হয়ে যায়।এতে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আম জনতা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ।কারণ সাধারণ মানুষ মূলত সংস্কৃতি নির্ভর।বৈষ্ণব সেবা,হরি সেবা, মোচ্ছব,কীর্তন-লীলা-পালা-রামায়ণ-মহাভারত-পুঁথি-পাঁচালি-পূজা-পার্বণ- মেলা-উৎসব-চড়ক-গাজন-গড়িয়া-ধামাইল-হজাগিরি- ইত্যাদি নিয়েই সমাজ সংস্কৃতি।আমাদের সংস্কৃতি ধর্মাশ্রিত।আর এই সংস্কৃতিই আমাদের পরস্পরকে ঐক্য সূত্রে,মৈত্রী বন্ধনে ধরে রেখেছে।এটাই মানব ধর্ম।সংস্কৃতি দুর্বল হয়ে গেলে আঘাত আসবে আমাদের ধর্মবোধে আর চেতনায়।দিশাহীন হয়ে যাবে আমাদের সমাজ।রক্তপাত,হিংসা,নির্যাতন,মূল্যবোধ আর মাসী-পিসি সম্পর্ক শিথিল হয়ে যাবে তখন।সমাজের কাজ সমষ্টিকে ধরে রাখা।যাবতীয় কর্মকাণ্ডে সমষ্টি চেতনাকে তুলে ধরা।নাহলে হারিয়ে যাবে এই বোধ।আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে মানুষ।সত্যবোধ বা ধর্ম চেতনায় চিড় ধরবে তখন।ধর্ম তখন সমাজ, ধর্ম হারিয়ে হয়ে যাবে শুধুই প্রাতিষ্ঠানিক।বাণিজ্যায়ন বা দুর্নীতিকে তখন আটকানো যাবে না। অসহায় মানুষের ঠিকানা হয়ে উঠবে বাণিজ্য নির্ভর ধর্ম প্রতিষ্ঠান।আত্মার উন্নতি মানব জাতির মূল লক্ষ্য।তাই মাতৃভাষার আন্দোলন,তার চর্চা অস্তিত্বেরই আন্দোলন আর চর্চা।প্রতিটি জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব তার মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার।নিজস্ব লিপি না থাকলেও প্রতিবেশীর কোন লিপির সাহায্যে তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।অনুবাদ, নব নব শব্দচয়ন আর লেখালেখির চর্চা বাড়িয়ে দুর্বল ভাষাকেও জাগিয়ে তোলা সম্ভব।প্রত্যেক জনগোষ্ঠীরই আছে নিজস্ব গল্প-গাথা, যা মুখে মুখে চলে আসছে।তাকে লেখ্যরূপ দেবার দায়িত্ব সেই জনগোষ্ঠীর লোকদের।ভাষা যত ক্ষুদ্র বা বৃহৎ জনগোষ্ঠীরই হোক না কেন,সমস্ত জীবন্ত ভাষার সাহিত্য-সংস্কৃতিকে, আম জনতাকে সঙ্গে নিয়ে সবার তুলে ধরা উচিত।শক্তিশালী ভাষা-সংস্কৃতি বা পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আর ভ্রান্ত সংস্কৃতির নীরব শোষণ আগ্রাসন থেকে দুর্বল ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করা, জাগিয়ে তোলা,তুলে ধরার জন্য এই কাজটি যুদ্ধ নয়তো কি ? নয়তো তরুণ প্রজন্মের কাছে কোন দিশাই থাকবেনা একদিন।


আরশিকথা হাইলাইটস

তথ্যঋণঃ ডঃ গোপালমণি দাস, ত্রিপুরা

২১শে ফেব্রুয়ারি ২০২১        

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.