জাতিরাষ্ট্র বিপ্লবে ১৭ই মার্চ , দুখিনী বর্ণমালা এবং শেকড়ছাড়া মানুষেরাঃ সাইফুর রহমান কায়েস
আরশি কথামার্চ ১৭, ২০২১
0
বাংলা এখন আর বাঙালির মুখের ভাষা নয়। বিশেষ করে শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত শ্রেণির মুখের ভাষা না ইংরেজি না বাংলা। তারা বাংরেজি বলে নিজেদেরকে বেশি ব্যুৎপত্তিসম্পন্ন প্রমাণের হীন প্রচেষ্টারত । আসলে তাদের দ্বারাই বাংলাভাষা নিগৃহীত হচ্ছে। তারা কথ্য, প্রমিত, বাংলা,ইংরেজি মিলিয়ে খিচূড়িভাষার সৃষ্টি করে ভাষাকে দূষণের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বাংলা শব্দ কিন্তু এখন বেবাটের কবলে পড়ে But হয়ে গেছে। আকছারই বলছেন তারা। টিভি, রেডিওর উপস্থাপকগণ, টকবাজদের দল দ্বারা বাংলা ভাষা ধর্ষিত হচ্ছে এখন। আমাদেরকে এ বিষয়ে শক্ত, অনঢ় এবং দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে, ভাষা আন্দোলনের সত্তর বছরে এসে বাংলাভাষা বিশ্বের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেও নিজভূমেই পরবাসী । দেশের বড়বড় দপ্তর , বিশ্ববিদ্যালয় , ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম ও নামফলক, উচ্চবিত্ত ও বিত্তশালীদের বাড়ির নামফলক, উঠতি মধ্যবিত্তদের ছেলেমেয়েদের বিয়ের দাওয়াতপত্র ইংরেজিতে লিখা হচ্ছে। ফলে বাংলা এখন আর বাঙালিদের প্রাত্যহিক প্রয়োজনীয় ভাষা মাধ্যম নয়। তাই কান্দে আমার দুখিনী বর্ণমালা ।
আমরা জাতীয়তাবাদ বলতে অজ্ঞান হলেও আতুর ঘরেই জ্ঞানরহিত হয়ে পড়ে আছি। এখন আর আমরা আমাদের সন্তান সম্ভবা স্ত্রীকে অকাতরেই বলছি মাই ওয়াইফ কন্সিভড বেবি। নিজের সন্তানকে আদর করে বলছেন কিড। অথচ এই শব্দের অর্থ শুকর ছানা । তাই বাঙালি তার ঘরে নিজের সন্তান নয়, শুকর ছানাকেই লালন করছে। এই শুকর ছানা পোষার জন্য নিশ্চই সরকার জাতির পিতার জন্মদিনকে জাতীয় শিশুদিবস ঘোষণা করে নি ? প্রতিটি ঘরেই মনুষ্য সন্তান মাতৃছায়ায় নিশ্চই , মাতৃভাষার দুগ্ধপান করে বলীয়ান হয়ে উঠবে। প্রতিটি শিশুই হয়ে উঠবে একেক জন মুজিব। জাতির আগামী দিনের পথপ্রদর্শক । আমাদের ভবিষ্যৎ । আমাদের বর্তমান। এরাই বাংলাদেশকে আলোকিত , আলোড়িত এবং আন্দোলিত করবে।
ভাষাবোধ যদি জাতীয় চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে উপেক্ষিত হয় তাহলে জাতি হিসাবে শুধু সাংস্কৃতিক মুক্তিই নয়, অর্থনৈতিক মুক্তিও আমাদের কপালে জুটবে না। আমরা শেকড়ের সাথে সম্পর্কহীন হয়ে বেড়ে উঠার ফলে দেশপ্রেম আজ সোনার হরিণে পরিণত হয়েছে। দুর্নীতিতে কয়েকবার শ্রেষ্ঠতা অর্জন করলেও আমাদের মধ্যে কোনো আত্মশ্লাঘা নাই। আমরা দেশের সম্মানহানিতে লজ্জিত ও বিব্রতবোধ করতেও বিব্রত হই। আমরা আর কতো নিচে নামলে আমাদের ইজ্জত গেলো বলে হুশ হবে, অপমানবোধে তাড়িত হবো ? এর কারণ আমরা প্রতিদিনই খুব জোরেশোরে নিজেদের শেকড়কে ভুলে যাবার চর্চা করছি। অপমানবোধ আমরা হজম করার শিক্ষা নিচ্ছি।
নিজেদের মধ্যে লাভ ও লোভের বাসনা নগ্নভাবে জাগ্রত হওয়াতে নিজের সন্তানকে ইংরেজি মাধ্যমে পাঠাচ্ছি। আবার আরেকদল বেহেশতে যাবার জন্য নিজেদের ছেলেমেয়েদেরকে মাদ্রাসায় পাঠাচ্ছেন। আবার উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণি জাতির সাথে মহা প্রতারণার অংশ হিসাবে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করে তেলসলতের যোগান দিলেও নিজেদের ছেকেমেয়েকে পাঠাচ্ছেন ইংরেজি মাধ্যমে, সাধারণ শিক্ষায়। একদেশে এগারো রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চলতে দেয়া যায় না। জীবিকানির্বাহ করা যায় না শুধু সনদে। বৃত্তিনির্বাহক ও নিবারক এবং আত্মকর্মসংস্থানমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন এখন সময়ের দাবী। বাংলা ভাষার উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারি। শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবভিত্তিক অবদান প্রতিষ্ঠা করতে গবেষণার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তবেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সোনার মানুষ গড়ে উঠবে।
জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী আমাদের জীবদ্দশায় পেয়েছি বলে নিজেদেরকে ভাগ্যবান মনে করছি। আগামী একশো বছরে আমরা থাকবো না। দেশ নিশ্চই জাতির জনকের আদর্শ ও নীতির আলোকে অনেক এগিয়ে যাবে। এখন পদ্মা সেতু হয়েছে। তখন হয়তো সন্দ্বীপেও সেতু স্থাপনের মাধ্যমে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে সামুদ্রিক বন্দর। হবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। জনান্তিকে জানা যায়, এই সন্দ্বীপ প্রাকৃতিক গ্যাসের উপর ভাসছে। তখন হয়তো এই গ্যাস উত্তোলিত হবে । জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন ব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত হবে।
জাতির জন্য তাই ১৭ই মার্চ শুধু একটি দিনই নয়, বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিবস। এই দিবসের ফলেই আমরা একটি জাতিরাষ্ট্র বিপ্লবের চে গুয়েভারাকে পেয়েছি। একজন বিশ্বনেতাকে পেয়েছি। এই বাংলার হাইলি সালাসাকে পেয়েছি। এই বাংলায় আরেকজন কুয়ামে এনকুমার জন্ম হয়েছিলো। উহুরু কেনিয়াত্তার জন্ম হয়েছিলো। জাতির তিমির তিমির বিনাশে যিনি নিজের জীবনকেই ক্রুশবিদ্ধ করতে দ্বিধাহীন ছিলেন। জীবন দিয়েই তিনি তা প্রমাণ করেছেন। পিতা তোমারে শতবার সেলাম আরেকবার এবং পুনর্বার ।