আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    আমার চোখে বাবা ঃ মহুয়া কর, ত্রিপুরা

    আরশি কথা

    ইংরেজিতে ১৬ জুন এবং বাংলায় আষাঢ়ের প্রথম দিনটিতে বাবার জন্মদিন। এবছর দুটোই একসাথে মিলে গেল। বাবা মানে একাধারে সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক মৃণাল কান্তি কর। রাজ্যের নিপীড়িত, বঞ্চিত,শোষিতদের জন্য যিনি আজীবন কলম ধরে গেছেন। একজন আদর্শবান, আপোষহীন, আত্মপ্রচারহীন, স্পষ্টবক্তা, নিরহংকারী এবং সর্বোপরি এই বড় মাপের মানুষটাকে বাবা হিসেবে পেয়ে আমি গর্বিত। রাজ্য এবং বহিঃরাজ্যে নানা খ্যাতি ও সন্মান তিনি পেয়েছেন। অথচ আত্মপ্রচারের লিপ্সা তাঁর মধ্যে কোনদিনই প্রকট হয়নি।সমাজের বৃহদাংশ যখন নিজের পিঠ নিজেই চাপড়াতে ব্যস্ত, তখন তার ঠিক উল্টো স্রোতে গা ভাসিয়েছিলেন তিনি। আপামর জনতার ভালোবাসায় সিক্ত বাবা সকলের মাঝে থেকে, সকলের হয়ে কথা বলতেই ভালবাসতেন। কুমিল্লা ইশ্বর পাঠশালা, পরবর্তীতে রাজ্যের বনেদি উমাকান্ত স্কুল এবং এমবিবি কলেজের ছাত্র ছিলেন বাবা। স্কুল ফাইনালে প্রথম স্থানাধিকারী, মেধাবী ছাত্র বাবা ক্রীড়াঙ্গনেও সমান আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। একসময় ফুটবল, হকি এবং ক্রিকেটের মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। ত্রিপুরা ক্রিকেট এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর প্রবীণ ক্রিকেটারদের যে সম্মাননা প্রদান করা হয়, সেটা বাবা এবং ননী কর্তাসহ আরো তিনজন ক্রিকেটারদের সম্মাননা দিয়েই প্রথম শুরু হয়েছিল।
    বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও বাংলা এবং ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য।রবীন্দ্র-নজরুল সহ বিভিন্ন লেখকের পাঠ্যাংশ এবং কবিতা অনর্গল পাঠ করে যেতেন। কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ক্রীড়াজগৎসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে আধিপত্য ছিল বলেই হয়তো সহজেই যেকোন বিষয় নিয়ে স্বাচ্ছন্দে কলম ধরতে পারতেন। আমার সম্পাদনায় 'অমৃত বিন্দু' বইটিতে বাবার লেখা কবিতা, প্রবন্ধসহ সম্পাদকীয়গুলো তারই সাক্ষ্য বহন করে। বাবার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা সীমান্ত প্রকাশ একসময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। পরবর্তীতে দৈনিক সংবাদের ইতিহাস কারোর অজানা নয়। একসময় আমাদের বাড়িতে প্রতি সন্ধ্যায় শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষদেরও দেখেছি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চায়ের কাপে ঝড় তুলতে। বন্ধুবৎসল, সদালাপী, ভোগ-বিলাসহীন, আড়ম্বরশূন্য সহজ সরল জীবন কাটানো বাবা রোগের প্রকোপে ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে লাগলেন। রক্তচাপের প্রাবল্য এবং রক্তে চিনির আধিক্যের কারণে সৃষ্ট নানা রোগব্যাধি বাবার আয়ুকে সীমিত করে ফেলল। ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি থমকে গেল বহুমুখী প্রতিভাধর এই ব্যক্তিত্বের পথ চলা। বাবা স্বর্গত হবার পর কত লোক এলেন, আমাদের কাছে বসে জানালেন কত ভাবে তারা উপকৃত হয়েছেন। তাদের কৃতজ্ঞতা আন্তরিক। আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্রও দেখেছি। যারা সময়ে-অসময়ে আমাদের বাড়িতে হাজির হতেন নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে, বাবার অসুস্থতার সময় তারা খবর পর্যন্ত নেবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। যাদের বাবা হাতে ধরে সাংবাদিকতা শিখিয়েছিলেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অসুস্থ ঘরবন্দি কিংবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বাবাকে একবার দেখতেও এলেন না। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে সেদিন বাড়িতে ছুটে এসেছিলেন রাজ্যের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, বর্তমান শিক্ষা মন্ত্রী তথা তদানীন্তন বিরোধী দলনেতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে সমাজের সকল স্তরের অসংখ্য মানুষ। অথচ অগণিত মানুষের ভিড়ে সেসব অকৃতজ্ঞদের দেখা গেল না যাদের নিজের সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে উঠে একদিন সাহায্য করেছিলেন, যাদের স্বাবলম্বী হবার সুযোগ করে দিয়েছিলেন বাবা।
    রাজ্যের সংবাদ জগতে স্বর্গত বাবা মৃণাল কান্তি করের অবদান প্রায় সকলেই স্বীকার করেন। প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর সাদাসিধে বাবা সম্বন্ধে লেখা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে,এই স্বল্প পরিসরে হয়তো সম্ভব নয়। তাই আপাতত এখানেই ইতি টানতে হচ্ছে। মনের সব গ্লানি,দু:খ  ভুলে এটাই বলতে চাই,শুভ জন্মদিন বাবা।  আর সৃষ্টিকর্তার কাছে করজোড়ে একটাই প্রার্থনা, পুনর্জন্ম বলে যদি কিছু থেকে থাকে তাহলে প্রতি জন্মে উনাকে-ই যেন বাবা হিসাবে পাই।


    মহুয়া কর

    ত্রিপুরা


    ১৬ই জুন ২০২১
     

    3/related/default