Type Here to Get Search Results !

আজ বাংলা সাহিত্যের কিংবদন্তি শিশুসাহিত্যিক সুকুমার রায় এর ১৩৪ তম জন্মদিনঃ সুস্মিতা এস দেবনাথ, আরশিকথা

"ছিল এ-ভারত এমন দিন

মানুষের মন ছিল স্বাধীন 

সহজ উদার সরল প্রাণে

বিস্ময়ে চাহিত জগত পানে।"

এ অতীত কথা যাঁর তিনি আর কেউ না,বাংলা সাহিত্যের  বিস্ময় সুকুমার রায়। বাংলায় নবজাগরণের স্বর্ণযুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন কলকাতার এক দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ বংশীয় ব্রাহ্ম পরিবারে। পিতা ছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যক উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী আর মা বিধুমুখী দেবী ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে। তারা ছিলেন ছয় ভাইবোন। পিতার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের মতো বিশিষ্ট সাহিত্যিক বিজ্ঞানী ব্যক্তিত্বগণ। একটি সুন্দর সাহিত্য অনুরাগী পরিবেশের মধ্যে  সুকুমার রায় বড় হয়ে ওঠেন যা তার মধ্যেকার সাহিত্যিক প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করে। শুধু সুকুমার রায়ের মধ্যে নয়,তাঁর সব ভাই বোনের মধ্যেই আশ্চর্য সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। সুকুমার রায়ের মহান সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পেছনে তার পরিবারের অবদান অনস্বীকার্য। পরিবার ও পারিপাশ্বিক পরিবেশ সহযোগিতা করেছিল বলেই আমরা পেয়েছিলাম   বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুকুমার রায়কে। যিনি ছিলেন একাধারে লেখক, ছড়াকার, শিশুসাহিত্যিক, রম্যরচনাকার, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার ও সম্পাদক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক।

পড়াশোনায় মেধাবী সুকুমার ছোটবেলা থেকেই ভাই-বোনদের নেতৃত্ব দিতেন, গান ও মজাদার ছড়ায় বাড়ির সবাইকে মাতিয়ে তুলতেন। তার মুখে প্রায়ই শোনা যেত ছোট ছোট ছড়াও গান, যা তিনি তৎক্ষনাৎ পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী রচনা করতে পারতেন। সুকুমার রায়ের বোন  পুণ্যলতাদেবী   সুকুমারের ছোটবেলার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন,

 – “দাদা যেমন আমাদের খেলাধুলা ও সব কিছুরই পাণ্ডা ছিল, তেমনি বন্ধুবান্ধব ও সহপাঠীদের মধ্যেও সে সর্দার হল। ...... তার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল যার জন্য সবাই তাকে বেশ মানত। ...... বড়রাও তার কথার বেশ মূল্য দিতেন।” 


খুড়তুতো বোন লীলা মজুমদার লিখেছেন তার ‘বড়দা’ সুকুমারের কথা – “চেহারার মধ্যে কি যেন একটা ছিল, যা তার সর্বাঙ্গ থেকে আলোর মত ঝড়ে পড়ত।”     

সুকুমার রায়  নামটির সাথে সাথে ভেসে উঠে আমাদের ছোটবেলায় পড়া বা শোনা কিছু জনপ্রিয় ছড়ার লাইন যেমন,

"আয়রে ভোলা খেয়াল খোলা 

স্বপনদোলা নাচিয়ে আয় "

"শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে

 তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে"। 

"বাবুরাম সাপুড়ে 

কোথা যাস বাপুরে "

"(যদি) কুমড়ো পটাশ নাচে-

 খবরদার এসো না কেউ আস্তাবলের কাছে।"

" গালভরা হাসিমুখে চালভাজা মুড়ি

 ঝুরঝুরে প'ড়ো  ঘরে থুর্ থুরে বুড়ী"


এইরকম অসংখ্য ছড়া আমাদের মুখে মুখে ছিল ছোটবেলায়। তাছাড়া  আরো একটা মজার ছড়া সহযোগে একটা খেলা আমরা খেলতাম সেটা হল,

 "ইকড়ি মিকড়ি চাম চিকড়ি

 চাম কাটে মজুমদার

ধেয়ে এল দামোদর

 দামোদর ছুতোরের পো

হিঙ্গল গাছে বেঁধে থো।" 

অথচ এই অদ্ভূত মজার ছড়াটি যে সুকুমার রায়ের  লেখা তা জানতামই না। 

সুকুমার রায়  আজীবন রবীন্দ্র সাহচর্যে বড় হয়েছেন। শিশুতোষ ছড়ার ক্ষেত্রে তিনি আবার রবীন্দ্রনাথকে ও প্রভাবিত করেছিলেন। দুইজনের কবিমন দুই রকমের তবু বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায়ের বিশাল প্রাপ্তি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সান্নিধ্য। সুকুমার রায়ের ডাকনাম ছিল তাতা আর এই নামটি  রবি ঠাকুরেরই  দেওয়া। যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'রাজর্ষি' উপন্যাসেও আমরা দেখতে পাই 'হাসিও তাতা 'নামক দুটি চরিত্রের মধ্যে ।

শিবনাথ শাস্ত্রী সম্পাদিত শিশুদের জন্য প্রকাশিত পত্রিকা "মুকুল"এ ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে মাত্র আট বছর বয়সে প্রথম 'নদী' নামে একটি কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল সুকুমার রায়ের। তারপর বাবা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী সম্পাদিত ছোটদের জন্য মাসিক পত্রিকা 'সন্দেশ'এ নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। তাঁর ছড়াও লেখায় যেমন হাসি মজা ব্যঙ্গ ছিল প্রকট,  ঠিক তেমনি ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কৌতুকপ্রিয়। যেকোনো আসর তিনি মজলিসী ঢং এ পাঠককে জমিয়ে রাখতেন। তাঁর অবিমিশ্য হাস্যরসের ধারায় সমগ্র বাংলা সাহিত্যের শিশু থেকে বৃদ্ধ- আজও মজে আছে । রবীন্দ্রনাথের মত ব্যক্তি ও তাঁর হাস্যরসের ধারায় বিদ্ধ হয়েছিলেন। 'পাগলা দাশু'র প্রথম সংস্করণে তিনি  বলেছিলেন, "সুকুমারের লেখনি থেকে যে অবিমিশ্য হাস্যরসের উৎসধারা বাংলা সাহিত্যিকে অভিষিক্ত করেছে তা অতুলনীয়।"

ইংল্যান্ডে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য প্রতিভাকে শিক্ষিত সমাজের কাছে পরিচয়ের প্রচেষ্টা সুকুমার রায় করেছিলেন "দ্য স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ" নামের একটি প্রবন্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯১১সালে মুদ্রণশিল্পে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন আর ১৯১২সালে গিয়েছিলেন রবি ঠাকুর, ১৯১৩ সালে  নোবেল পুরস্কার পেলে একসাথে আবার দুজনে ফিরে আসেন নিজের দেশে। 

দেশে ফিরেই বাবার পত্রিকা 'সন্দেশ' এ উদ্ভট সব জীবজন্তু, জানোয়ারের নাম দিয়ে ছড়া ও ছবির সাথে প্রকাশ করতেন। তাঁর সেই সব মজার ছড়া ও ছবিতে ভরা 'সন্দেশ' পত্রিকা পড়ার জন্য ছোট পাঠকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি লেগে যেত। ঠাকুরমার ঝুলি, ভূত প্রেত রাক্ষস, রাজা রাণী ছাড়াও যে শিশুদের একটি সুন্দর মজার জগত আছে তা সুকুমার রায়ের ছড়া পড়েই শিশুরা বুঝতে- জানতে পেরেছিল। 

নীতি উপদেশমূলক  কবিতার বাইরেও যে একটা সুন্দর স্বাধীন মজার ভাবনার জগৎ আছে তা শিশুরা সুকুমার রায়ের ছড়া পড়েই আবিষ্কার করেছিল। সুকুমার রায়ের শিশুসাহিত্য কল্পনার উড়ানে শিশুদের নিয়ে যায়। 

আধুকিতার এই যুগে আমাদের শিশুদের শৈশব বলে কিছু থাকছে না। ভালো রেজাল্ট আর শিক্ষিত- এই দুই তকমা লাগানোর জন্য প্রতিটি অভিভাবকই এখন হন্যে প্রায়। হারিয়ে গেছে শিশুদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো।

জন্মের সাথে সাথে আমরা প্রত্যেকটি শিশুর ভবিষ্যত নিয়ে এত চিন্তিত যে তাদের পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কিছু বই পড়তেই দেই না। প্রয়োজনে   একটি ভালো বই এর পরিবর্তে তুলে দিচ্ছি স্মার্টফোন বা ট্যাব। অথচ আমরা ইচ্ছা করলেই আমাদের শিশুদের দিতে পারি সৃজনাত্বক বিকাশ কল্পনাপ্রবনতা, হাসি ঠাট্টায় ভরা একটা সুন্দর সোনালী শৈশব। আর সুকুমার রায়ের সাহিত্যছড়া, হাসির গল্প আমাদের শিশুদের সাহায্য করবে ।

সুকুমার রায় আজ থেকে প্রায় শতবছর আগে শিশুদের ভালো থাকার রসদ যা লিখে গিয়েছেন তা এককথায় অপূর্ব, অসাধারণ। স্বল্প সময়ের জন্য তিনি আসলেও পৃথিবীতে, যা রচনা করে গিয়েছেন তার জন্য তিনি সর্বদা আমাদের মতো প্রত্যেক বাঙালী পাঠকদের কাছে চিরদিনই আদর্শ হয়েই থাকবেন।

সুকুমার রায়ের অনেক কবিতা, বা নাটকে উল্লেখিত আছে বিদ্যালয়গুলো পীড়নের স্থল, শিক্ষকরা ফাঁকিবাজ ও উৎপীড়ক এবং ছাত্ররা অসহায়। প্রকৃত শিক্ষা থেকে তারা বঞ্চিত, তাদের অবস্থান বহুদূর। সুকুমার রায়ের তিরোধানের এত বছর বাদে ও স্বাধীনতা লাভের পর এতগুলো শিক্ষা কমিশন হয়ে গেলেও শিক্ষার পরিবেশ কি তেমন কিছু পাল্টেছে? এখনো আমরা ঘটিরাম ও কেষ্টার প্রকৃত সমস্যা অনুধাবন করতে পারিনি, কেন তারা পাঠ বিমুখ হয়েছিল তার উৎস সন্ধান করে উঠতে পারিনি। বিরস শিক্ষার বিষয় শিক্ষার্থীকে পাঠ এর প্রতি আগ্রহী করতে পারে না। এই বিষয়টি সুকুমার রায় কে বারবার পীড়িত করতো। তারই প্রকাশ দেখা যায় 'চিনে পটকা', 'গোরুর বুদ্ধি', 'বুদ্ধিমান শিষ্য' প্রভৃতি গল্পে এবং 'বুঝিয়ে বলা', 'বিজ্ঞান শিক্ষা' 'নোট বই' প্রভৃতি কবিতায়। এসব কারণেই সুকুমার রায় সবসময়ই আধুনিক। যত সময় যাচ্ছে, বাড়ছে জীবনের জটিলতা, ততই যেন সুকুমার রায়, ততই যেন হিং টিং ছট। তাই তার লেখা ছড়ার লাইনগুলো আজ প্রবচনে পরিণত হয়েছে। প্রাত্যহিক জীবনের সাথে কতটা জড়িয়ে গেলে একজন লেখক হয়ে উঠতে পারেন প্রবচনের আধার সুকুমার রায় যেন তারই জ্বলন্ত উদাহরণ।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, এমন একজন হাস্যরসাত্মক কবি মাত্র ৩৬ বছরই বেঁচে ছিলেন। তিনি তাঁর জীবৎকালে নিজের কোন বইয়ের প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। রোগশয্যায় 'আবোল তাবোল' বইটির জন্য একটি ভূমিকা লিখেছিলেন মাত্র। সেখানে লিখেছিলেন, 'যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই।'

বাঙালির জীবনের সাথে জড়িয়ে থাকা সুকুমার রায় এর আজ ১৩৪ তম জন্মদিনে আরশিকথা তারই কথায়-

'আয়রে খ্যাপা মন ঘুচিয়ে বাদন

        জাগিয়ে নাচন তাধিন ধিন

আয় বেয়ারা সৃষ্টিছাড়া

       নিয়মহারা হিসাবহীন।"


সুস্মিতা এস দেবনাথ

আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম


আরশিকথা হাইলাইটস

৩০শে অক্টোবর ২০২১

 

إرسال تعليق

1 تعليقات
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.
  1. শিশু সাহিত্যিক সুকুমার রায় -কে নিয়ে সুস্মিতা এস দেবনাথ - এর লেখা পাঠ করে খুব সমৃদ্ধ হলাম। সুন্দর উপস্থাপনায় শিশু সাহিত্যিকের জন্মদিনে সুন্দর শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ। চমৎকার লেখা।

    ردحذف