Type Here to Get Search Results !

আমাদের শিশুরা কেমন আছে.... সুস্মিতা এস দেবনাথ, আরশিকথা

শিশু শব্দটির সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে নিস্পাপ, কোমল দুষ্ট মিষ্টি একটা ছবি।শরীর,আকৃতি সব মিলিয়ে ছোটখাটো একটা প্রাণবন্ত ছবি। আর যদি বইয়ের ভাষায় বলি, তাহলে শিশুহল তারা যারা এখনও যৌবনে প্রবেশ করে নি, সে শিশু হিসেবে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে চিহ্নিত  সচরাচর যে ছেলে বা মেয়ের বয়স চৌদ্দবছরের নিচে অবস্থান করছে সে শিশু হিসাবে চিহ্নিত। 

জীববিজ্ঞানের ভাষায় মনুষ্য সন্তানের জন্ম এবং বয়ঃসন্ধির মধ্যবর্তী পযার্য়ের রূপ হচ্ছে শিশু।

"ফুটন্ত কলির মত শিশু মনোরম তার চেয়ে বেশী কিছু আছে কি মনোরম?" আকরম হোসেনের মত আমরা ও বলতে পারি এই পৃথিবীতে শিশুর চেয়ে সুন্দর নির্মল আর কিছুই নেই। এই শিশুরা হল অফুরন্ত সম্ভাবনাময় মানবসত্ত্বা। আর এই মানবসত্ত্বাকে আমাদের অত্যন্ত যত্ন,  দায়িত্ব ও ভালোবাসা পরিচর্যার মধ্যে দিয়ে বড় করে তুলতে হয়। এইজন্যই ফ্রয়েবল বলেছেন, শিশুরূপী চারাগাছকে বাগানের মালির মতো শিক্ষকরা যত্নের সহিত ধীরে ধীরে  মানুষ করে তুলবেন। জন্মের সময় মানবশিশুর ভেতর যে সব সম্ভাবনা থাকে, সেগুলো শিক্ষার মধ্যে দিয়ে বিকশিত করতে সহায়তা করতে হয়।আমরা জানি, মানুষ জন্ম মূহুর্ত থেকে শেখে এবং যত বড় হতে থাকে তত সে তার পরিবেশের সঙ্গে প্রতিনিয়ত অভিযোজন করে চলে।

আজ আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, আমাদের শিশুরা আজ একদম ভালো নেই। তাদের জীবন থেকে আমরা কেড়ে নিয়েছি তাদের হাসি খুশি সোনাঝরা শৈশব, কেড়ে নিয়েছি খেলার মাঠ, গোল্লাছুট,  লুকোচুরি, বন্ধু, সহপাঠীর সুখ দুঃখ ভাগ করে নেবার মানসিকতা। দাদু ঠাম্মার সাথে গল্প বলার মূহুর্ত, পরিবর্তে তুলে দিচ্ছি ট্যাব, মোবাইল আর ভারী ভারী পাঠ্যপুস্তকের বোঝা। পরিবারের সাথে সময় কাটানোর পরিবর্তে সেই সময় আমরা শিশুদের নিয়ে যোগার ক্লাস, আবৃত্তির ক্লাস, নৃত্যের ক্লাস, চিত্রাঙ্কণ, আরো কত কি ক্লাসে  পারদর্শী করে তুলতে ব্যস্ত থাকি। ফলে শিশুরা হারিয়ে ফেলছে তাদের সুনিপুণ স্বকীয়তার অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অসীম সম্ভাবনার অফুরন্ত উৎস।

শিশুদের জন্য উপযোগী এবং সঠিক জীবন চর্চাই হচ্ছে না। এখন আমাদের পরিবারগুলোতে শ্রদ্ধা, স্নেহ-মমতা, সহিষ্ণুতা ও শর্তহীন ভালোবাসার চর্চা নেই। সবাই স্বার্থপরের মতো নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। কথা হচ্ছে, শিশুদের শিক্ষাদানের নাম করে তাদের জীবন থেকে নির্মল শৈশবের আনন্দমুখরতা কেড়ে নিয়ে আমরা আসলে কেমন প্রজন্ম গড়ে তুলতে চাইছি?সত্যি বলেছিলেন,শিল্পী স্টেসিয়া টসচার--

""একটি শিশু আগামীকাল কী হবে আমরা তা নিয়ে উদ্বিগ্ন, অথচ আমরা ভুলে যাই সে আজকেও কেউ একজন”

আমরা আমাদের অজান্তেই শিশুদের , একরকম শ্রমিক বানিয়ে ফেলছি। আর এর ফলে তাদের সুকুমার প্রবৃত্তিগুলো হারিয়ে তারা হয়ে উঠছে আত্মকেন্দ্রিক,  অসামাজিক, স্বার্থপর।

 মানি আর না মানি  সময় আর বইয়ের বোঝা কেড়ে নিয়েছে শিশুদের  শৈশবের হাসিখুশি দিনগুলো।আজ শিরদাঁড়া সোজা করে তারা দাঁড়াতে পারে না  বইয়ের ব্যাগের জন্য। মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য কোচিং সেন্টার, নার্সারি স্কুল তাদের মা বাবা পরিবারের সাথে কাটানো সময়গুলো কেড়ে নিয়েছে। এ যেন বর্ণে গন্ধে ঝলমল করা প্রস্ফুটিত ফুলকে বৃন্ত থেকে জোর করে ছিড়ে ফেলা।পড়ালেখা আর পরীক্ষার চাপে বাচ্চাদের মানসিক বৃদ্ধি হচ্ছে না।

অনুপযোগী বয়সে প্রাথমিক শিক্ষা জীবন থেকেই বাচ্চাদের ওপর অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষার চাপ দিয়ে ব্যস্ত রাখা হয় পুরো শিক্ষাজীবন। এসব চাপে পড়ে শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিশুদের জীবন থেকে। ফলে বড় হলেও তাদের মাঝে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ বিকশিত হচ্ছে না।

 শিশুর এই স্বাভাবিক বিকাশের ধারাকে অবদমিত করা একদমই ঠিক না।শিশু মাত্রই চায় হাসিতে-খুশিতে, আনন্দে-আবেগে, খেলাতে-ছোটাতে ভেসে যেতে। তাদের চোখে থাকে অনন্ত জিজ্ঞাসা,মনে থাকে কৌতূহল। 

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, "ছোট ছোট হাসিমুখ জানে না ধরার দুখ

হেসে আসে তোমাদের দ্বারে

নবীন নয়ন তুলে কৌতুকতে দুলিদুলি

চেয়ে চেয়ে দেখে চারিধারে।"

 আমরা জানি, একটি শিশু যখন বড় হয়, তখন চারদিকের পরিবেশ তাকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে এবং এর প্রতিফলন ঘটে তার ব্যক্তিত্বে। শিশুর সামগ্রিক বিকাশের সঙ্গে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতা নিবিড়ভাবে জড়িত।পরিবারই শিশু শিক্ষার প্রাথমিক দায়িত্ব গ্রহন করে।আর পরিবারে শিশুর আচরণ, তার চাহিদা, ভালোলাগা,মন্দলাগাকে প্রভাবিত করে মা ই প্রথম। শিশু মাকে দেখেই শিখে।

মায়ের মুখ থেকেও মাকে অনুসরণ করেই শিশুর আচার আচরণ গড়ে উঠে। মায়ের সাথে সাথে পরিবারের বাকি সদস্যদের সাথে মেলামেশা ও চলাফেরার মধ্যে দিয়ে আবেগ অনুভূতি প্রবৃত্তি, প্রক্ষোভ প্রভৃতির মাধ্যমে শিশুর মধ্য ব্যক্তিসত্তা গড়ে উঠে।

শিক্ষাবিদ রাসেল বলেছেন, পরিবার শিশুশিক্ষার বাহক হলেও বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় আধুনিক ঘরগুলোর অবিন্যস্ত পরিবেশের দ্বারা শিশুআচরণ ধারায় কাম্য ও বাঞ্ছিত পরিবর্তন ও পরিমার্জনা  আনা কখনও সম্ভব নয়।আর সেই জন্যই ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে পরিবারের বিকল্প হিসাবেই সমাজের প্রয়োজনে ও পরামর্শে বিদ্যালয় শিশুশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করা হয়।"

শিশুরা নানাভাবেই বিকৃত মানসিকতার শিকার হয় এবং মোবাইল গেম , ভিডিও গেমে আসক্তি , অসামাজিক ভাবনা , নেশার প্রতি আসক্তি ইত্যাদির কবলে পরে যায়। এসব অনেক সময় বাইরের থেকে শিশুকে দেখে বোঝা যায় না। কিংবা বোঝা গেলেও অনেকেই বিশেষ আমল দেন না। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার যেমন শরীরকে সুস্থ রাখে তেমনি উপযুক্ত পারিবারিক পরিবেশ -ই শিশুর মানসিক গঠনকে সুন্দর করে তোলে। সুস্থ শিশুই একজন সুখী শিশু।

যাইহোক, আমাদের মানতেই হবে, সমাজের যা কিছু সুন্দর, কল্যানকর ও মঙ্গলময় তাকে পেতে হলে প্রত্যেক শিশুকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে এবং কাম্য ও বাঞ্ছিত  আচরণধারা প্রদর্শন করে জীবনকে লক্ষ্যভিত্তিক  

 সর্বোত্তম রূপে ও সম্পূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে হবে। আর এই ভবিষ্যৎ নাগরিক কে যদি উপযুক্ত শিক্ষা দিতে না পারি তাহলে সমাজ হয়ে পড়বে পঙ্গু। 

আজকের শিশু আগামীর প্রস্ফুটিত ফুল। তাই তার সুন্দর ও নির্ভয় শৈশব নিশ্চিত করার দায়িত্ব মা–বাবা সহ পরিবারের সব সদস্যের।

যেহেতু পরিবারই শিশুর শিক্ষার প্রথম ধাপ তাই পরিবারের প্রত্যেক সদস্য খেয়াল রাখবেন শিশু যাতে সুন্দর পরিবেশে বড় হয়ে উঠতে পারে।কোন রকম বিশৃঙ্খল পরিবেশের মধ্যে যেন শিশুর শৈশব  ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টারের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টরা বলেন, ‘পারিবারিক নির্যাতন দেখে বেড়ে ওঠা শিশুরা এমন ধারণা নিয়ে বেড়ে ওঠে যে অন্যকে আঘাত করা খুব স্বাভাবিক ঘটনা আবার সেও অন্যের কাছ থেকে আঘাত পেতে পারে। তাই বয়ঃসন্ধিকাল থেকেই তাদের নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।’

বর্তমান যুগে পরিস্থিতি অনেক সময় এমন হয়ে যায় যে মা-বাবা দুজনকেই জীবিকার জন্য কাজে বের হতে হয়। ফলে শিশুকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় তাঁদের থাকে না। অনেকেই নির্ভর করেন কাজের মানুষের ওপর। এ জন্য যতটুকু সময়ই তাঁরা শিশুর কাছে থাকতে পারেন, সে সময়টাকে মানসম্মত করে তুলতে পারলে সেটা শিশুর বিকাশে অনেক অবদান রাখতে পারে।

যাইহোক, শিশুদের  প্রাণোচ্ছল হাসিতে আমাদের পৃথিবী ভরে থাকুক, একটা শিশুর শৈশবও যেন না হারিয়ে যায় গভীর পঙ্কিলতায়, তা দেখার দায়িত্বও যে আমাদের। সবশেষে রাস্কিনের সাথে বলবো, "একটা শিশুকে দাও যদি সামান্য একটুখানি ভালোবাসা,তোমাকে সে ফিরিয়ে দিবে অনেকখানি।"

পৃথিবীর সকল শিশুরা ভালো থাকুক,নিরাপদে থাকুক এটাই হোক শিশু দিবসে আমাদের সকলের প্রার্থনা।


সুস্মিতা এস দেবনাথ 

আরশিকথা গ্লোবাল ফোরাম


ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট

১৪ই নভেম্বর ২০২১

 

إرسال تعليق

0 تعليقات
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.