বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী। তিনি আরও বহু নামে পুরাণে সুপরিচিত। যেমন ভারতী, বিলভানি, জ্ঞানেশ্বরী,জ্ঞানদা,ভগদেবী,নিহারিকা ইত্যাদি। বিদ্যা ও সঙ্গীতের দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে কেন্দ্র করে অনুষ্ঠিত একটি অন্যতম হিন্দু উৎসব হল সরস্বতী পুজো । মাঘ মাসে গৃহস্থের ঘরে এবং পড়ুয়ারা স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একদিনের জন্য বাগদেবীর আরাধনায় মগ্ন হয়।সারাবছর ধরে ছাত্র ছাত্রীরাএই বিশেষ দিনটির জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে। দুই তিনদিন ধরে পূজার প্রাক্ প্রস্তুতি পর্ব চলতে থাকে।
পূজোর জায়গা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা,ধান সরিয়ে খই আলাদা করা, প্রতিমা আনয়ন, বিভিন্ন স্কুলে নিমন্ত্রন করা, পূজোর বাজার করা আরও কত কি! মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীর মিষ্টি সকালে আমরাও রঙ বেরঙের শাড়ি পড়ে ছোটোবেলায় বিদ্যালয়মুখী হতাম। ছোটো ছোটো মেয়েদেরও দেখা যেত শাড়ি পরিধান করতে। দেখে মনে হত কিছু রঙিন প্রজাপতি যেন উড়ছে এদিকে ওদিকে । একদিকে শাড়ির কুচি, আর একদিকে আঁচল সামলিয়ে এই রঙিন প্রজাপতির দল যখন প্রসাদের লাইনে ঠেলাঠেলি শুরু করত -- সে এক দৃশ্যই হত বটে। সন্ধ্যায় হতো ধুনুচি নিয়ে আরতি আর মনমাতানো ঢাকের বাদ্যের প্রতিযোগিতা । ছোটো ক্লাসের ভাই বোন, বড়ো ক্লাসের দাদা দিদিরা -- সবাই মিলে শুরু হত ধুনুচি নাচ। আকাশে বাতাসে যেন প্রতিধ্বনিত হত "নব আনন্দে জাগো " বা আনন্দে ধারা ধুইয়ে দাও" ।
সেই ঐতিহ্য আজও বিদ্যমান। এখনও গৃহীদের ঘরে ঘরে এবং প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই দেবীর আরাধনা খুব ঘটা করে অত্যন্ত জাঁকজমক সহকারেই পালন করা হয়। আগের মতই পঞ্জিকার তিথি অনুসারে উচ্চারণ করা হয় মন্ত্র। পুজো করা হয় প্রতি বছর যাতে অংশগ্রহণ করে আনন্দে মেতে ওঠে শিক্ষার্থীরা। প্রসাদ নেয়,আরতি উপভোগ করে। সবই হয়। কিন্তু তার মধ্যেও যেন একটু অন্য মাত্রা চোখে পড়ে। সত্যিই কি সব আগের মতো আছে? না কি উৎসাহ উদ্দীপনার রেখাচিত্র টি পাল্টে গেছে ? এই প্রশ্ন মনের মধ্যে তোলপাড় করে আর ইচ্ছা করে উত্তর জানতে। সেইসাথে সকলকে জানাতে ইচ্ছাশক্তি প্রবল হয়ে ওঠে। এটাই খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রশ্নের সঠিক বাস্তব জীবনমথিত উত্তর বোধহয় খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। তাহলে এই দুরূহ দুর্বোধ্য প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি।
আগের আনন্দের নির্মল ধারায় হয়তো বা একটু ভাঁটা পড়েছে আজ। আবার অন্যভাবে বলা যায় যে -- সব কিছুই পুরাতন ঐতিহ্য মেনেই হচ্ছে তবে আনন্দের প্রকাশভঙ্গীতে যেন একটু অন্য মাত্রা যোগ হয়েছে। ক্রমশ তা প্রকট থেকে প্রকটতর হতে চলেছে। এটা অবশ্যই দুর্ভাবনার বিষয় তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
আগে যেখানে মা সরস্বতীর আরাধনায়, অন্জলী প্রদানে ব্যাস্ত থাকত ছোটো ক্লাসের ছেলেমেয়ে থেকে শুরু করে বড়ো ক্লাসের কিশোর কিশোরীরাও, পূজোর নৈবদ্য সাজানোতে সুযোগ পাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত উঁচু ক্লাসের মেয়েরা আর এই কাজের মধ্যেই উপভোগ করত আনন্দ, পেত উৎসাহ --- আজ যেন সেই কাজ গুলোই হয়ে গেছে গৌণ। মুখ্য হয়ে উঠেছে আলোকসজ্জা, তারস্বরে মাইক্রোফোনের গান, আর নিজের দৈহিক সাজসজ্জা।
বাগদেবীর বন্দনায় এই সময়ে এক নতুন মাত্রার সংযোজন হয়েছে। এই দিনে শিক্ষার্থীরা ভ্যালেনটাইন্স ডে খুব ধূমধাম করে উদযাপন করছে। এই বিশেষ ভালোবাসার দিনে নিজের প্রিয় বন্ধুকে গোলাপ ও সঙ্গ দিতে কিছু পড়ুয়ারা অতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। একেই দিনে দুটো অনুষ্ঠান সমান্তরালে চলার ফলে পুজোর আনন্দের গভীরতা,জৌলুস,চাকচিক্য খুব ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করেছে।
মনে হয় এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য শিক্ষক, অধ্যাপক আর অভিভাবকদের সমবেত প্রয়াস জারি রেখে পুজোর আনন্দ স্রোতে অবগাহন করতে পড়ুয়াদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানমুখী রাখা বিশেষ প্রয়োজন। একথা বলা অযৌক্তিক হবে না যে সমাজের সর্বস্তরের জনগণকে সংযুক্ত করে দেবী সরস্বতীর আরাধনাকে আরও ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে উৎসবে রূপান্তর করাটাই যেন আজ সময়ের দাবি।
ড. বীথিকা চৌধুরী, ত্রিপুরা
আরশিকথা অতিথি কলাম
৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২