সামনে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা। হঠাৎ শোনা গেলো করোনা নামক কি একটি ভাইরাস সারা বিশ্বকে গ্রাস করে ফেলছে। ইউরোপ, আমেরিকা, চীন সবখানে ভয়ে মানুষ ঘরে বন্দী হয়ে যাচ্ছে। আবীর একটি প্রাইভেট স্কুলে পড়ে। আবীর ক্লাসে সবসময় পাঁচের মধ্যে থাকে। কোনোদিন স্কুল বন্ধ করে নি। রোজ টিউশন যায়। শিক্ষক শিক্ষিকারাও ভীষণ ভালোবাসতেন আবীরকে। আবীর পড়তে পড়তে ভাবলো পরীক্ষা টা পিছিয়ে গেলে ভালোই হতো, আরো ভালো করে পড়ে পরীক্ষা দিতে পারতো। হঠাৎ আবীরের মন খুশীতে ভরে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে মা কে বললো " মা, সব পরীক্ষা বন্ধ, স্কুল, কলেজ সব বন্ধ। কি মজা! পরীক্ষা হবে না। অনেক টা সময় পাওয়া যাবে। এবার দেখবে ঠিক বোর্ডে ভালো রেজাল্ট করবো।" মা বললো, " করতে তো পারবে যদি পড়াটা আগের মতো চালিয়ে যাও " ।
পরের দিন টিউশন নেই, স্কুলে যাওয়ার তাড়া নেই, পরীক্ষা কবে হবে তাও ঠিক নেই, তাই মা ডেকে গেলেও উঠছে না আবীর। মার অনেক ডাকাডাকিতে ঘুম থেকে উঠতে হলো। পড়ার টেবিলের সামনে বসে আবীর ভাবলো, " কি পড়বো? কেন পড়বো? এখন পড়লে তো পরীক্ষা আসতে আসতে সব ভুলে যাবো। আবীর ঠিক করলো যখন পরীক্ষার রুটিন দেবে তখন পড়া শুরু করবো।" আবীর সকালে উঠে দাবা খেলতে বসে গেলো। এইভাবে খেলেই যাচ্ছে, এমনসময় মা দৌড়ে এসে বললো, " কি রে, খেলছিস যে বড়ো? তোর বন্ধু ফোন করেছে। তোদের নাকি অনলাইন ক্লাস হবে। গুগল ডাউনলোড করতে হবে। " আবীর এই প্রথমবারের মতো হাতে মোবাইল পেলো। গুগল ডাউনলোড করলো। সাথে কয়েকটি ভিডিও গেমও ডাউনলোড করে ফেললো। স্যার ঐদিক থেকে পড়াচ্ছেন আর আবীরের মাথায় কিছু ই ঢুকছে না। যে ছেলে স্যারের বাড়িতে গিয়ে বোর্ডে, খাতা কলমে লিখে বুঝতো, সে কি মোবাইলে পড়ে বুঝতে পারবে?? কতো বড়ো বড়ো অঙ্ক মোবাইলে দেখে করে ফেলতে পারবে?? আবীর কিছু ই ধরতে পারছে না। সব বন্ধুরা আছে মোবাইলে, ওরা কি ভাববে?? ওদের বাবা মা ও হয়তো শুনছে, দেখছে পড়া। আবীর যে বুঝতে পারছে না সেজন্য স্যার কে প্রশ্ন করলে সবাই যদি হেসে ওঠে? তাই আবীর কিচ্ছু জিগ্গেস করলো না। চুপ করে ক্লাস দেখতে লাগলো। এইভাবে ঘরে বসে বসে মোবাইলে দেখতে দেখতে ওর আর ভালো লাগছিলো না। যত দিন যেতে লাগলো আবীর আরো পিছিয়ে পড়তে লাগলো। আরো কঠিন হয়ে যেতে লাগলো সব পড়া। অঙ্ক প্রেক্টিস না করতে করতে আরো কঠিন লাগতে শুরু করলো। এইবার আবীর মোবাইলে গেম খেলা শুরু করলো। ক্লাসে জয়েন করে কিন্তু আরেকদিকে খালি গেম খেলতে থাকে। এদিকে চারিদিকে লক ডাউন চলছে। যত দিন যাচ্ছে লক ডাউন বেড়েই যাচ্ছে। আবীরের খুব মজা লাগছে। ও সারাদিন গেম খেলেই কাটিয়ে দেয়।
মা বাবা ভাবছে, ওদের ছেলে সারাদিন বসে পড়ছে। লক ডাউনের জন্য আবীরের বাবার কাজ চলে গেছে। কোনো রোজগারপাতিও নেই। মা একা হাতে সব কাজ করতে লাগলো। অনেক কষ্টে মাষ্টারের বেতন দিতে হচ্ছে জমানো টাকা থেকে। মোবাইলের বিল ভরতে হচ্ছে। ধীরে ধীরে জমানো টাকা সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ছেলের পড়া তো চালিয়ে যেতে হবে।
এইভাবে দেড় দুমাস কেটে গেলো। হঠাৎ জয়েন্ট পরীক্ষার দিন দিয়ে দিলো। আবীরের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। ও সবাইকে বলতে শুরু করলো, " এই সময় পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হচ্ছে না।" ও কয়েকজন বন্ধু বানিয়ে ওদের বাবা মা কে বললো ওরা এখন পরীক্ষা দেবে না। ওদের আরো সময় লাগবে। যেভাবেই হোক পরীক্ষা পিছাতেই হবে। ওদের বাবা মা মিলে কোর্টে পরীক্ষা পিছানোর জন্য আবেদন করলো। আবীর আর ওর বন্ধু রা খুব খুশি হলো। ভাবলো এবার পরীক্ষা পিছালে ওরা ঠিক ঠিক পড়াশোনা করবে। কিন্তু বাবা, মা ও ছেলেরা অনেক চেষ্টা করেও পরীক্ষা পিছাতে পারলো না।
যথারীতি পরীক্ষা হলো কিন্তু আবীর পরীক্ষায় পাশ নম্বর তুলতে পারলো না। আবীর ও তার বাবা মা এর মন খারাপ হয়ে গেলো। আবীরের একটা বছর নষ্ট হয়ে গেলো।
এভাবে যে কতো কতো ছেলে মেয়ের জীবনের স্বপ্ন ভেঙে গেছে এই করোনাকালীন সময়ে। তবে করোনাকালীন সময়ের সুফল ও আছে। অনেক ছেলে মেয়েরা এই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে ওদের টার্গেটে পৌছতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়োরাও টেকনিক্যালি এক্টিভ হয়ে গেছে। যারা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতে জানতো না তারা স্মার্ট হয়ে উঠেছে।
ড:অপর্না গাঙ্গুলী, ত্রিপুরা
আরশিকথা অতিথি কলাম
২১শে জুন ২০২২
"করোনা কালের ছাত্র জীবন" --ড. অপর্না গাঙ্গুলি - র এই প্রতিবেদন ছাত্র সমাজকে মোবাইল পরিসেবা কিভাবে তাদের ব্যক্তি জীবনকে পরিবর্তিত করেছে -- তারই একটা চিত্র -- সুন্দর উপস্থাপনা।
উত্তরমুছুন