Type Here to Get Search Results !

ত্রিপুরার প্রধান মেলা খার্চি উৎসবঃ মনীষা গুপ্ত পাল, ত্রিপুরা

মেলা মানেই মিলন উৎসব ।নানা ধর্ম নানা জাতির মিলন মেলা। আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ত্রিপুরার খয়েরপুরের পুরাতন হাবেলীতে ৭ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী খাচ্ছি মেলা বা উৎসব শুরু হয়। "খার "শব্দটির অর্থ হল "পাপ" এবং "চি" কথার অর্থ হলো "মোচন করা" অর্থাৎ পাপ মোচন করা ।৩০০০ বছর আগে এই পূজার প্রচলন হয়েছিল এবং বর্তমানেও অত্যন্ত নিষ্ঠা ও উৎসাহের সহিত এই পূজা চলছে। ত্রিপুরার ঐতিহাসিক গ্রন্থ রাজমালা অনুসারে জানা যায় অতি প্রাচীনকালে মহারাজা ত্রিলোচন ত্রিপুরায় রাজত্ব করতেন । যে সময় কাল থেকেই ত্রিলোচন চতুর্দশ দেবদেবীর পূজোচনা শুরু করেছিলেন সে সময় থেকেই সমস্ত জাতি উপজাতির কল্যাণার্থে এই খার্চি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। মূলত ত্রিপুরা রাজ পরিবারের এবং সমগ্র ত্রিপুরী জাতির উৎসব হলেও জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহণ করে এই মেলাতে। রাজন্য আমলে শুরু হওয়া এই মেলা উত্তর-পূর্ব ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মেলা।






কথিত আছে একদিন চৌদ্দ দেব-দেবী ভ্রমণে গেলে হঠাৎ করে এক হি;স্র বন্য মহিষ তাদের দিকে ধাবিত হয়ে তাদের আক্রমণের জন্য উদ্যত হলে দেবগণ প্রাণ রক্ষার্থে দৌড়ে পালাতে শুরু করে। শেষ পর্যন্ত একটি গাছের উপর উঠে তাদের প্রাণ বাঁচায়। দেবগন গাছের উপরে থেকে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করতে থাকলে রাজমহিষী হীরাবতী রাজবাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে তার রিয়াটি মহিষের পিঠে বিছিয়ে দিলে মহিষটি নাকি বশীভূত হয়ে যায় রানী মহিষটিকে রাজবাড়িতে নিয়ে আসেন। তারপর একদিন স্বপ্নে রানী সেই চোদ্দ দেব-দেবীকে দেখতে পেলেন এবং দৈববাণী শুনতে পেলেন যে তাদের রাজা ১৪ দেবদেবীকে প্রতিষ্ঠিত করে নিত্যদিন পুজো করলে রাজ্যের কল্যাণ হবে, সেই থেকেই শুরু হলো ১৪ দেবতার পূজো ।




বর্তমান আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে খয়ের পুরে অবস্থিত চতুর্দশ দেবতার মন্দির যা পুরাতন আগরতলা বা পুরাতন হাভেলি নামে পরিচিত ছিল ,এক সময়ে ত্রিপুরার রাজধানী ছিল এই স্থানটি। পরবর্তীকালে রাজারা রাজধানী স্থানান্তর করে বর্তমান আগরতলায় নিয়ে এলেও তাদের কুলো দেবতারা সেখানে রয়ে যায়। বর্তমানে এই মন্দিরের পূজোর সম্পূর্ণ খরচ রাজ্য সরকার বহন করে ।আষাঢ় মাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে এই পুজো বা উৎসব শুরু হয়। ওই দিন ভোরে ১৪ জন দেবতাকে হাওড়া নদীর মন্দির ঘাটে স্নান করিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।



চতুর্দশ দেবতার কোন অবয়ব নেই ।শুধুমাত্র তাদের মুখ পুজো করা হয়। যে চতুর্দশ দেবতা পূজিত হন তারা হলেন হর ,উমা , হরি, লক্ষ্মী ,সরস্বতী , কার্তিক, গনেশ , ব্রহ্মা ,পৃথিবী ,সমুদ্র ,গঙ্গা, অগ্নি, কামদেব ও হিমাদ্রি। হর , উমা ,হরি এই তিন দেবতার বিগ্রহ নিত্য পূজিত হয় ।এই পুজোর পুরোহিত কে "চন্তাই" বলা হয়। চন্তাই কে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করা হয় বলে তিনি রাজ চন্তাই। এই পূজোর সম্পূর্ণ ব্যয় ভার রাজ্য সরকার বহন করে। রাজন্য আমলের সমস্ত রীতিনীতি মেনে আরক্ষা বাহিনী ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে ১৪ দেবতার বাড়ি থেকে শুভযাত্রা করে দেবতাদের অবগাহন করানো হয় তারপর শুরু হয় মূল পুজো।




রাজা ত্রিলোচনের সময় থেকেই বাসের দন্ড বা কঞ্চিকে যেভাবে প্রতিক রূপে পুজো করা হয়েছিল এখনো সেই ভাবেই ১৪ টি বাশের কঞ্চি বিগ্রহের সামনে মাটিতে পোতা হয়ে থাকে। ১৪ টি ঘট ও স্থাপন করা হয় ।প্রতিদিন ১৪ দেবতার মন্দিরে যে পূজা হয় তাতে বলি প্রথা ও প্রচলন ছিল। পুজোতে ছাগ বা কবুতর বলি দেওয়া হয়। বলির মাংস সহ অন্ন নিবেদন করা হয়। বর্তমানে মূল দেবতা" হরের" মূর্তিটি রোপ্য দ্বারা নির্মিত।


এই উৎসব বা পূজো চলাকালীন সময়ে মেলা প্রাঙ্গনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে ।মেলা চলাকালীন সময়ে সেখানকার পরিবেশ যাতে সুন্দর সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকে তার জন্য স্বেচ্ছাসেবক স্কাউট ও নিযুক্ত করা হয় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। এবছর ৭ই জুলাই থেকে ত্রিপুরার প্রধান উৎসব খারচি শুরু হলো।

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল অংশের মানুষ ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সাধু সন্ন্যাসীদের এই মিলন মেলা সার্থক হোক ,মঙ্গল হোক সর্বস্তরের জনগণের।


মনীষা গুপ্ত পাল, ত্রিপুরা


আরশিকথা হাইলাইটস

ছবিঃ নিজস্ব
৮ই জুলাই ২০২২

 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.