Type Here to Get Search Results !

প্রবন্ধঃ- বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট - কামনা দেব, ত্রিপুরা

প্রবন্ধঃ-

১৯৬০ সালের এপ্রিল মাস, আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অসমীয়া ভাষাকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব দেন। আর এই ঘোষণার সাথেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ভাষা সংক্রান্ত উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অসমীয়া জনজাতি উত্তেজিত জনতা বাঙালি অভিবাসীদের উপর আক্রমণ করে এবং সেই আক্রমনের জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সহিংসতায় এক ভয়ংকর রূপ নেয়। তখন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি বাঙালি সম্প্রদায়ের হিন্দু জনগন ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় আর অন্যান্য নব্বই হাজার জনগন বরাক উপত্যকা ও উত্তর-পূর্ব সহ অন্যত্র পালিয়ে বাঁচে। 

   তখন ন্যায়াধীশ গোপাল মেহরোত্রার নেতৃত্বে এক ব্যক্তির একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। সেই কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কামরূপ জেলার গোরেশ্বর অঞ্চলের ২৫টি গ্রামের ৪,০১৯টি কুঁড়েঘর এবং ৫৮টি বাড়ি ধ্বংস করে আক্রমণ করা হয়েছিল। ঐ জেলা ছিল সহিংসতার সবচেয়ে ভয়ানক আক্রান্তেরএলাকা। নয়জন বাঙালিকে হত্যা করে এবং শতাধিক লোককে আহত করা হয়।

১৯৬০ সালের ১০ই অক্টোবর তৎকালীন আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চলিহা অসমীয়াকে আসামের একমাত্র সরকারী ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তখন উত্তর করিমগঞ্জ-এর বিধায়ক রণেন্দ্রমোহন দাস এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন কিন্তু ২৪ অক্টোবর ১৯৬০ইংরেজী প্রস্তাবটি বিধানসভায় গৃহীত হয়ে যায়। এরপরই শুরু হয় আন্দোলনের সূচনা।

 

# আন্দোলনের_সূচনাঃ-

"""""""""""""""""""""""""""""

বর্তমান আসামের বরাক উপত্যকার বাঙালীদের ওপরে অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ফলে ক্ষুব্ধ হয় বাঙালিরা। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বর্তমানের কাছাড়ে এক "গণসংগ্রাম পরিষদ" নামে এক সংগঠনের জন্ম দেয় এবং আসাম সরকারের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল  শিলচর , করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দির লোকেরা সংকল্প দিবস পালন করেন । এদিকে বরাক উপত্যকার জনগণের মধ্যে সজাগতা সৃষ্টি করার জন্য এই পরিষদ ২৪ এপ্রিল এক সপ্তাহ দীর্ঘ একটি পদযাত্রা শুরু করেছিলেন। ২ মে তে গিয়ে শেষ হওয়া ঐ পদযাত্রায় অংশনেওয়া সত্যাগ্রহীরা প্রায় ২০০ মাইল উপত্যকার প্রতি গ্রামে গ্রামে ঘুরে প্রচার চালিয়েন এবং পদযাত্রার শেষে পরিষদের মুখ্য অধিকারী রথীন্দ্রনাথ সেন ঘোষণা করেন, --

১৯৬১ সালের ১৩ এপ্রিলের ভিতর যদি বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা না করা হয়, তবে তারা পুনরায় ১৯৬১ সালের ১৯ মে আবার  তাঁরা ব্যাপকতর হরতাল শুরু করবেন।

সেই সময় ১২ মে আসাম রাইফেল, মাদ্রাজ রেজিমেন্ট ও কেন্দ্রীয় সংরক্ষিত পুলিশ বাহিনী শিলচরে ফ্ল্যাগ মার্চ করে। তারপর ১৮ মে আসাম পুলিশ আন্দোলনরত নলিনীকান্ত দাস, রথীন্দ্রনাথ সেন ও বিধুভূষণ চৌধুরী এই তিনজন নেতাকে  গ্রেপ্তার করে। এর মধ্যে বিধুভূষণ চৌধুরী ছিলেন সাপ্তাহিক পত্রিকা যুগশক্তির সম্পাদক।

  যেহেতু বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নাই, তখন১৯ মে শিলচর, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে হরতাল ও পিকেটিং শুরু করে দেয়। এরপর করিমগঞ্জের আন্দোলনকারীরা সরকারী সমস্ত কার্যালয়, রেলওয়ে স্টেশন, কোর্ট ইত্যাদিতে প্রায় সমস্ত জায়গায়তে পিকেটিং শুরু করে দেন। এমন সময় যারা শিলচরে রেলওয়ে স্টেশনে  সত্যাগ্রহ শুরু করেছিলেন, তাঁরা সেইদিন বিকেল ৪টার ট্রেনটির সময় পার হওয়ার পর হরতাল শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন ভোর ৫:৪০ এর ট্রেনটির একটা টিকিটও বিক্রি হয় নাই।  তবে সকালে কিন্তু হরতাল শান্তিপূর্ণ ভাবেই অতিবাহিত হয়। কিন্তু বিকালের দিকে আসাম রাইফেল এসে উপস্থিত হয় রেলওয়ে স্টেশনে। তখন বিকেল প্রায় ২:৩০ বাজে। নয় জন সত্যাগ্রহীকে কাটিগোরা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের ট্রাকে করে তারাপুর স্টেশন যার বর্তমান নাম শিলচর রেলওয়ে স্টেশনের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল পার হয়ে। পিকেটিংকারীর চোখে তা পড়ে যায় সেই দৃশ্য।  তখন সকলে গ্রেপ্তার করে নিয়ে দেখে তীব্র প্রতিবাদে ফেঁটে পরেন। তখন সেই ট্রাক চালক ভয় পেয়ে পুলিশরা বন্দীদের নিয়ে পালিয়ে যায়। এরপর কোনো একজন ট্রাকটি জ্বালিয়ে দেয়। যদিও দমকল বাহিনী তৎপরতায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপরই প্রায় ২:৩৫ নাগাদ স্টেশনের সুরক্ষায় থাকা প্যারামিলিটারী বাহিনী আন্দোলনকারীদেরকে বন্দুক ও লাঠি দিয়ে মারতে শুরু করে। এরই সাত মিনিটের ভিতর তাঁরা ১৭ রাউণ্ড গুলি চালিয়ে দেয় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে এবং ১২ জন লোকের দেহে তখন গুলি লাগে। তাঁদের মধ্যে নয় জন সেদিনই নিহত হয়েছিল। পরে অবশ্য দু'জন মারা যান।  এরপর শিলচরের জনগন ২০ মে শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল বের করে প্রতিবাদ করেন।

এই ঘটনার পর পরই আসাম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষাকে সরকারী ভাষা হিসাবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয়।

 এর ফলশ্রুতিস্বরূপ ,প্রতি বছর আজো বরাক উপত্যকাসহ ভারতের বিভিন্নপ্রান্তে ১৯ মে বাংলা ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং শহীদের স্মৃতিতে নানা অনুষ্ঠান করা হয়।

-(সংগ্রহিত তথ্য থেকে নেওয়া)-------------------------



 কামনা দেব, ত্রিপুরা  

১৯শে মে, ২০২৩


 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.