ভূমিকা:
প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। বিশ্বের প্রায় 143টি দেশ এই দিনটি উদযাপন করে। পরিবেশের ওপর মানুষের হস্তক্ষেপ কমানোর লক্ষ্যে জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। 1973 সালে, "কেবল একটি পৃথিবী" থিম নিয়ে প্রথম বিশ্ব পরিবেশ দিবস অনুষ্ঠিত হয়েছিল। 1973 সাল থেকে, দিবসটি প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট পরিবেশগত থিম নিয়ে পালিত হয়ে আসছে।
পরিবেশের উপর ভিত্তি করে মানব সভ্যতার উন্নতি হলেও মানুষের সেই পরিবেশের শোষণ সভ্যতার পক্ষে প্রতিকূল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানুষের তৈরি বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানব সৃষ্ট কর্মকান্ডের ফলে পরিবেশ এখন বিপন্ন। পরিবেশের নানা দূষণ ও সমস্যা দূর করে পৃথিবীকে মানুষের বসবাস উপযোগী গড়ে তোলাই এখন একমাত্র লক্ষ্য। পরিবেশের নানা ধরনের বিপর্যয় এবং অবক্ষয়ের কারণ স্বরূপ মানুষ এখন নানা প্রকার জাতীয় সমস্যার জর্জরিত।
প্রকৃতির সাথে সম্পর্কের অবহেলায় মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে। মানব সভ্যতাকে সচেতন করে তোলার জন্যই জাতিসংঘ পাঁচই জুন কে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কেন আমরা বিশ্ব পরিবেশ দিবস উদযাপন করি?
পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং মানুষের কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট ক্ষতি রোধ করতে ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হয়। দিবসটি আমাদের পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ ও পদক্ষেপের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে গ্লোবাল ওয়ার্মিং হল প্রধান কারণ যা আমাদের পরিবেশকে প্রভাবিত করছে। তাই পরিবেশ রক্ষা আজ আমাদের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। এছাড়াও, আমাদের সমস্ত ধরণের শোষণমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করা উচিত যা পরিবেশ ধ্বংস করছে। তদুপরি, এটি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য এবং সামনের প্রজন্মের জন্য একটি মৌলিক প্রয়োজন।
পরিবেশ দিবস এর প্রয়োজনীয়তা: মানুষ নিজের চেষ্টায় এবং বিজ্ঞানের কল্যাণে জয় করেছে পৃথিবীর নানা কিছু। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আজ গভীর সমুদ্র তলদেশ থেকে মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে পরিবেশের সাথে। পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে কঠিন থেকে কঠিনতর বিপদের দিকে। আরো এভাবে তার কথা স্মরণ করে দিতে এবং মানুষকে সচেতন করতে প্রতিবছর পাঁচজুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা কী করব?
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে, আমরা পরিবেশ সুরক্ষা সম্পর্কে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বিভিন্ন প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ করি। প্রতি বছর বিশ্ব পরিবেশ দিবস একটি নির্দিষ্ট থিম অনুযায়ী পালিত হয়। এছাড়াও, থিমের জন্য নির্দিষ্ট স্লোগান রয়েছে, তাই এটি বিশ্বব্যাপী প্রচারে সাফল্য নিয়ে আসে। আমাদের ভবিষ্যৎ উন্নত করার জন্য ছোট ছোট পদক্ষেপ নিতে পরিবেশ দিবসে সারা বিশ্বে বিভিন্ন সংস্থা একত্রিত হয়। স্কুল এবং অফিসগুলি ছাত্র এবং কর্মীদের গাছ লাগাতে, স্থানীয় এলাকা/পরিপার্শ্ব পরিষ্কার করতে উত্সাহিত করে। এই ছোট প্রচেষ্টাগুলি পরিবেশের উপর একটি বড় প্রভাব ফেলে। পরিবেশগত অবস্থার উন্নতির জন্য, সরকারী সংস্থা এবং নেতারা সমস্যাগুলির সাথে লড়াই করার জন্য একত্রিত হয় এবং এইভাবে আমাদের পরিবেশ সংরক্ষণে সহায়তা করে। সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে পরিবেশ রক্ষার জন্য কঠোর আইন, যেমন বন সংরক্ষণ আইন 1980, পরিবেশ (সুরক্ষা) আইন 1986 ইত্যাদি, এবং প্লাস্টিকের ব্যবহার হ্রাস করা, যেমন প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংশোধনী বিধিমালা 2021। যদি আমরা বেশি করে গাছ লাগাই, তা দূষণ রোধ করবে এবং পরিবেশ বাঁচাতে সাহায্য করবে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়া দূষণ কমাতেও সাহায্য করতে পারবে।
পরিবেশ দিবসের ইতিহাস:
পশ্চিম ইউরোপের কেন্ডিনেভিয়ান দেশগুলো বিশ্ব পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত আন্দোলনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। তবে এই দেশগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা এগিয়ে রয়েছে সুইডেন। বর্তমানে সুইডেনের অত্যন্ত পরিবেশ সচেতন স্কুল পড়ুয়া গ্রেটথুনবার্গ যিনি আমাদের সকলের কাছে পরিচিত মুখ।
১৯৬৮ সালের ২০শে মে জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের কাছে সুইডেনে সরকার পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন। আর এই চিঠিতে তিনি পরিবেশ দূষণের কথা গভীর উদ্যোগ নিয়ে প্রকাশ করে তুলে ধরেন, আর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সেই বছরই বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং জাতিসংঘ পরের বছর তার সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে সমাধানের উপায় আলোচনা করতে নির্দেশ দেন। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে সুইডেনের রাজধানী স্টক হোমে পাঁচ জুন থেকে ১৬ই জুন পর্যন্ত বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এবং এই সম্মেলনে পরিবেশ সুরক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরা হয় আর এটি ছিল পৃথিবীর প্রথম পরিবেশ সংক্রান্ত কোন আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এই সম্মেলনের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সাল থেকে জুন মাসের ৫ তারিখ জাতিসংঘ বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তবে ১৯৭২ সালের ৫ জুনকেই বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
পরিবেশ দিবস পালনের উদ্দেশ্য:
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের মুখ্য উদ্দেশ্য হল পরিবেশকে মানুষের বসবাস উপযোগী করে তোলা আর এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রতিবছর পাঁচই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
তাছাড়া আরো যে সমস্ত বিষয়গুলো পরিবেশ দিবসে গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হল
১. বৃক্ষরোপণ, বন সংরক্ষণের গুরুত্ব আরোপ করা।
২. কৃষি কাজে রাসায়নিক সার ও কিটনাশক ব্যবহার কমানো।
৩. অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবেশগত প্রভাব বিবেচনা করা।
৪. সকল দেশের জাতীয় পরিবেশ নীতির সফল বাস্তবায়ন করা।
৫. পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যাপকভাবে প্রচার ও প্রচারণা বাড়ানো।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন।
৭. উপকূলীয় বনায়ন সম্প্রসারিত করা।
৮. শিল্প বর্জ্য যথাযথভাবে পরিশোধন নিশ্চিত করা।
৯. প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো।
১০.পরিবেশ সম্পর্কে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা।
পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা:
পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা পুরো বিশ্বব্যাপী দিন দিন অনেক বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষ প্রতিনিয়ত সম্মুখিত হচ্ছে নানাহ বিপর্যয়ের। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ প্রকৃতিকে জয় করতে পেরেছে ঠিকই কিন্তু সৃষ্টি করেছে বিশাল সমস্যা। বিজ্ঞান আর এই প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ আধিপত্য বিস্তার করেছে কিন্তু পরিবেশ দূষণের ফলে ভয়াবহ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বর্তমানে পরিবেশ দূষণের ভয়াবহতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে এটি আর কোন নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই ভাবিয়ে তুলেছে পুরো বিশ্ববাসীকে। পরিবেশ দূষণের ভয় বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের আজ দুশ্চিন্তাগ্রস্থ কারণ, শুধু অপেক্ষা হচ্ছে মহা ধ্বংসের। জলে এসে পড়েছে বিষ, বাতাসে এসেছে আতঙ্ক। গত ৬০ বছরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৭৬ টির বেশী
প্রজাতির প্রাণী। এছাড়া প্রতিবছর পায় বিশ কোটি কার্বন মনো অক্সাইড সঞ্চিত হচ্ছে বাতাসে যা পরিবেশের জন্য এক বিশাল হুমকি। পরিবেশন দূষণের প্রভাব দিন দিন এত বৃদ্ধি পাচ্ছে বিজ্ঞানীদের ধারণা ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা মোটামুটি 1 থেকে 2° সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। আর তার প্রভাবে শুরু হবে জলোচ্ছ্বাস, বন্যা মহামারী। বায়ুমণ্ডলের ওজন স্তরের আয়তন ক্রমশ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যার কুফলে প্রাণী জগৎ ও উদ্ভিদজগৎ আজ বিপন্ন।
উপসংহার:
পরিবেশ মানব সভ্যতার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। মানুষ পরিবেশ গড়ে তুলেছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পরিবেশ এবং মানুষের মধ্যে পরস্পর সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত। মানুষ তার চারপাশের পরিবেশ থেকেই বেঁচে থাকার সকল উপাদান সংগ্রহ করে আবার এই পরিবেশকে মানুষ স্বার্থপরের মত শোষণ করছে।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হল দূষণমুক্ত এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অভাবমুক্ত একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা। প্লাস্টিক নিষিদ্ধ করা, আরও গাছ-গাছালি রোপণ করা, জল সংরক্ষণ করা, পুনর্ব্যবহার করা এবং বন্যপ্রাণী ও প্রাণী সংরক্ষণ করা।
যথাযথ এমন কিছু পদক্ষেপ যা একটি উন্নত পরিবেশের দিকে বিশ্বকে নিয়ে যাবে। সমস্ত মানুষকে সর্বদা তাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং আশেপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার এবং স্বাস্থ্যকর রাখার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের সবার প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করা উচিত এবং দক্ষতার ও সতর্কতার সাথে তা ব্যবহার করা উচিত। তাহলেই একসাথে, আমরা একটি সুন্দর এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে পারতেরনে
ডঃ হৈমন্তী ভট্টাচার্য
PRINCIPAL
The Institute of Upgraded Gram Sebak Training Centre
Govt. of Tripura
আরশিকথা অতিথি কলাম
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
৫ই জুন ২০২৪