কালিকে আমি ভেবেছি সারা রাত্র,
মলিন ধুলা লাগিবে কেন পায়
ধরণী-মাঝে চরণ ফেলা মাত্র ৷’
পঙক্তিগুলি কবিগুরুর ‘জুতা-আবিষ্কার’ কবিতা থেকে নেওয়া ৷ রাজা হবুচন্দ্র এমন-ধারা না ভাবলে জুতা-আবিষ্কার কত শত-সহস্র বছর পিছিয়ে যেত ৷ সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে জুতার দোকানদারদের উচিত হবুচন্দ্রের একটি আদর্শ মুরতি কল্পনা করে পূজা করা ৷
আমি উত্তর জিলার মানুষ ৷ সিলেটী ভাষার প্রতি আমার খানিকটা দুর্বলতা ৷ তাই সুন্দরী মোহন দাসের লেখা সিলেটী রামায়ণের কয়েকটি পঙক্তি মন থেকে একটু বিস্তৃত উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
দশরথে আইজ্ঞা দিলা রাম হইতা রাজা ৷
হুনিয়া বড় সুখী হইলা রাজ্যর যত প্রজা ৷৷
কেকৈর এক বাপর বাড়ির বান্দি কপালপুড়া ৷
পিঠ যেলান মন হেলান ধনুর লাখান তেরা ৷৷
কেকৈরে কইলা গিয়া রাম রাজা হইত ৷
তর ছাওয়াল ভরত বুঝি ক্ষুদর জাও খাইত ৷৷
বড়র পুয়া রাজা হইলে তুই হইবে বান্দি ৷
ভরত রাজা হইবার লাগি পড়গি কান্দি ৷৷
হুনিয়া কেকৈর মাথা চৌরঙ্গী দিলাইলো ৷
গুঁসা করিয়া উপাশ থাকি মাটির উপর হুইলো ৷৷
দশরথে দেখি কইলো ইতা কর কিতা ?
ঔ দন্ডত্ দিতাম পারি তুমি চাও যেতা ৷৷
কেকৈ উঠিয়া কইলা রামরে পাঠাও বনে ৷
আমার ভরতরে বউআও সিংহাসনে ৷৷
সুইয়া রানীর কথা হুনি রাজা গলি গেলা ৷
কইলা কান্দিও না সোনা তোমার কথাঔ ভালা !
রাম গেলা বনবাসে ভরত বড় বোকা ৷
সিংহাসনও আনি বসাইলা রামর পাদুকা ৷৷’
ভরত রামের প্রতি শ্রদ্ধাবশত: রামের পাদুকা বা জুতা সিংহাসনে রেখে চৌদ্দ বছর রাজত্ব করেছিলেন ৷ কিন্তু এথেকে বোঝা যায় রামায়ণের সময়ে অর্থাৎ ত্রেতা যুগে কিংবা এরও আগে জুতা আবিষ্কৃত হয়েছিল ৷ রাজা হবুচন্দ্র তাই রামের পূর্বসূরি ৷ তিনি হয়তো সত্যযুগে জন্মে ছিলেন ৷
সে যাক ৷ আমরা উত্তর জিলার লোকেরা রাম যে ধরণের পাদুকা পায়ে দিতেন সেগুলিকে ‘খড়ম’ বলি ৷ খড়ম কাঠের সোলের চপ্পল ৷ পায়ের বুড়ো আঙ্গুল এবং তর্জনীর ফাঁকে আটকে থাকার কাঠেরই গ্রিপ থাকে ৷ মুনি ঋষিরা, আমাদের বয়স্ক পূর্বজরা খড়ম ব্যবহার করতেন ৷ খড়মের ব্যবহার এখন কমে গেছে ৷ খড়ম একটি অস্ত্রও বটে ৷ খড়ম-পেটা করার অসংখ্য নজির পাওয়া যায় ৷
ভরত ছিলেন প্রক্সি রাজা ৷ প্রতীক হিসাবে রামের ‘খড়ম’ সিংহাসনে রাখতেন ৷ চৌদ্দ বছর ৷ এই প্রক্সি ব্যবস্থাকে আমাদের অঞ্চলে এক কথায় ‘খড়ম’ বলা হয় ৷ কিছুদিন আগের ঘটনা ৷ আমার এক সহকর্মী ৷ পুলিশের ডি.এস.পি. ৷ তারও বাড়ি উত্তর জিলায় ৷ পুলিশ সদরে মিটিং চলছে ৷ মহকুমা পুলিশ আধিকারিকদের নিয়ে ৷ ওর যখন বলার টার্ন এলো সঠিকভাবে বড় সাহেবদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছিল না ৷ বার বার ছন্দপতন হচ্ছিল ৷ এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, ‘আমি খড়ম স্যার ৷’
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছিল ৷ উত্তর শুনে ৷ আমি বুঝিয়ে বললাম ৷ সে বলতে চাইছে আসল মহকুমা পুলিশ আধিকারিক ছুটিতে ৷ সে তার জায়গায় প্রক্সি দিচ্ছে ৷ তাই সব প্রশ্নের উত্তর সঠিক দিতে পারছে না ৷ সভায় হাসির রোল উঠল ৷ কিন্তু, সেই থেকে বেচারার নাম পড়ে গেল ‘খড়ম’ ৷
লেখকঃ অরিন্দম নাথ, পুলিশ আধিকারিক
ত্রিপুরা