Type Here to Get Search Results !

গল্পঃ- যত্নে রেখো ........গল্পকার- মনদীপ ঘরাই, বাংলাদেশ

চোখের জলে চিঠি দুটো কতবার ভিজেছে এখন আর মনেও পড়ে না নদীর। অশ্রুসাগরে সারাজীবন আছড়ে পড়বে বলেই কি তার নাম নদী রেখেছিল মা? চুলায় চড়ানো প্রেসার কুকারের তীক্ষ্ণ সিটিগুলো নদীর কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছিল না। আমি বাধ্য হয়েই বললাম, ‘রান্না পুড়ে যাবে তো। রান্নাঘরে যাবে না?’ চমকে উঠে কিছু না বলেই রান্নাঘরে দৌঁড় দেয় নদী। ফিরে এসে বলে, ‘ভাই, রান্নার জন্য তো রান্নাঘর আছে, কান্নার জন্য একটা 'কান্নাঘর' কেন থাকে না? চোখের জলের ফোঁটাগুলো জমাতাম!’ আমি উত্তর খুঁজে পাই না। চোখ গড়িয়ে জল নামে নদীর। আমি চুপ করে উঠে বের হয়ে যাই। লিখতে হবে। নদীর গল্প।সাগরের গল্প। কলেজে সাগরের নাম-ডাক কম না। বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন। উপস্থিত বক্তৃতাতেও সবসময় চ্যাম্পিয়নই হতো। নতুন একটা মেয়ের উপস্থিতি তার উপস্থিত বক্তৃতার জগতটাকে এলোমেলো করে দিয়েছে। নদী। বাবা সরকারি কি জানি চাকরি করে। বছরের মাঝে এসে ভর্তি হয়েছে কলেজে। এ কেমন বিচার? পরে জেনেছি আইনে নাকি আছে। বন্ধুরা সব নদীর পেছনে খাল হয়ে ছুটলেও সাগর তো আর নদীতে হারাতে পারে না। নদীরা সাগরে হারাবে তা তো প্রকৃতিরই বেধে দেয়া নিয়ম। তবে ওসব হারানোর চিন্তা সাগরের মগজেই নেই। সে শুধু নদীকে হারাতে চায়।মঞ্চের যুদ্ধে। বছরখানেক পর। এতদিনে জল ঘোলা কম হয় নি। এর মধ্যে তিনবার উপস্থিত বক্তৃতায় হেরেছে সাগর। তিনবারই নদীর স্রোত ডুবিয়েছে তাকে। শেষবার সাগরের টপিক ছিল ‘ছাত্রজীবন গড়তে মূল্যবোধ’ এই কঠিন টপিকে জান লাগিয়ে লড়েছিল সে। আর নদীর সহজ টপিক, ‘আমার মাতৃভূমি’ ও তো তেমন ভালো ও বলে নি! তাহলে কি ওর রূপের প্রভাব? চিন্তা করেই সাথে সাথে লজ্জ্বা পেল সাগর। এ তো মনে মনে নদীকে সুন্দরী বলে মেনে নেয়া হলো! নাহ্। ওসব সাগরের মনে একদমই নেই। সে বিতার্কিক। এমন বিশ্লেষণ করতেই পারে। এবারের হারে কেমন জানি গা ছেড়ে দেয় সাগর। কিছু দিন কাটে দিনের মত করেই। হঠাৎ একদিন। আন্তঃকলেজ বিতর্ক প্রতিযোগিতা। কলেজ থেকে দল যাবে ঢাকায়। সাগরের দল কলেজে চ্যাম্পিয়ন। সে দলটাই যে যাবে সেটাতো নিশ্চিত। সবকিছু সবসময় কি হিসেব মতো হয়? সাগরের দলের সদস্য রাজুকে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে অজানা আতঙ্কে বুকটা ধক করে ওঠে সাগরের। রাজু ঢাকাগামী দলে নেই। সাগরের দলের নতুন সদস্য নদী। মুহূর্তে চটে যায় সাগর? এ কেমন কথা? কম্বিনেশন বলে একটা ব্যাপার আছে না? সবাই মিলে ক্লাস টিচারের কাছে যায়। লাভ হয় না। প্রিন্সিপ্যালের সিদ্ধান্ত। ট্রেনে চলছে। ঢাকার পথে নদী-সাগর। সাথে তাদের টিচার ও আরও দুজন। পুরো পথে নদী সাগরের সাথে একটা কথাও বললো না। এত অহংকার কিসের ওর? সাগর মনে মনে ভাবে। ভোরের আলোয় ঢাকা। আগেও অনেকবার এসেছে এই বিতর্কের সুবাদে। তাই মুগ্ধতা অতটা নেই। সাগর মুগ্ধ হয় গুনগুন গানের শব্দে? কে গাইছে? জেসমিন ম্যাডাম? ‘প্রাণ ভরিয়ে...তৃষা হরিয়ে...মোরে আরও আরও আরও দাও প্রাণ’ রবী ঠাকুর এই কন্ঠের জন্যই কি গানটা লিখেছিলেন? ঘোর কাটে সাগরের। জেসমিন ম্যাডাম নয়। গানটা গাইছিল নদী। সাগরের উত্তাল ঢেউ এ পৃথিবীর কোন তটে আছড়ে পড়লো না। মুখ লুকালো অন্য কোন জগতে। প্রস্তুতি পর্ব থেকেই জড়তার বরফ গলা শুরু। নদীর সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করলো সাগরের। নদীও মিশছে সাবলীলভাবে। দলের বাকি সদস্যরা সাগরের এ রণনীতির ব্যাখ্যা খুঁজে পায় না। সাগরের দল চ্যাম্পিয়ন। সাগর শ্রেষ্ঠ বক্তা। নদী নম্বর পেয়েছে সবচেয়ে কম। সাগরের নাম্বারে শেষরক্ষা। নদী এসে সাগরকে বলে গেল, ‘বাঁচালে’। সাগর মনে মনে বললো, ‘আমাকে তো তুমি মেরেই ফেললে’। নীড়ে ফেরে পুরো দল। সাগরকে সবাই অভিনন্দনের সাগরে ভাসায়। এদিকে সাগর ডুবে আছে নদীতে। জোয়ার-ভাটার কিছুই বাদ যাচ্ছে না। এ জগতের কেউ জানে না সাগরের মনের কোণের ঢেউ। ঊমিমালা চিৎকার করে বলছে, ‘নদী’ ‘নদী’। এত বড় বিতার্কিক আর বক্তা সাগর, নিজের মনের কথা নদীকে জানাতে জড়তাই যেন কাটে না। খেই হারায় সাগর। দেখতে দেখতে কলেজ শেষ। কাল সবাই ফিরে যাবে আপন ঠিকানায়। নদীকে একবার সামনে পেয়েও কিছু বলতে পারে না সাগর। নদী শুধু বলে যায়,‘ভালো থেকো,সাগর’। নদী কি সাগরের কাছে কিছু শুনতে চাচ্ছিলো? জবাব মেলে না। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। নিয়মটা মানতে পারে না সাগর। শিশুর মতো অঝরে কাঁদে। তারপর মনের অজান্তেই লিখতে বসে। নদীর কাছে। সাগরের চিঠি।সব লেখাগুলো স্পষ্ট দেখতে পাইনি। শুধু চোখে ধরে শেষ কটা লাইন: ‘নদী।নদী।নদী। আমি সাগর হয়েও হারিয়েছি নদীতে। জানি না কোনোদিন তোমার কাছে পৌঁছোবে কি না এ হৃদয় গাঁথা। যদি পৌঁছায়, 'যত্নে রেখো' -ইতি সাগর" সেদিন ভোররাতে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে বাসে ওঠে সাগর। পকেটে চিঠিটা। গাড়ি ছাড়ে। কিন্তু গন্তব্যের আগেই থেমে যায়। মুহূর্তে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়ে খাদে হারায়। আহত ২৫। নিহত ১। সাগর আর নেই.... থানা থেকে সাগরের নিথর দেহটা বুঝে নিতে এসে পরিবারের সবার চোখ এড়ালেও রাজুর চোখে কিছু একটা পড়ে। ‘সাগরের পকেটে ওটা কি?’ হাতে আসে সাগরের লেখা শেষ চিঠি। বিশ্বাস হতে চায় না। মনের কোনে এত বড় স্রোত লুকিয়ে রেখেছিল সাগর? ওদেরকে বললেও হয়ত... কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভাঙে নদীর। রাজু এসেছে। অবাক হয় নদী। ও এইসময় আমার বাসায়! কারণ চিন্তা করতে করতে ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়িয়ে থমকে যায়। রাজু কাঁদছে। একটা শব্দও বলতে পারে না সে। শুধু একটা রক্তমাখা কাগজ বাড়িয়ে দেয় নদীর দিকে। সেদিন চিঠিটা পড়েই কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছিল নদী। আর কিছু মনে পড়ে না। আজও চিঠিদুটো যত্নে রেখেছে নদী। দুটো চিঠির হিসেব মিলছে না? মিলিয়ে দেই। নদীর কলেজে ভর্তি হওয়ার বছর দশেক আগের কথা। খাবারে লবণ কম হওয়া নিয়ে কথা কাটাকাটি হয় নদীর বাবা-মায়ের। অভিমানী মা সেদিনই স্বেচ্ছায় না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। মৃত্যুর আগের শেষ চিঠি: ‘সাদেক, আমার মৃত্যুর জন্য তোমার কোনো দায় নেই। রাগটা একটু কমিও। আর একটাই নিবেদন, আমার মেয়েটাকে 'যত্নে রেখো' " হারানোর অভ্যেসটা তাই নদীর পুরোনো। ২০ বছর আগে আজকের দিনে অর্থাৎ ৩১ আগস্ট প্রান হারায় সাগর। আর নদীর মায়ের জীবনকে আড়ি বলার দিনটাও....৩১ শে আগস্ট। মা হারায়।সাগর হারায়। রয়ে যায় নদী আর ভিন্ন সময়ে ভিন্ন কারনে লেখা দুটো শব্দ: ‘যত্নে রেখো' ।।

লেখক: মনদীপ ঘরাই, সহকারী সিনিয়র সচিব
বাংলাদেশ সরকার
৪ঠা সেপ্টেম্বর ২০১৮ইং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.