Type Here to Get Search Results !

"অন্য মা " ........আটলান্টা থেকে জবা চৌধুরীর এক হৃদয়ছোঁয়া অনুভব

'মা' এই শব্দটি কোনো না কোনো ভাবে মনের একান্তে কোনো এক স্নেহময়ী নারীর ছবিকে চোখের সামনে নিয়ে আসে। আমার প্রবাসী জীবনের শুরুতে এর একটা ব্যতিক্রম এসেছিলো। সম্পূর্ণ অজানা,অচেনা, পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তের একটি রুক্ষ স্বভাবের মহিলা আমার জীবনরক্ষার তাগিদের পথে কীভাবে যেন আপন হয়ে মায়ের আসনে নিজেকে বসিয়েছিলো --- আজ দূর্গা পূজোর প্রাক্কালে দেবী মায়ের আর নিজের মায়ের চেহারার সাথে অবাধে সেই 'অন্য মা'এর চেহারাটি মনে ভেসে আসছে। 

এটি ঠিক তখনকার ঘটনা যখন প্রবাসে জীবনধারণের প্রয়োজনে আমার সমস্ত মনোযোগ ছিল কী করে একটি চাকরী পাওয়া যায় এবং সেটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায়। কারণ নিজের ভালোমন্দের দায়িত্ব যখন নিজের হাতে, তখন বাস্তবের রং অন্যভাবে সামনে আসে। সময়ের সাথে সবই পাল্টায়। জীবন সংগ্রামে নেমে কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতিকে আমি আর আমার বর স্বপন দৃঢ় একটি 'না' শব্দের লক্ষণ-রেখায় বন্দি রাখার চেষ্টা করেছিলাম, যেন সেই অনুভূতিগুলো আমাদের চলার পথকে আর মনের সাহসকে দুর্বল না করে ফেলে। 
নিউয়র্কের ম্যানহাটনে তখন আমি কাজ করতাম একটি কাস্টম টেইলারিং এর দোকানে। ওখানে শুধু টু-পিস্ আর থ্রী-পিস্ স্যুট বানানো হতো। আমেরিকায় অত্যন্ত ধনী লোকেদের মধ্যে ওই কাস্টম টেইলারদের খুব ডিম্যান্ড--- আর  বিশেষ করে যখন সেটি পৃথিবীর সেরা মেট্রোপলিটন সিটিগুলোর অন্যতম একটি  --- নিউইয়র্ক ! ফ্যাশন যেখানে বহু লোকের ধ্যান-জ্ঞান। যাইহোক, সেটি ছিল এমনি এক শরৎ যখন আমার কাজের এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে আর মনে বয়ে চলেছে স্থানীয় পুজোর আনন্দের হাওয়া। এমনি একটি দিনে দোকানের মালিক জানালো যে সে এই দোকানটি বিক্রি করে দিয়েছে একজন কোরিয়ান মহিলার কাছে। আমরা যারা এখানে কাজ করছি, ইচ্ছে করলে কাজ ছেড়ে দিতে পারি।  সে আমাদেরকে এক মাসের অ্যাডভান্স বেতন দিয়ে দেবে। মাথায় বাজ পড়ার মতো সেই খবর। এই খবরে আমার চোখে জল এলো।  ভয় ছিলো একটাই, আমার কাজ না থাকলে স্বপনের পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। আবার আমার কাজ চলে যাবে সেই কথাটি স্বপনকে বলে তার দুঃশ্চিন্তা বাড়াতেও  চাই নি, সাথে ভয়, এতে তার পড়ার মনোযোগ নষ্ট হবে। কারণ সে তখন নিউইয়র্কে দুটো কোর্স -- একটি মাস্টারস, আর USMLE নিয়ে দিন-রাত খেটে চলেছে। পুরোনো বস-এর কাছ থেকে নতুন যে মহিলা দোকানটি কিনেছে তার ঠিকানা নিয়ে গিয়ে কাজের ফাঁকে ইন্টারভিউ দিয়ে এলাম একদিন। ষাট-এর ওপর বয়সী কোরিয়ান মহিলাটি দেখতে যেমন খুবই খারাপ ছিল, ব্যবহারও মনে হলো তেমনি। কিন্তু আমি শুধু কাজ চাই -- তাই, আমার কেমন বেতন চাই, কত ঘন্টা থাকতে পারবো --- এসব প্রশ্নে শুধু বললাম, উনি যা ঠিক করবেন তাতেই আমি রাজি। 
ব্যস, পরের সপ্তাহ থেকে শুরু হলো আমার নতুন বস-এর সাথে কাজ করা। আমার কাজ ছিল কাস্টমার সার্ভিস। ফ্রন্ট ডেস্কের সমস্ত হিসাব রাখাই আমার একমাত্র কাজ ছিল তা নয় --- তার চেয়েও বড় কাজ ছিল দিনের শেষে সেই হিসেব মালিক মহিলাকে বোঝানো --- কারণ সে ইংলিশ প্রায় বুঝতেই পারতো না  ! কী ভয়ঙ্কর সেই অবস্থা ! আদ্ধেক সময় তিনি কোরিয়ান ভাষায় কিছু  বলতেন   --- যার আমি বিন্দু-বিসর্গও বুঝতাম না। সে কী মহাবিপদ ! কিন্তু আর যাইহোক, শুধু জানতাম,কাজটি আমি হারাতে পারবো না। তখনও মোবাইল ফোন আসে নি লোকের হাতে হাতে। Google তো দুরস্ত। পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে কিনলাম একটি 'ইংলিশ টু কোরিয়ান' ডিক্শনারি। সাবওয়ে ট্রেনে যাওয়া-আসার পথে চললো আমার কোরিয়ান ভাষা শেখা। একেই বোধহয় বলে Struggle for existence ! 
আমার হাতে নেওয়া প্রজেক্ট মন্ত্রের মতো কাজ করলো। আমার মুখের ভাঙা-ভাঙা কোরিয়ান শব্দ আমার 'জব সিকিউরিটি'কে পৌঁছে দিলো অনেক উঁচুতে। ধীরে ধীরে দোকানের সব কাজের দায়িত্ব আমার ঘাড়ে তুলে দিয়ে সেই মহিলাটি আমাকে যত্ন করতে শুরু করলেন ঠিক নিজের মেয়ের মতো। রোজ আমাকে লাঞ্চ কিনে দিতেন। মাঝে মাঝেই ট্রেনের ভাড়া দিয়ে দিতেন। এমনকি ওঁর বাড়ি থেকে আমার জন্য ভালো-মন্দ খাবার প্যাক করে নিয়ে আসতেন কখনো-সখনো। প্রায় একমাস পর  আমার কোরিয়ান ভাষা শেখার একটু উন্নতি হলো। মন চাইলো  সঠিক ভাবে ওঁর নামটি জানার l কোরিয়ান ভাষায় জিজ্ঞেস করলাম,  Dangsin-ui ileum-eun mueos- ibnikka ?" Ms. Choi এর চোখ খুশিতে উজ্বল হয়ে উঠলো ! বললেন , Mu su e Choi. এই প্রথমবার ওর পুরো নাম জানলাম। কয়েক মাসের মধ্যে কোরিয়ান রেডিওর লাইভ অনুষ্ঠানে ফোনে সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে আমি জয় করে নিয়েছিলাম Ms. Choi এর মন আরও একবার। গান ছিল ওর ভীষণ প্রিয়। রেডিওতে ওঁর দেশি গানের অনুষ্ঠান তিনি শুনতেন প্রায় সারাদিন। নিজেও অনেক গান গাইতেন মন ভালো থাকলেই। আমারও তখন পা ফেলার ইচ্ছেটাই ছিল Ms. Choi কে খুশি করার আন্দাজে। 

দেখতে দেখতে সম্পর্কটা আমাদের অন্যমাত্রায় চলে গেলো। তারপর আমার বেতন বাড়লো। আমার ভালো-মন্দের খবর রাখতেন --- Ms.Choi এর ভালো-মন্দের সব খবর নিতাম আমিও । আমেরিকান আর্মিতে ছিলেন তার হাজব্যান্ড। কোনো এক যুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। একমাত্র মেয়ে লিন্ডা পড়তো তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে। বিশাল অংকের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স এর বাইরে তার নিজের বলতে ছিল  --সেই একমাত্র মেয়ে। 

দিনে দশঘন্টা আর সপ্তাহে ছয়দিন আমাকে কাজ করতে হতো তখন। দীর্ঘ সময় একসাথে কাটাতে গিয়ে অনেক ব্যক্তিগত কথাও Ms. Choi আমাকে বলে ফেলেছিলেন। জেনেছিলাম উনি একাকিত্ব ভুলতে প্রচুর ড্রিঙ্ক করতেন আর গ্যাম্বলিং করতে উইকেন্ডে চলে যান আটলান্টিক সিটি, নিউজার্সিতে। প্রায় প্রত্যেক সোমবার দোকানে এসেই শুরু হতো উনার কান্নাকাটি।  কারণ বেশিরভাগ সময় উনি গ্যাম্বলিং-এ হেরে আসতেন। উনার মেয়ে লিন্ডা একবার এসেছিলো ছুটিতে আর তখন আমাকে হাতে ধরে অনুরোধ করেছিল ওর মা'কে একটু বোঝাতে। নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। কিন্তু আমার কথা উনি শুনবেন কেনো --- সেই কথাটাও আমার মাথায় থাকতো। প্রায় এক বছর পর একসময় খেয়াল করলাম সোমবারগুলোতে উনি আর চড়া মেজাজেও থাকেন না,   কান্নাকাটিও করেন না। একদিন সাহস করে জিজ্ঞেস করতেই একগাল হেসে বললেন, "deo isang dobag-eulhaji anhneunda"--- অর্থাৎ--নো মোর গ্যাম্বলিং! 
স্বপন যেদিন USMLE পাশ করলো, আমাদের দু'জনকে উনি নিয়ে গেছিলেন ডিনার-এ। তারপর একসময় আমাদেরকে মুভ করতে হলো নিউইয়র্কের Long Island এ, তখন কাজটা ছেড়ে দিতে হলো আমাকে অনেক মন খারাপ সত্বেও । তারপরও অনেকদিন যোগাযোগ ছিল। নিউইয়র্ক ছেড়ে Alabama চলে আসার আগে দেখা করতে গিয়ে আমরা জেনেছিলাম Ms. Choi ক্যান্সারে ভুগছেন। তখন তাঁর বয়স ৬৭। মাস-খানেক পর উনার নাম্বারে বহুবার ফোন করে আর ওর গলা শুনিনি। 

আজ যখনই Ms. Choi এর কথা মনে পড়ে ---ক্ষণিকের হলেও বিদেশের মাটিতে আমাকে মায়ের আদর দেওয়া এই 'অন্য মা' এর মুখটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। অজানা, অচেনা, কুৎসিত,রুক্ষ কথার সেই Ms. Choi কী করে একটি মিষ্টি সুন্দর ভালোবাসার মায়ের জায়গা করে নিয়েছিলেন আমার জীবনে, আজও ভাবতে অবাক লাগে !

জবা চৌধুরী, আটলান্টা
কলাম লেখিকা, আরশি কথা

৬ই অক্টোবর ২০১৮ইং

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.