Type Here to Get Search Results !

"বুলেটহীন বুলেটপ্রুফ জীবনে ফেব্রুয়ারি আসে, আবদুল, রফিকের রক্তভেজা ঘামে..." - অমিত ভৌমিক

৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় কুড়িটি বছর। স্বাধিকার লড়াইয়ের সংগ্রামে বাঙালি জাতি লাভ করেছিলো মাতৃভাষার সম্মান। বাঙালি জাতির ভাগ্যাকাশে লাল সবুজের পতাকায় জন্ম নিয়েছিলো স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ৫২'তে ভাষার প্রশ্নে একবুক রক্ত দিয়েছিলেন আবুল,সালাম,বরকত ও জব্বরেরা। সেই তরুণ তাজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত মাতৃভাষার অধিকার আজ উত্তরাধিকারী প্রজন্মের কাছে আর দশটি সেলিব্রেশনের মতোই পালিত হয়। জীবন জীবিকার প্রশ্নে বাংলা ভাষার গুরুত্ব কতদূর আজকের কর্পোরেট দুনিয়ায় ? 

প্রশ্নটি যখন জীবনযুদ্ধে প্রতিদিন আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকার, প্রশ্নটি যখন কর্পোরেট জগতে নিজের স্ট্যাটাসকে আরও বাড়িয়ে তোলার, দামি ফ্ল্যাট, দামি কোম্পানীর গাড়ি হাঁকিয়ে বাইপাস ধরে চলে যাওয়া আর উইকএন্ডে রাতভোর হ্যাংওভার কাটিয়ে আবারও পরদিন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া এ সময়ে দাঁড়িয়ে আবুল,সালাম,বরকত,জব্বরদের আত্মবলিদান মনে হয় নেহাৎ বোকামী ছিলো। " আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসেনা" এ প্রত্যয়ী ঘোষণার মধ্যে আমরা অভিভাবকরা যখন বিদেশী শিক্ষার জাতে উঠি, তখন ফুলে-মালায় একুশে যাপনের কী বা গুরুত্ব আছে।

আসলে দোষটা প্রজন্মের নয়। এ প্রজন্ম দামি বিদেশীয় কোম্পানির ডিজাইন করা নরম পুলওভারে শরীর ঢেকে বড় হয়েছে, মায়ের সোহাগী নকশিকাঁথার গুরুত্ব এদের কাছে তাই উপহাসের। বড্ড সেকেলে লাগে। অনায়াসলব্ধ সুখের সময়ে দিন কাটছে আমাদের। তাই আজ মা থেকে মাসীর কদর বেশী।

আজ ভাষার প্রশ্নে কণ্ঠরুদ্ধ,বাকরুদ্ধ হবার ভয় নেই। নেই বিদেশী শাসকের চোখরাঙ্গানি বা চাবুকের আঘাত।  বুলেটহীন বুলেটপ্রুফ জীবনে ফেব্রুয়ারি আসে, আবদুল, রফিকের রক্তভেজা ঘামে পাশ্চাত্যের ভ্যালেন্টাইন বার্তা নিয়ে। তাই ফেব্রুয়ারিতে এক একটি গোলাপের বাণিজ্যিক মূল্যমান বেড়ে দাঁড়ায় একশো টাকায়। গোলাপের কাঁটাগুলি আজ অদৃশ্যমান। কোথায় গেলো কাঁটাগুলি ? রফিক সালামের বুকে বিঁধে রক্তাক্ত করে আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছে। তাই হাইটেক প্রজন্মের কাছে কাঁটাগুলি মূল্যহীন।

হাইটেক যুগে বাংলা লিপিগুলিও আজ ঝাঁ চকচকে অফসেটে ছাপা। কম্পিউটারে অজস্র বাংলা ফন্ট। আমার বাংলা, সুমিত, সত্যজিৎ, অনুরিমা, অভ্র... প্রয়োজনমতো বাছাই করে নিয়ে নিজের কাজগুলি গোছাতে পারি অনেকেই। কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখবো প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি বর্ণমালা রক্তাক্ত। এর অন্য কোন রঙ নেই। পলাশের ফিকে লাল আর রক্তাক্ত বর্ণমালা আত্মবিস্মৃত জাতিকে বারবারই মনে করিয়ে দেয় একুশ কখন দোরগোড়ায়।

হিন্দি আর উর্দুর আগ্রাসনে বাংলা বর্ণমালাগুলি অবলীলায় আজও ধর্ষিতা হয়। আমার ধর্ষিতা ভাষা জননীকে একুশের উত্তাপ দিক নতুন প্রজন্ম। ভাষা আগ্রাসনের রক্তাক্ত আঘাত মুছিয়ে একুশের বেদীমূলে আসুন আত্মঅনুশোচনায় কয়েক মুহূর্ত যাপন করি। একুশ তাই এখন আর শোকের নয়, আনন্দ প্রাপ্তি বা উদযাপনেরও নয়, একুশ আজ আত্মঅনুশোচনার তিথি।

   

অমিত ভৌমিক, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ত্রিপুরা   








কভার ছবিঃ জবা চৌধুরী, আমেরিকা

২২শে ফেব্রুয়ারি ২০১৯ইং    

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.