Type Here to Get Search Results !

আমাদের প্রত্যেকেরই আগুনের জুতো দরকার " .....আসলাম আহসান,বাংলাদেশ

শ্রোতা হিসেবে আমি প্রায় সর্বভুক। সব ধারার সব ঘরানার গান আমি শুনি। গানের কোনো ঘরানা বাহিরানা কী! একটু গভীর বাণী, যথাযথ সুর এবং এর সঙ্গে দরদী কণ্ঠ সহযোগে একটি গান শুনতে পেলে যে আনন্দ পাই, এর তুলনা নেই। সম্প্রতি শুনলাম এমনই একটি গান। শিরোনামটাই অভিনব, ব্যঞ্জনাময় : ‘আগুনের জুতো পায়ে হাঁটছি।’ বোঝা যায়, এক দুঃসহ জীবনযন্ত্রণাকে রূপ দিতে গিয়ে গীতিকবি এই লিরিকের জন্ম দিয়েছেন। লিরিক নিয়ে অবশ্যই বলব। তার আগে এই গানের কণ্ঠশিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায়কে কিছু বলার তাগিদ অনুভব করছি। কারো কারো মনে হতে পারে, এ ধরনের একটা গান রথীন্দ্রনাথকে দিয়ে গাওয়ানোর বিষয়টা বোধহয় এক ধরনের ‘নিরীক্ষা’। আসলেই কি তাই? শ্রেণিবিচারে এটিকে যদি গণসংগীত বলেই চিহ্নিত করতে হয়, তাহলে বলতে হয় রথীন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব ধারাতেই গান গেয়েছেন। শ্রোতাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্বোধন হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ রায়ের ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর’ গানটি দিয়ে। এ গানে তাঁর সহশিল্পী ছিলেন আপেল মাহমুদ। তারপর তাঁর গাওয়া ‘চাষাদের মুটেদের মজুরের / গরিবের নিঃস্বের ফকিরের / আমার এ দেশ সব মানুষের।’ কিংবা ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করিলি রে বাঙালি / তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’...এইসব গান কি কখনো ভোলা যাবে? তো, আমিরুল মোমেনীন মানিকের লেখা ‘আগুনের জুতো পায়ে হাঁটছি’ গানটিকে বাংলার সবচেয়ে উদাত্ত কণ্ঠের অধিকারী এই শিল্পীর কণ্ঠে উপস্থাপন নিরীক্ষা হয় কীভাবে? হ্যাঁ, তিনি মূলত ভাওয়াইয়ার জন্য বিখ্যাত। সিনেমাতে গান গেয়েও সমাদৃত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠের যে জোশ, এতো গণসংগীতের পক্ষেই বেশি অনুকূল। তাই এ গানের মাধ্যমে তাঁর এই প্রত্যাবর্তনকে বলা যেতে পারে এক ধরনের ‘পুনরুজ্জীবন’। কারণ দীর্ঘদিন রথীন্দ্রনাথ রায় মৌলিক গান থেকে দূরে ছিলেন। সব শিল্পীর প্রতি সম্মান রেখেই বলি, এই গানটি এই সময়ে তাঁর মতো এমন সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন এমন প্রাজ্ঞ নাম তো এই মুহূর্তে মনে করতে পারছি না। এই গানের মূল সম্পদ এর লিরিক, আর লিরিকের প্রেরণায় আছে বাস্তবধর্মিতা। সমকালীন সমাজ, পবিবেশ একজন স্বাধীনচেতা মানুষের পক্ষে কতটা নির্মম এবং সেই স্বাধীনচেতা সংগ্রামপ্রিয় মানুষটি বৈরী পরিবেশকে জয় করার জন্য কীভাবে আগুনমুখো সাপ এবং দুরন্ত ষাড়ের সঙ্গে লড়ছেন, এ গান তারই আখ্যান। এই দূষিত মাটি এতটাই বিষাক্ত হয়ে উঠেছে যে, সাধারণ জুতো পায়ে হাঁটা আর সম্ভব হচ্ছে না, পরতে হয়েছে আগুনের জুতো। পিঠে শত অপমান ও আঘাতের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে এগুচ্ছে লড়াকু মানুষ। সমকাল ও স্বদেশের ঋণ তাকে শোধ করতেই হবে। রক্তে তার বিপ্লবের আগুন। আপোশকামীরা তাকে ‘বেহায়া বেপরোয়া’ বলতেই পারে। কিন্তু একজন বিপ্লবী মাঝপথে পিছু হটে কী করে! গানের মূল পাঠ বেশ দীর্ঘ। নির্বাচিত অংশে সুরারোপ করে এ গানের নির্মাণ। সুরারোপ করেছেন হাবিব মোস্তফা। রথীন্দ্রনাথ রায়ের ভাষায়, ‘ইয়াং একটা ছেলে।’ ধীরে ধীরে তার সুর উৎকর্ষের দিকে যাচ্ছে। এ গানেও এর লক্ষণ দেখলাম। এমন একটি জ্বলন্ত লিরিক এমন একটি উদ্দীপ্ত সুরই দাবি করে। লক্ষ্যে স্থির থাকলে এই ‘ইয়াং ম্যান’ অনেক দূর যাবেন বলে মনে হয়। গানটির দৃশ্যায়ন যথাযথ। পুরো গানটি মনোযোগ দিয়ে শুনলে এবং দেখলে কাঁটাতারের বেড়া, মাকড়সার জাল বিস্তার, ধাবমান ঘোড়ার দৃশ্য...এর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন বা প্রক্ষিপ্ত বলে মনে হয় না। দৃশ্যগুলো গানের অর্থটাকে আরও বেশি ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে। এ গানে অনু মোস্তাফিজের সংগীত বেশ পরিশীলিত। কোথাও কোনো বাহুল্য নেই। তবে অর্কেস্ট্রেশনে গীটারের প্রাধান্যটা কোথাও কোথাও মাত্রাতিরিক্ত মনে হয়েছে। আরেকটা বিষয়: গানের মুখড়াটা (ডুবি ডুবি তবু অযুত সাহসে--- আগুনের জুতো হাঁটছি) এতবেশি বার পুনরাবৃত্তি করা হলো কেন? ওটা পরিহার করা যেত। আমার ব্যক্তিগত ধারণা তাতে গানটির সৌন্দর্য কমত না; বাড়ত। গীতিকার সুরকার ও কণ্ঠশিল্পীর সহযাত্রী হয়ে আমরাও অযুত সাহসে আমরা বুক বাঁধলাম : সুসময় একদিন ফিরবে।


আসলাম আহসান
সঙ্গীত গবেষক ও সংস্কৃতি সমালোচক
বাংলাদেশ

১৯শে জুলাই ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.