আর মাত্র তিনদিন। তারপরই গাবলু রাজা। গাবলু, যার পোষাকী নাম দীপ্তুনু মজুমদার। আর তিনদিন পরই গাবলুর ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবে। আর এইবার -এইবার গাবলু ফার্স্ট হবেই হবে। কেও ওকে আটকাতে পারবে না।
সময় যেন আর কাটতেই চায়না গাবলুর। চোখের সামনে একটু পরপরই ভেসে উঠছে সেই দৃশ্যগুলো। অন্যান্য ক্লাসের ফার্স্ট হওয়া ছাত্র ছাত্রীদের সাথে দাঁড়িয়ে আছে অপূর্ব --- লাইনের প্রথম সারিতে। আর হেডস্যার একে একে সকলের হাতে তুলে দিচ্ছেন প্রাইজ। সবাই মিলে হাততালি দিচ্ছে। সকলের সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে গাবলুও। ক্লাস ওয়ান, টু এর কথা ওর মনে নেই। কিন্তু ক্লাস ফোর থেকে এই একই দৃশ্য দেখে আসছে গাবলু। আর মনে মনে শুধু একটি কথাই ভেবে এসেছে বারবার --"কবে আমি ফার্স্ট হব? কবে প্রেয়ার লাইনে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে প্রাইজ নেব, আর সবাই হাততালি দেবে?" মা অবশ্য সবসময়ই বলেন ফার্স্ট হওয়া না হওয়া কোনো ব্যাপার না, আসল কথা হচ্ছে তুমি কতটা শিখেছো। মার এই কথায় গাবলু মোটেও খুশি হতে পারেনা। ও চায় প্রেয়ার লাইনে ও দাঁড়াবে সবার সামনে --- আর হেড স্যার ওর হাতে তুলে দেবেন প্রাইজ।
প্রতিবছর সব বিষয়েই ভালো নম্বর পায় গাবলু। শুধুমাত্র সমাজবিদ্যা বিষয়ের জন্যই ওকে হেরে যেতে হয় অপূর্বের কাছে।এবার তাই বছরের প্রথম থেকেই গাবলু খুব সতর্ক। পরীক্ষা দিয়েই বুঝে গেছে এবার আর কোনো বিষয়েই ওকে হারাতে পারবে না অপূর্ব।
মা ঘরে বসে বসে রেজাল্টের কাজ করছেন। স্কুলে যাওয়া নিষেধ। কি এক করোনা ভাইরাস এসেছে যার জন্য সব কাজ এখন ঘরে বসে। অন্যান্য বছর কত মজা হত পরীক্ষার পর -- খেলা- বেড়ানো - পিকনিক আরও কত কি। এবার তো আবার পরীক্ষাও হল কতদিন পর। ডিসেম্বরের পরীক্ষা হল সেই মার্চ মাসে। তার উপর এই করোনা ভাইরাস। গাবলু ঠিক করেছে হাজার ভাইরাস থাকলেও রেজাল্টের দিন ও স্কুলে যাবেই যাবে। কেও আটকাতে পারবে না ওকে। প্রেয়ার লাইনে ও দাঁড়াবে সবার সামনে -- হেডস্যার ওর হাতে প্রাইজ তুলে দেবেন -- আর সবাই হাততালি দেবে।ভাবতেই আনন্দে মনটা ভরে উঠে গাবলুর।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই গাবলুর মনে হল আজ রেজাল্ট । কোনোক্রমে মুখ ধুইয়েই দৌড় দিল ঠাকুরঘরে। ঠাকুরের কাছে প্রনাম সেরে এসেই চিৎকার --" মা ও মা আমার স্কুল ড্রেস কোথায়? " মা রান্নাঘরে ব্যাস্ত ব্রেকফাস্ট তৈরিতে। মানদা মাসী অনেকদিন হল আসেনা। সেখান থেকেই উত্তর করলেন -- "স্কুল ড্রেস দিয়ে কি করবি? "
"আজকে আমার রেজাল্ট। আমি স্কুলে যাব"
" স্কুলে যাবি কি করে? লকডাউন চলছে তো। সব বন্ধ। ঠিক আছে দাঁড়া আমি তো স্যারকে ফোন করে তোর রেজাল্ট জেনে নিচ্ছি। "
বলতে বলতেই মা'র ফোন বেজে উঠল। গাবলু শুনতে পেল মা বলছেন --" সত্যি! এ তো দারুন খবর, হ্যাঁ -- হ্যাঁ আপনি একটু ফোনটা ধরুন আমি দীপ্তনুকে দিচ্ছি। " গাবলু ভেবে পায় না ওকে কে ফোন করবে ?
"গাবলু- গাবলু শিগগির আয় তোর হেডস্যার ফোন করেছেন ।"
"হেডস্যার ফোন করেছেন? কেন ?" ভয়ে হাত- পা ঠান্ডা হয়ে যায় গাবলুর। মার কাছ থেকে তাড়াতাড়ি ফোনটা নিয়ে "হ্যালো" বলতেই হেডস্যার এর গলা ভেসে আসে -- " খুব ভালো খবর দীপ্তনু ---- এবার তুমি ফার্স্ট হয়েছো --- আর শুধু ফার্স্টই হওনি অপূর্ব এর থেকে বেশ কিছু নম্বর বেশি পেয়েছো। এখন তো লকডাউন চলছে, কবে খুলবে তাও জানি না।তোমার মাকে বলো স্কুলে এসে তোমার প্রাইজটা নিয়ে যেতে।এক কাজ করো --- তোমার মাকে ফোনটা দাও, কবে স্কুলে আসবেন জানিয়ে দেই। " মার হাতে ফোনটা দিয়েই একছুটে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে গাবলু।
ব্রেকফাস্ট খাওয়ার জন্য ডাকাডাকি করেও ছেলের সাড়া না পেয়ে মা এসে দেখেন গাবলু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে,আর কান্নার দমকে ফুলে ফুলে উঠছে ওর শরীরটা । হতভম্ব গাবলুর মা তাড়াতাড়ি ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলেন --- " কি হয়েছে -- কাঁদছিস কেন? তুই তো সবসময় ফার্স্ট হতে চাইতিস--- তোর ইচ্ছা তো এবার পূরণ হল -- কোথায় আনন্দ করবি -- তা না কাঁদছিস। " হৈ চৈ শুনে গাবলুর বাবা, ঠাম্মা সবাই ছুটে আসে। সকলেরই একই জিজ্ঞাস্য গাবলু ফার্স্ট হয়েছে তবু কাঁদছে কেন? ঠাম্মাকে দেখে গাবলু আর নিজেকে সামলাতে পারে না।ঠাম্মার গলা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে --- " আমি তো এমন ফার্স্ট চাইনি ঠাম্মা -- আমি চেয়েছিলাম ফার্স্ট হয়ে আমি স্কুলের প্রেয়ার লাইনে সবার সামনে দাঁড়াব ---- হেডস্যার আমাকে প্রাইজ দেবেন --- আর সবাই হাততালি দেবে -- কেন, কেন এমন হল ঠাম্মা ---করোনা ভাইরাসটা কেন আর কিছুদিন পর এলনা ---"
সুস্মিতা ধর, ত্রিপুরা
৬ই সেপ্টেম্বর ২০২০