আরশি কথা

আরশি কথা

No results found
    Breaking News

    নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষা

    আরশি কথা


    আমরা যারা প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করেছি তখন থেকেই তিন শব্দবিশিষ্ট একটি বাক্যের সঙ্গে কম-বেশি পরিচিতি অর্জন করেছিসেটা হলো 'শিক্ষা জাতির মেরুদ-'অর্থাৎ শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে নাশিক্ষা-সংস্কৃতি একটি জাতির মধ্যে জাগরণ ঘটাতে পারেএ জাগরণে জাতি উন্নয়নের দিকে ধাবিত হয়তাই উন্নত রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, সেসব রাষ্ট্রে উন্নয়নের ভিত্তি সুদৃঢ় যা শিক্ষা দ্বারা সুসংগঠিত হয়েছেতাই সমাজ, দেশ, জাতি গঠন ও উন্নয়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

    বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বলেছেন, বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নরনজরুল ইসলামের এ মহান বাণীটির মর্মকথা হলো, নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি দেশের উন্নয়ন ঘটেতাই শিক্ষার কোনো বিকল্প নেইনারী-পুরুষ শিক্ষা ক্ষেত্রে সমঅধিকার ভোগ করবে এটা সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতবর্তমানে পুরুষের পাশাপাশি নারী শিক্ষায় বেশ এগিয়ে যাচ্ছেশুধু নারী শিক্ষা নয় এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ননারী এখন পিছিয়ে নেইতাদের যাত্রা সামনের দিকেনারী পুরুষের মতো সমঅধিকার নিশ্চিত করা না গেলে কোনো সমাজ এগোতে পারে নাশিক্ষা-দীক্ষা, চাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য সব ক্ষেত্রে আজ নারী এগিয়ে যাচ্ছে

    নারী আজ সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন অফিস-আদালতে কাজ করছেপ্রকৃতপক্ষেই এসব কাজের সুযোগ করে দিয়েছে শিক্ষাআবার শিক্ষা একটি জাতির মৌলিক অধিকারনারী-পুরুষ নির্বিশেষে তারা এ অধিকার ভোগ করছেফলে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নানা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও নারী আজ শিক্ষায় অনেক এগিয়েআবার শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হয়ে আজ নারী রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মর্যাদাশীল পদে অধিষ্ঠিতআমাদের সংবিধান শুধু শিক্ষায় নয়, নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে ২৮(২) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেতাই কোনো অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগাতে গেলে নারী-পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা দরকারএ কথা বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম বুঝতে পেরেছিলেন বলেই উপরোক্ত মন্তব্য করেছিলেনতাই নারীরা উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে তারা স্বীয় কর্মদক্ষতার গুণে আসীন। 

    আমাদের স্পিকার, প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেতাও নারীতা ছাড়া কয়েকজন নারী মন্ত্রীও রয়েছেনশুধু রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদ ছাড়াও তৃণমূল পর্যায় অর্থাৎ স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থায় নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংরক্ষিত আসনে নারী নির্বাচিত হয়ে এখন স্থানীয় পর্যায়ে তারা উন্নয়নের অংশীদারনারী আজ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিতবাংলাদেশে এই প্রথম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নারীতা ছাড়া প্রশাসনিক ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীতে নারীর উপস্থিতি লক্ষণীয়উপরন্তু নারী আজ জজ-ব্যারিস্টার-বিচারকসহ রাষ্ট্র ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে অধিষ্ঠিত থেকে সমাজ, রাষ্ট্র, জাতির নানাভাবে সেবা করে যাচ্ছে; যার স্বপ্ন দেখেছিলেন নারী শিক্ষা, নারীমুক্তি আন্দোলনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন

    কারণ একসময় নারীসমাজের এ অবস্থা ছিল নাবেগম রোকেয়া যে সমাজে বেড়ে উঠেছেন সে সমাজ অন্ধকার ছিলতাই তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন মেয়েরা স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের অগ্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখবেউপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে তারা পুরুষের মতো জজ, ব্যারিস্টার, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, বিচারক, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক এমনকি দেশ পরিচালনাও করবেনসাংবাদিকতা পেশায়ও নারী সাহসী ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরে আন্তর্জাতিক নারী সাহসিকতার পুরস্কার পেয়েছেন ৭১ টেলিভিশন চ্যানেলের অপরাধবিষয়ক সাংবাদিক এবং নারী অধিকার কর্মী নাদিরা শারমীনএ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন নাদিরা শারমীনসাক্ষাতের পর নিশা দেশাই তার টুইটারে লিখেছেন আমি সাহসী বাংলাদেশি সাংবাদিক নাদিরা শারমীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সম্মানিত বোধ করছিতার উদ্যম শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিককের অনুপ্রেরণা'সুতরাং প্রকৃত শিক্ষা, সাহস, সততা, সৃজনশীলতা যে কোনো সাহসী কার্যক্রমের সুনাম বয়ে আনতে পারে

    সুতরাং নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন বিষয়টি এখন বহুল আলোচিতবর্তমানে আমাদের জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিকআবার দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারীএ বিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে নিরক্ষর, অবহেলিত, অদক্ষ রেখে দেশের উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়তাই সংবিধান নারী-পুরুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করেছেনারীর শিক্ষা অর্জন ও উন্নয়ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকার শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে নানা ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেফলে নারী শিক্ষায় আজ নতুন যুগের সূচনা হয়েছেআমাদের সংবিধান মোতাবেক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিকের শিক্ষা, সমঅধিকারসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেসরকার নারী-পুরুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের সব ধরনের নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা, সামাজিক দিক থেকে নারীসমাজকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যেও নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করেছেএ নীতিমালার মূল সূর হচ্ছে নারী জাতিকে শিক্ষায় সুশিক্ষিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নারী নির্যাতন প্রতিরোধতাই শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে নারীর সচেতনতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছেশিক্ষার আলো থেকে তাদের বঞ্চিত করে নারীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়আবার শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করে পুরুষের সমকক্ষতা অর্জন কখনো সম্ভব নয়তাই আমাদের সংবিধান মোতাবেক শিক্ষা গ্রহণ করে পুরুষের পাশাপাশি নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে 

    বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, নারীবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়ার নারী সম্পর্কিত একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ ও স্মরণীয় উক্তি করেন, 'কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং হয়ে ওঠে নারী'প্রাকৃতিক নিয়মে একটি শিশু জন্মের পর আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে তার নিজস্ব পরিবারেতাই পরিবারকে বলা হয় শাশ্বত বিদ্যালয়সে শিশুটি যখন উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষার মাধ্যমে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে প্রস্তুত করে তখন হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ মানুষতেমনি একজন কন্যাশিশুও শিক্ষার মাধ্যমে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেকে গড়ে তোলে তখন সে হয়ে ওঠে একজন পরিপূর্ণ নারীমুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বলেছেন, 'কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিত করিয়া কার্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক' বেগম রোকেয়ার সে কথার প্রতিফলন আজ আমরা সমাজে দেখতে পাচ্ছিশহর থেকে গ্রামে সর্বস্তরের নারীর ভেতর জাগরণের জোয়ার শুরু হয়েছেনারী আজ এগিয়ে যাচ্ছেমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের ভর্তির হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে১৯৯৪ সাল থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের উপবৃত্তি কার্যক্রম চালু হয়সে থেকে ছাত্রীরা অতি উৎসাহে স্কুলগামী হতে থাকে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে

    এ উপবৃত্তি প্রদানের সুফল হচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের উপস্থিতির সংখ্যা বেশিআবার ২০০২ সালে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে উপবৃত্তি কার্যক্রম শুরু হয়উপবৃত্তি প্রদানের কিছু নিয়ম-কানুন রয়েছেএকটি বিদ্যালয়ে প্রতি শ্রেণিতে মোট ছাত্রীর ৩০ ভাগ এবং মোট ছাত্রের ২০ ভাগ গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাবেআবার শিক্ষার্থীকে অবশ্যই ৭৫ ভাগ ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হবেপ্রতিটি পরীক্ষায় নূ্যনতম পাস নাম্বার পেতে হবেসর্বোপরি এসএসসি বা সমমান পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের আগেই উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে অবিবাহিত থাকতে হবেনারী শিক্ষা প্রসার, বাল্যবিয়ে ও ঝরে পড়া রোধসহ শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা হলেও এর পুরোপুরি সুফল অর্জিত হচ্ছে নাকারণ এখনো বাল্যবিয়ে, ঝরে পড়া রোধ বড় সমস্যাতবে তা সত্ত্বেও শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি ও শিক্ষা গ্রহণ বাড়ছেফলে অনেক নারী নিজের পায়ে দাঁড়াতেও পারছে। 

    বর্তমান যুগে বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র যেখানে আমাদের হাজারো সমস্যা, নাজুক অর্থনৈতিক অবস্থা ও আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যেখানে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অংশগ্রহণের জন্য প্রয়োজন শিক্ষাযুগের চাহিদা অনুযায়ী নারী শিক্ষার বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছেনারীর আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেইশিক্ষা ক্ষেত্রে নারীর উপস্থিতি যেমন বেড়েছে তেমনি নারী আজ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিতকিন্তু সচেতনতার অভাব, দারিদ্র্য, পরিবেশগত বিভিন্ন কারণে অনেক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিতআগেই উল্লেখ করা হয়েছে বাল্যবিয়ে রোধ, শিক্ষার হার বাড়ানোসহ বিভিন্ন কারণে উপবৃত্তি প্রদান করা হলেও বাল্যবিয়ে রোধ বা ঝরে পড়া বন্ধ করা যাচ্ছে নাতা ছাড়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ঘরের বাইরে এখন নিরাপদ নয়বিভিন্নভাবে তারা নির্যাতিত হচ্ছে

    সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিকসহ সব ক্ষেত্রেই নারীর ক্ষমতায়নে মাইলফলক সৃষ্টি করেছে বাংলাদেশবিশেষ করে গত এক দশকে নারীর ক্ষমতায়নে অর্থবহ অগ্রগতি হয়েছেনারী শিক্ষায় দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশমাধ্যমিক পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণের সূচকে এ অঞ্চলের প্রথম সারির ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ একটিসরকারি, বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি কৃষি, শিল্পসহ বিভিন্ন সেবার খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। 

    সুতরাং প্রকৃত শিক্ষার আলো প্রবেশ করাতে হবে নারীর সুকোমল অন্তর মানসপটে; যাতে একজন নারী সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে বেড়ে উঠতে পারেতবে এ বেড়ে ওঠার পথে নারী নির্যাতনসহ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবেকারণ নারী সমাজেরই অংশ। 

    নারীকে বাদ দিয়ে কোনো সমাজ এগিয়ে যেতে পারে নানারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশ যেমন এগিয়ে যাবে দেশের উন্নয়নে নারীর অবদান বাড়বে, তেমনি রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও নারীর ক্ষমতায়ন ঘটবেকাজেই নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই

    লেখকঃ মোহাম্মদ নজাবত আলী, বাংলাদেশ 
              শিক্ষক ও কলাম লেখক

    ছবিঋণঃ ইন্টারনেট হইতে সংগৃহীত
    ২৯শে মে ২০১৮ইং 
    3/related/default