কোনোদিন ভাবিনি 'স্বদেশ' শব্দটি এতো পরিপূর্ণতা এনে দিতে পারে জীবনে। যেদিন দেশ ছেড়ে পৃথিবীর অন্য-প্রান্তের এক অচিন দেশে পা রাখলাম, ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠলো মনে-- দূরে ফেলে আসা নিজের দেশ…স্বদেশ!
সময়ের সাথে গড়িয়ে যাওয়া স্রোত কিছু বিশেষ সময়কে স্মৃতির সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেয়। তাই ফিরে দেখা জীবন হয়ে ওঠে আমাদের কাছে অমূল্য! আমাদের সকলকেই জীবনের উঁচু-নিচু পথে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়, আর তা থেকে আমরা শিখিও অনেক কিছু। ঠিক কথা-- শেখার কোনো শেষ নেই। আমিও তাই শিখলাম অনেক কিছু।কখনো ঠেকে, কখনো ঠকে আবার কখনো ভালোবেসে।
প্রায় তিন যুগ আগে সাত-সাগর পাড়ি দিয়ে এক সম্পূর্ণ অচিন দেশ আমেরিকায় আসা আমার, জীবনের কিছু স্বপ্নকে সত্যি করার আশায়।
সেই তিন যুগ আগে আমার ছেড়ে আসা ছোট্ট মিষ্টি রাজ্য ত্রিপুরা ছিলো অনেক বেশি সাদাসিধে, আর অবশ্যইপশ্চিমী দুনিয়ার প্রভাব থেকে ছিলো শত-যোজন দূরে।
এমনি একটি রাজ্য থেকে আমেরিকায় এসে মানসিকভাবে নিজেকে খুবই বেমানান লাগতো অনেক সময়। কিন্তু --' America is the land of opportunities' -- মনকে সেটাইবুঝিয়েছিলাম আমি এবং উচ্চ-শিক্ষার জন্য বিদেশে আসা আমার বর, স্বপন l সেই থেকে ভালো-মন্দের উর্ধে আমাদের সমস্ত মনোযোগ ছিল পায়ের নিচের মাটি শক্ত করার দিকে।
প্রথম পর্যায়ের ঝড়-ঝাপ্টার কঠিন দিনগুলো পেরোনোর পর যখন আয়নার সামনে সুস্থির হয়ে দাঁড়াতাম, আমার সেই চেহারায় যেন আমিত্বের অভাবটা বড্ড বেশি করে চোখে পড়তো। এতো কিছুর ভিড়ে কোথাও নিজস্বতা পেতাম না, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব ছাড়া-- এক অসহনীয় সময় ছিল সেটা। মোবাইল ফোন তখনও বাজারে আসেনি। ইন্টারন্যাশনাল ফোনের প্রতি মিনিটের খরচ ছিল সাড়ে তিন ডলার -- যা ছিল তখন আমাদের সাধ্যের বাইরে।
শুধু বিভিন্ন মাস আর সময় বিশেষ মনেকরিয়ে দিতো আমাদের সব উৎসব-পার্বনের কথা। মন খারাপ করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
নিউইয়র্ক! আমার অচিন দেশের প্রথম শহর। পৃথিবীর ব্যস্ততম কয়েকটি শহরের অন্যতম একটি নাম।
যেখানে কখন দিনের শুরু আর কখন শেষ -- তা বোঝা মুশকিল। জীবন খোঁজার তাগিদে মানুষ ছুটে চলেছে দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন।
তারই মাঝে সময় বের করা, সময়কে উপভোগ করা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনার দিকে পা বাড়ানো।
শুরু করলাম বিদেশের বুকে বাংলাকে খোঁজা।
তখনকার সপ্তাহ শেষের ডাল- ভাত, মাছের ঝোলের নেমন্তন্নগুলো ছিল আমাদের আমেরিকার জীবনে বাঙালিয়ানার পথে পা রাখার প্রথম সিঁড়ি।
পরিচিত হলাম বিভিন্ন দেশ থেকে আসা বাঙালিদেরসাথে। দেখতে দেখতে পরিচিতির একটা মহল গড়ে উঠলো আমাদের।
যেখানে মাসি- মেসো, দাদা-বৌদি, ছোট ভাই-বোন -- বয়স ভেদে পারিবারিক ছোঁয়ায় গড়ে উঠলো সম্পর্ক। এখনো যখন ফেলে আসা দিনগুলোর কথা ভাবি, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই সব দিনগুলো!
ভালোলাগার স্মৃতির প্রথম পাতায় রয়েছে নিউইয়র্ক এ বাংলাদেশী এসোসিয়েশনের দুর্গাপূজা। হাজার লোকের ভিড়ে দেখেছি কর্মকর্তাদের মুখের অমলিন হাসি।
চার্চের এক বিশাল হলের ভেতরে ছিল পূজোর এবং সাংস্কৃতিকঅনুষ্ঠানের ব্যবস্থা।অন্যদিকে চার্চের রান্নাঘরে সকাল থেকে চলছিল রান্না। আন্তরিকতায় ভরা এতো বড় সমাবেশ এতো বছরেও আর কখনো দেখিনি ।
এই পূজো থেকে ফিরে এসে প্রথমবার আয়নায় নিজের চেহারায় খুশি দেখেছিলাম।
তারপর আরও কতো কী এলো ! বাঙালি প্রতিবেশীর বিয়েতে আল্পনা দিলাম, কনের বিয়ের পিঁড়ি সাজালাম, সাজালাম কনেকেও!
এমনি করে সম্পর্ক জুড়তে লাগলো আমাদের জীবনের সাথে আর আমরা নিজেদের মতোকরে বিদেশে গড়তে লাগলাম স্বপ্নের স্বদেশ।
চলবে....
লেখিকাঃ জবা চৌধুরী,আমেরিকা
ছবিঋণঃ লেখিকার সৌজন্যে
২১শে জুলাই ২০১৮ইং