Type Here to Get Search Results !

শিক্ষার মানোন্নয়নে অভিভাবক, অভিভাবিকা ও পরিবারের ভূমিকা:-- অতিথি কলামে শিক্ষিকা রীণা দাসের প্রতিবেদন

এ প্রসঙ্গের অবতারনার পূর্বে চীনা দার্শনিক ও শিক্ষাবিদের একটি উক্তির উল্লেখ করা প্রয়োজন।বলেছিলেন ,"তুমি যদি কম সময়ের মধ্যে ফল পেতে চাও তবে মৌসুমী ফসলের চাষ কর,যদি দীর্ঘমেয়াদী ফল পেতে চাও তবে ফলবান বৃক্ষ রোপন কর আর যদি সারা জীবনের জন্য ফল পেতে চাও তবে মানুষের চাষ কর।"
মানুষের চাষ মানুষই করবে।বীজ থেকে একদিন শিশু মানুষ হবে,শিশু মানুষ থেকে কিশোরাবস্হা,ক্রমান্বয়ে যৌবনাবস্হা সবশেষে মহীরূহে পরিণত হবে।মানবজীবনের এই চক্রাকার বৃদ্ধির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাবা মা।বাবা মায়েরাই পারেন সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে একটি দেবশিশুকে মহীরূহে পরিণত করতে।অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় সজাগ দৃষ্টি দিয়ে সমাজের বুকে শিশুর প্রতিভা বিকশিত করতে।

আমাদের দেশে  শিক্ষা  ,শিক্ষাব্যবস্হা,শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে জল্পনা কল্পনার অন্ত নেই।স্বাধীনতার আগে ও পরে এ নিয়ে বিভিন্ন কমিশন বসেছে।কিন্তু এযাবৎকালে কোন কমিশনেই শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান শিক্ষিকা মা কে সংযুক্ত করা হয় নি।শিক্ষার গুনগত মান অবনমনে এর কুফল অনস্বীকার্য।শিক্ষার প্রকৃত সংজ্ঞা যে অর্থে সার্বিক উন্নয়ন বুঝায় তা বাস্তবায়িত করতে হলে প্রথমেই শিশুর মাকে যুক্ত করতে হবে।তারপর ধীরে ধীরে পরিবারের  অন্যদের এই দায়ভার নিতে হবে।লক্ষ্যনীয় বিষয় হল শিক্ষাব্যবস্হায় বিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষার উপর যতটা জোর দেওয়া হয় ততটা পারিবারিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর জোর দেওয়া হয় না।অথচ দেখা যায় শিক্ষার মানের ভিত পরিবার থেকেই গঠন হয়।

শিক্ষাকে সুনিশ্চিত করতে হলে শিশু জন্মের পর থেকেই শিশুর শারিরীক বৃদ্ধি বা বিকাশের  সাথে সাথে মানসিক বিকাশের দিকটিও ভাবা প্রয়োজন মা বাবা সহ পরিবারের অন্যান্যদের।শিশু শিক্ষায় কোন পাঠ্যপুস্তকের প্রয়োজন থাকে না।অভিভাবক অভিভাবিকা বা বাবা মায়েরও প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রীধারী হতে হয় না।বাবা মা হওয়ার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত জীবনে চলার অভিজ্ঞতার নিরিখে হাঁটাচলার মাধ্যমে প্রকৃতির মধ্যে রেখেই বাস্তব শিক্ষা দেওয়া যেতে পারে।পুঁথিপাঠ সম্পূর্ণ শিক্ষা দিতে পারে না,নিরক্ষর বাবা মাও তার সন্তানকে পরিবার ও সমাজে চলার আদর্শ শিক্ষা দিতে পারে যদি মাতৃত্ব ও পিতৃত্ব বোধ জাগ্রত হয়।এমন সহস্র উদাহরণ আমরা পাই যেখানে বাবা মা নিরক্ষর কিন্তু সময়ে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সন্তানকে অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেছেন।আবার এমনও দেখা যায় সঠিক শিক্ষার অভাবে অনেক শিক্ষিত বাবা মায়ের সন্তানও সমাজের বুকে দিশেহারা হয়ে ঘুরে।

 একটা বয়স পর্যন্ত  বিদ্যালয়ের গন্ডী থেকে শিশু  সহস্র যোজন দূরে থাকে।শিশু কাঁচা মাটি থাকা অবস্হাতেই আকৃতিতে ফেলে গড়ন দেওয়া সহজ।মাটি শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেলে গড়ন আনা কঠিন।ওই ,যাকে বলা হয় গুনগত।গুনগত বিষয় কোন দৃশ্য বস্তু নয় বা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোরও নয়।গুনগত শিক্ষা একেকটা  পরিবার বা সমাজ বা দেশের কাছে একেকরকম।যেহেতু সমাজের আর্থ সামাজিক বিন্যাস ও বিকাশ একই ধারায় বয়ে যায় না কখনোই।সমাজের উচ্চবিত্ত ,মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত, এই তিন শ্রণীবিভাগের কাছে শিক্ষার গুনগত সংজ্ঞা ভিন্ন প্রকৃতির।একই সময়ে ,যে পাঠক্রমে যুক্ত হয়ে উচ্চবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা আকাশে উড়ার স্বপ্ন দেখে,সেই পাঠক্রমেই মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া ক‍রে সাধারন জীবন যাপনের চেষ্টায় নিয়োজিত থাকে।আবার একই পাঠক্রমে নিম্নবিত্তের ছেলেমেয়েরা পড়াশুনার চাইতে জীবন রক্ষার তাড়নায় রুটি রুজির ধান্দায় শিক্ষা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে চায়।
এমন অবস্হায় শিক্ষাকে প্রথমে সর্বজনীন করা প্রয়োজন,তারপর গুনমান নির্ধারণ।শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হলে প্রথমেই প্রয়োজন শিশুর পারিবারিক শিক্ষা।বর্তমানে সরকারী কাগজপত্রে বাবার নামের পাশে মায়ের নামকে মান্যতা দেয়া হয়েছে ঠিক কিন্তু শুধু পরিচয় পর্বে।অনেক ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনুধাবন করানো হয় নি।অনুসন্ধানে দেখা গেছে বর্তমান সময়েও অনেক বাবা মা কেবলমাত্র জন্ম দেওয়াকেই বাবা মায়ের প্রধান দায়িত্ব বলে মনে করেন।আলাপ আলোচনায় অংশগ্রহনের মাধ্যমে অভিভাবকদের উপর এ দায়িত্বটুকু বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
জন্মের পর অনেকটা শিক্ষা অতিক্রম করে তারপর দ্বিতীয় ধাপে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্হায় পা রাখে।এর আগেই গৃহ প্রতিষ্ঠানে তার শিক্ষা শুরু হয়ে যায়।পরিবার থেকে অর্জিত শিক্ষাগুলো রপ্ত করেই একটা শিশু বাইরের শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার চর্চা করতে আসে।পরিবারের সুশিক্ষা ও কুশিক্ষার সুফল কুফল পরবর্তী প্রজন্ম বয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

 একটা শিশু যখন পরিবারের গন্ডী পেরিয়ে স্কুলের গন্ডীতে প্রবেশ করে তখনও কিন্তু পরিবারের শিক্ষা থেমে যায় না।স্কুলের ভেতরে  যেমন শিক্ষকেরা ভূমিকা নেবেন তেমনি স্কুলের বাইরে অভিভাবক অভিভাবিকাদের শিক্ষাঙ্গনে থাকবে।তবেই শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটবে।

জগতের সমস্ত জীবই শিক্ষা গ্রহন করে প্রকৃতিতে সাজানো পরিবেশ থেকে।আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না।মানুষ ছাড়া অন্য জীবেরা পরিবার থেকেই শিখে নেয় সুশৃঙ্খলতা,নৈতিকতার শিক্ষা,জীবন যাপনের শিক্ষা।ক্ষুদ্র পিপিলীকা যা শিক্ষা দেয় মানুষের তৈরী পরিবার বা বিশাল প্রতিষ্ঠান এই শিক্ষা দিতে পারে কি না সন্দেহ।মা মুরগী তার ছোট ছানাপোনাকে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে যে খাদ্যাভ্যাস শেখায় তা পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দেওয়া অসম্ভব।

মানুষও শেখে।তবু তাকে একটা পরিকল্পিত ,সুনিয়ন্ত্রিত,বাঁধাধরা ,কৃত্রিম শিক্ষাব্যবস্হার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়।কৃত্রিম ব্যবস্হায় প্রবেশের আগেই প্রকৃতিগত শিক্ষা শিশুকে দিতে হয়,যা দেবে শিশুর বাবা মা ও পরিবারের অন্যান্যরা।শিক্ষাবিদরা বলেন শুধুমাত্র পুঁথিগত শিক্ষায় শিক্ষার পূর্ণতা আসে না,এর সাথে নৈতিক শিক্ষার মিশ্রণ ঘটাতে হয়।এই নৈতিক শিক্ষার হাতেখড়ি পরিবার থেকেই হয়।মহামানব মহম্মদ ( সা ) বলেন " একজন আদর্শ মা একটি আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় "।নেপোলিয়ান বলেছিলেন "আমাকে শিক্ষিত মা দাও,আমি শিক্ষিত জাতি দেব।"এ কথাগুলো থেকে বলা যায় যে সন্তানের নৈতিক চরিত্র গঠনে ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় অভিভাবিকা হিসাবে মায়ের ভূমিকা কতটুকু।

শিক্ষার মান উন্নয়নে পরিবারকে উদ্দিষ্ট করার কারণ হলো ,একটি শিশু ছয় ঘন্টা স্কুলে,বাকী সময়টুকু সে পরিবারেই অবস্হান করে।পরিবারের সবার কাছ থেকে শুনে দেখে ,তাদের শিক্ষা নিয়ে অনেক কিছু শিখতে পারে।যাকে বাস্তব শিক্ষা বলা হয়।প্রবাদে আছে--- " রাজবাড়ির বিড়ালটাও আড়াই অক্ষর শিখতে পারে।" পরিবেশ ও পারিবারিক অবস্হান শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করে।বিভিন্ন ধর্মগ্রন্হ পাঠেও এর সত্যতা পাওয়া যায়।পরিবা্রের অনুশাসন,ভালোবাসা,আদর্শের অভ্যাস,আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অভাবে অনেক ছেলেমেয়েরা পথভ্রষ্ট হচ্ছে।এর জন্য দায়ী পরিবার ও অভিভাবক অভিভাবিকাবৃন্দ।

পরিবার একজন শিশুকে সমাজের কাছে পরিচিত হবার সুযোগ করে দেয়।জন্মের পর থেকে শিশু তার পরিবারের সদস্য সদস্যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়।বাবা মায়ের আর্থ সামাজিক অবস্হান শিশুর মানসিক অবস্হান তৈরী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।পরিসংখ্যানে দেখা যায় পারিবারিক জটিলতার কারণেও ছেলেমেয়েদের মানসিক বিকাশ ব্যহত হয়।প্রতিনিয়ত বাবা মায়ের ঝগড়া,স্লাম এড়িয়া বা পাহাড়ী জনপদ বা যে কোন পরিবারে নেশাগ্রস্হ লোকের অবস্হান ডিভোর্সের মত ঘটনা ,শিশুর মনে আবছায়া ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে রাখে।  শিশুমন ধীরে ধীরে যখন পূর্ণতাপ্রাপ্তির দিকে এগোয় তখন শিশুবেলায় ঘটে যাওয়া বিষয়গুলোর রেশ তখনও তার অবচেতন মনে থেকে যায়।বর্তমানে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো পরতের উপর পরত সাজতে থাকে।এই সমস্ত ছেলেমেয়েরা অবসাদগ্রস্হ হয়ে পড়ে।পড়াশুনা ব্রাত্য ও অপাঙতেয় হয়।না পারে ছেলে মেয়ে সেই পরিবেশ ধরে রাখতে না পারে নিজেকে বের করে আনতে।যার ফলস্বরূপ সে হয় অমনোযোগী,স্কুল পালানোর ভাবনা,পড়াশুনার প্রতি অনাগ্রহ,কম বয়সে নেশাগ্রস্হ হয়ে পড়া,স্কুল কামাইয়ের মিথ্যা অজুহাত তৈরী করা,,এইসব রপ্ত হয়ে যায় জন্মের পর থেকেই  দিনে দিনে তার রূপ ও ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটে মাত্র।


একটা শিশু অনেকটা পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে স্কুলের গন্ডিতে পা রাখে।বিদ্যালয় নিঃসন্দেহে শিক্ষাকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে কিন্তু যেহেতু প্রাথমিক শিক্ষার বিষয়টি শিশুরা পরিবার থেকেই রপ্ত করে বেশী তাই পরিবারকেই আজীবন শিক্ষার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে হবে।তবেই শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব হবে।নয়তো গিনিপিগের মতো ছেলেমেয়েদের নিয়ে বিদ্যালয় নামক গবেষণাগারে গবেষণাই করা হবে।

রীণা দাস, শিক্ষিকা
ত্রিপুরা

১৭ই সেপ্টেম্বর ২০১৮ইং 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.