বোবা কান্নাঃ
ড. লুৎফর রহমান তার মহৎ জীবন বইতে লিখেছেন-
‘শুভ্র সুন্দর গৌরবের কিরণমালায়
যেখানে পৃথিবী হাসিয়া ওঠে
সেখানেই মানুষ জাগে,
অগৌরবের বিদীর্ণ অন্ধকারে কেউ’
উপরোক্ত কথাগুলো চরম সত্য। পৃথিবীর বুকে কোন সৃষ্টিই বৃহত্তর সত্যকে এড়িয়ে যেতে পারেনা। সর্বদা যা সুন্দর তাই দুচোখ ভরে দেখে। যা আনন্দঘন কেবলই তাই প্রানভরে উপভোগ করি। আবছা অন্ধকারে কেউ থাকতে চায়না দুর্বার বাসনা নিয়ে আলোতে আসার প্রয়াসে মত্ত সর্বক্ষণ। দুঃখ বেদনায় যদি কখনও সুখ প্রিয়াসীদের দ্বারে উপনিত হয়ে ও যায়, মনে করে পৃথিবীতে সেই বুঝি সবচেয়ে দুঃখী। কিন্তু একবারও কেউ চিন্তা করিনা সুখ, দুঃখ হাসি কান্না এদের বসবাস পাশাপাশি, চলার গতি ও সমান।
মহান আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির সেরা হিসাবে মানব জাতিকে আখ্যায়িত করেছেন। বাকি সমস্ত সৃষ্টি মানুষের কল্যাণের জন্য, ভোগের জন্য, ব্যবহারের জন্য। স্রষ্টার সৃষ্টি যা কিছু রয়েছে তার সব কিছু আমাদের ভোগ্য হিসেব করি। কিন্তু একবারও কি কেউ জানতে কিংবা বুঝতে চেয়েছি আমাদের ভোগের কিংবা ব্যবহারের যা কিছু দেখি তাদেরও তো দুঃখ কিংবা সুখ থাকতে পারে। তারা নিরাসত্য ভাবে নিজের জীবনকে অন্যের তরে বিলিয়ে দেয়। সর্বদায় অন্যকে সুখী করার জন্য নিজেকে সর্মপন করে। অন্যের সুখেই নিজের সুখ মনে করে।
আমাদের একটু সুখের জন্য, একটু বিলাসীতার জন্য বড় বড় চিত্রকর দিয়ে কত কিছুই না তৈরি করে থাকি, যা দেখে চারপাশের মানুষ গুলো প্রশংসায় পঞ্চমুখ, কে তৈরি করল, কোন কারিগর বানালো, ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু একবারও কেউ ভাবেনা এই সৌন্দর্যের অন্তরালে কোন উপকরন রয়েছে, যে নিজেকে নিঃশেষ করে দিলো অন্যের তরে।এ নিয়ে ভাবনা! সে তো বহুদূর। কারো মনে করার মতোও অবকাশ নেই।
সত্যিই স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ জীব বটে মানুষ কিন্তু স্বার্থপরতা তাদের সারাক্ষণ তাড়া করে ফিরে। নিজের সুখের জন্য অন্যকে ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু অন্যের দুঃখকে ভালবেসে জয় করতে যেন আমাদের হাজারো ও বাধা।অন্যকে দু’পায়ে মাড়িয়ে নিজের স্বার্থ সিদ্বিতে নিত্যান্ত অবিচল। প্রতিনিয়ত নিজেকে আনন্দের অবগাহনে গা ভাসাতে অন্যকে ব্যবহারে পরিতৃপ্ত।আমাদের সুখ আহরণে অন্যের কষ্টের উদয় হয় সেটা দেখেও না দেখার ভান করে পথ চলি।
ধরুন না বৃক্ষেরই কথা। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত নিজের জীবনকে অন্যের তরে নির্দ্বিধায় বিলিয়ে দেয়। অন্যের মাঝে নিজেকে বিলিয়ে আনন্দও পাওয়া পায়,কেনোনা আত্বদানই পরম সুখ। কিন্তু কখনও আবার স্বার্থান্বেষীদের কারনে কষ্ট ও পায়। যার উদাহরণ টেনে শেষ করা যাবেনা বৃক্ষের মহত্বের কথা।
তপ্ত দুপুরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত পথিক কে একটু জিড়িয়ে যাবার জন্য সর্বক্ষণ আহবান করে-
- হে ক্লান্ত পথিক একটু জিড়িয়ে যাও ভাই।
ক্লান্ত পথিক বৃক্ষের আহবানে তার নিজের প্রয়োজনে অবসন্ন শরীরে সুনিবিড় ছায়া তলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়। বৃক্ষ খুব খুশি হয় পথিকের ক্লান্তি দূর হওয়া দেখে। কিন্তু ক্লান্ত পথিক খানিকটা পরে সব ভুলে যাবার সময় কি করে সেই বৃক্ষের ডাল ধরে ভেঙ্গে ফেলে, পাতা ছিঁড়ে। সদ্য স্বস্তির নিঃশ্বাস নেয়া পথিকের কান্ড তখন বৃক্ষ আর সইতে পারেনা।
চিৎকার করে কাঁদে, আর বলে-
-জীবনে সব কিছু বিসর্জন দিয়ে যাদের জন্য নিজেকে ত্যাগ করলাম সে কি দিলো?
কিন্তু কেন এমন হয়?
তাজমহল দেখে পৃথিবীর সব লোকেই শাহজাহানের ভালোবাসার প্রশংসা করে। যে কারিগর তৈরি করল,কত দিনে কয়জনে করল ইত্যাদি ইতিহাসের পাতা স্থান দিলো। সর্বক্ষণ এর সৌন্দর্যের গুণকীর্তন। যা কিনা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আগ্রায়। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবেছে ঐ সৌন্দর্যের আবরণের ভিতরে লুকিয়ে থাকা একখণ্ড শ্বেত পাথরের কথা? না!সেই পাথরকে নিয়ে কেউ ভাবেনা। কেননা সেই নিজের সমস্ত হাসি কাঁন্না দুঃখ বেদনা পুঞ্জীভূত করে সুরম্য প্রাসাদটাকে দাঁড় করিয়ে রাখে। বাহিরে থেকে নাইবা কেউ দেখলো তবুও সে সুখী অন্যকে আনন্দ দিয়ে। আরসেখানেই তার স্বার্থকতা।পাথর এমন কিছু পেতে চায়না যে আনন্দ অল্পক্ষনের, অল্প পাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার বেদনা অনেক মধুর।
কিন্তু একদিন কোন এক সৌখিন প্রাসাদের বাহিরে ঘটল অন্য ঘটনা।
বিশাল সুরম্য প্রাসাদ। বাহিরে চার দেয়াল গাঁথা তার পাশে দিয়ে রাস্তা।
এক বিকেলে কোন এক উদাসী পথিক কর্ম ক্লান্ত শরীর নিয়ে সেই দেয়াল ঘেঁষে খানিকটা বসল। জীবনকে ঘিরে কত কি ভাবতে লাগলো। হঠাৎ তার সুরম্য প্রাসাদের সৌন্দর্য চোখে পড়ল। গভীর ভাবে অনেক কিছু চিন্তা করতে লাগলো।কিছুক্ষন পর উদাসী পথিক দেয়ালের গায়ে হাত রেখে বলতে লাগলো-
- হে পাথর তুমি আর কেঁদোনা, আমি তোমার কাঁন্না শুনতে পাই। জানি তোমার জন্য আমার কিছু করার নেই। কিন্তু তুমি অন্তত এইটুকু বিশ্বাস করো, তোমার লুকায়িত কষ্টের কথা আমি বুঝি। ঘুমরে ঘুমরে কাঁদার ধ্বনি আমার অন্তরে স্পন্দন জাগায়। পথিকের কথা শুনে দেয়ালের আবরণে ঢাকা পাথর হাসে আর ভাবে।
এ পথিকের ছেলেমানুষী,আবেগ, কেননা তার মতো পাথর কে কেউ ভালবাসেনী আর বাসতেও পারেনা।
উদাসী পথিক আবারও বলে-
-বিশ্বাস করো বোবা পাথর আমি তোমার কাঁন্না শুনতে পাচ্ছি।
উদাসী পথিকের দেয়ালে হাত রেখে কথাগুলো শুনে পাথর আর স্থির থাকতে পারেনা।
হঠাৎ বলে ওঠল,
-হে উদাসী পথিক, কি প্রয়োজন ছিলো সল্পক্ষণের জন্য ভালোবাসার কথা বলার।
আমিতো ভালই ছিলাম। তবে কেন ঘুম ভাঙ্গালে? তোমরা তো কালের আবর্তন আর স্বার্থ ফুরালেই চলে যাবে। বোবা কাঁন্না শুনে করুণা হচ্ছে বুঝি?
উদাসী পথিক বলে-
-না, পাথর তোমার প্রতি আমার কিছু করণীয় নেই এই সত্য ধ্রব যেন। কিন্তু তোমাকে ভালবাসি এটাও সত্য যেন। পাথর বলে-
-তোমার এ মোহ আমাকে করুণা আর শান্তনার জন্যই।
হে উদাসী পথিক তুমি কি এক টুকরো পাথর আর ঢেউয়ের গল্প জানো”?
উদাসী পথিক মাথা নেড়ে জানালো না।
শোন তাহলে সেই গল্প-
আমার মতো একখণ্ড পাথর ছিলো। কোন একদিন কারো প্রয়োজনের বশে কেউ একজন সমুদ্র তীরে ফেলে দেয়। পাথর টুকরো ভাবে সে বুঝি কাউকে ভালবেসে কোথাও আর কোন ঠাঁইপাবেনা।
এক বুক কষ্ট নিয়ে সমুদ্রতীরে বালিতে পড়ে আছে। হঠাৎ সমুদ্র তীরেজলোচ্ছ্বাসে ভেসে এলো উত্তাল ঢেউ। এমনি করে রোজরোজ ঢেউ তীরে আসে আবার ফিরে যায়।
একদিন ঢেউ এসে বালিতে অনাদরে পড়ে থাকা পাথরটুকু কে বলে-
-হে পাথর তুমি আমার বুকে আসো। আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি আমার বুকে আসো। পাথর টুকরো ভাবে এটা ঢেঊয়ের নেহাতই বোকামী, ঢেউ আবার ও পাথরকে একই কথা বলে আর পাথরও ঢেউয়ের কথা শুনে হাসে।
আমাকে কেউ ভালবাসতে পারেনা। এইভাবে রোজরোজ ঢেউ তীরে এসে পাথরকে বলে তার ভালোবাসার কথা। একদিন পাথর আর ঢেউয়ের কাঁন্না আর সইতে পারেনা। সব কিছু ভুলে উত্তাল ঢেউয়ের আহবানে সারা দিয়ে ঢেউয়ের বুকে ঝাঁপ দেয়।
কথা গুলো বলতে বলতে পাথর কিছুটা নীরব হয়ে যায়।
উদাসী পথিক জিজ্ঞাসা করে থামলে কেন,
-তারপর?
- তারপর! পাথর ঢেউয়ের বুকে ঝাঁপ দিয়ে হাবুডুবু খেতে খেতে এক সময় সমুদ্রের তলদেশে হারিয়ে যায়।
-আর ঢেউ?
-আর ঢেউয়ের কথা বলছ?
পাথরকে হারানোর ব্যাথায় ক’দিন খুব কাঁদে,
তারপর হারিয়ে যায় সমুদ্রের গহিন অতলে, নতুনের সন্ধানে।ছবিঋণঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
খোরশেদ আলম বিপ্লব,বাংলাদেশ
২০শে জুলাই ২০১৯