মানতো না রমা এই সব অদ্ভুতুরে নিয়ম কানুন। খুব যুক্তি পূর্ণ ছিল ওর সমস্ত বক্তব্য। নারী স্বাধীনতা নিয়ে অনেক কথা বলত। স্কুলে সবার প্রিয় দিদিমনি ছিল । দুইছেলে আর এক মেয়ের মা রমা তারপর একদিন প্রোমোশন পেয়ে বড়দিদিমনি হলো। ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তবুও শাঁখা সিঁদুর এর অযৌক্তিকতা নিয়ে সে অনেক লেখা লেখি করত। তখন নেটের যুগ ছিলনা। বিভিন্ন পত্রিকা তে লিখত সে। পুজো পালি এইসব নানান ধর্মীয় অমলুক নিয়ম কানুনের কথা। বেশ একটা পার্সোনালিটি গড়ে উঠেছিল তার। নিজেও পরতোনা শাঁখা সিঁদুর । কপালে ছোট্ট একটা টিপ আর অতী সাধারণ একটা ছাপা শাড়ি। একটু মাইল্ড কালার ই পছন্দ করত বেশিরভাগ সময় । শাশুড়ি ভীষণ খুঁত খুঁত করলেও খুব ভালো ব্যাবহারের জন্য আবার বৌমা বেশ প্রিয়ও ছিল উনার।
ডাকসাইটে ব্যাবসায়ী রমার স্বামী উমাপতি খুব গুরুগম্ভীর টাইপের মানুষ ছিলেন। অনেকদূর দূর অবধি বেশ নাম ডাক ছিল উনার। পোশাক আসাক খাবার দাবারে ছিলেন বেশ শৌখিন। রমার উল্টোটা। তবু রমার কাজকে বেশি ঘাটাতেননা। কিন্তু ইদানিং রমার নাম ডাকে যেন একটু ঈর্ষাই বোধ করতে লাগলেন। একটু অসন্তুষ্ট যেন থাকতেন তিনি স্ত্রীর উপর।
এরপর আসতে লাগলো এপাড়া ও পাড়া থেকে ডাক রমার, তার বক্তব্যের জন্য। অনেক পুরুষ মানুষ রমার চারপাশে ঘুর ঘুর করতে লাগলো। রমার ও একটু অস্বস্তি যে হতো না তা নয় ।
একদিন উমাপতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রমাকে চিবিয়ে চিবিয়ে কয়টি কথা বললেন-
-ঠিক করে সিঁদুরটা অবধি দাওনা, শাঁখা পলা তো নেইই-
কিসব মাদা মাদা রঙের শাড়ি পর। আমি কি মরে গেছি নাকি। নাকি আর পছন্দ নয় আমায় -- বিয়ে করার ইচ্ছে নাকি আরেকটা!!!
হতভম্ব হয়ে গেল রমা। কান চাপা দিল তাড়াতাড়ি। কিছুই বললনা জবাবে। মুখে কুলুপ এঁটে চুপ করে বসে রইল ঘর অন্ধকার করে।
পরদিন তার স্কুলে তাঁকে অন্যরূপে দেখলো সবাই। লাল টুকটুকে বড় সিঁদুরের ফোটায় যেন দুর্গা দেবী । সোনা বাধানো শাঁখা পলা। এড়িয়ে যেতে লাগলো সে সবার প্রশ্নের। এর পর থেকে অদ্ভুত ভাবে বন্ধ করে দিল সে নারীর প্রগতিশীলতার কথা নারীবাদীতার কথা।
নাহ এটুকু পড়ে সেটা মনে করবেন না যে উমাপতির ধমকে সে থেমে গেছে। সে থেমে গেছে আরো বিভিন্ন ষড়যন্ত্রের কারনে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর। বদনাম সে বাইরে থেকেও শুনতে পাচ্ছিল।প্রতিবাদি প্রগতিশীল নারীর বিরুদ্ধে বদনাম হল মেইন হাতিয়ার যে। তাই রমা আড়াল নিল শাঁখা সিঁদুরের।
এই ভাবে দিন কেটে যেতে থাকে। আস্তে আস্তে বিয়ে হল রমার মেয়ে রিম্পার। ছেলেদের ও যথাসময়ে বিয়ে থা দিয়ে সামান্য কিছু রোগভোগ করেই ইহলোক ত্যাগ করলেন উমাপতি।
টকটকে লাল সিঁদুর স্বামীর পায়ে মুছিয়ে দেওয়া হল রমার। শাঁখাপলা শক্ত ইটের চাঙড় দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়া হল-
নিজেকে আয়নায় দেখে এবার ভয় পেয়ে গেল রমা।
একটু যেন থিতিয়ে গেল মনোবল।
তাও সে একটু মাইল্ড কালারের শাড়ী ই পরতে লাগলো। কপালে কালো ছোট্ট টিপ। হাতে দুজোড়া বালা।
এই নিয়েই সে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হচ্ছিল যেন।
কিন্তু বেড়ে গেল দুই বৌ আর ছেলের অভব্যতা। বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন তারা ভীষণ ভয় করত বাবাকে তাই টু শব্দটি অবধি করতনা।কিন্তু বাবা মারা যাবার পর পর ই সম্পত্তি ভাগের জন্য উঠে পড়ে লাগলো যেন দুই ভাই। রমা এইসব দেখে শুনে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।রমার কোন কথাই ওরা শুনতোনা। একটু ভাবলো রমা। তারপর-
হঠাত একদিন প্রচন্ড প্রগতিশীল রমা পরনে নিয়ে নিল সাদা ধবধবে কাপড়। কপালে দিলো চন্দনের তিলক। আর সারা অঙ্গে খরিমাটির তিলক আঁকলো। শাশুড়ির ঠাকুর ঘরে গেলো। যে ঠাকুর ঘরে রমা শুধু শাশুড়ি মা প্রসাদ দিতে ডাকলেই যেতো। কোলে তুলে নিলো কুলদেবতা রাধামাধবকে।কুলপুরোহিত কে ডেকে জেনে নিলো সমস্ত নিয়ম কানুন পুজো উপাচারের।
খুঁতখুঁতে স্বভাবের হয়ে উঠল সে অচিরেই। বৌদের উপর প্রচন্ড খিটখিটে মেজাজ।
--- এই তোমরা চান করনি কেন সক্কাল সক্কাল! তাই আমার ঘরে আসবেনা।
এই তোমরা ঐ দিকে ঘুরে যাও আমি ঠাকুরের জল নেবো-
সম্পুর্ন নিয়ম নিষ্ঠা মেনে নিরামিষ ভোজী হল রমা। এহেন আচরণে ভয় পেয়ে গেল ছেলে বৌরা। ওরা আর ঘাঁটালোনা রমাকে। শক্ত হাতে সমস্ত কিছু দেখসন করতে লাগলো রমা। স্বামী র ব্যবসা পত্তর। সব নিজের একেবারে কন্ট্রোলে-
কিন্তু এইসমস্ত কিছুই নজর এড়ালোনা রিম্পার। এত আধুনিক মা তার এইরকম হয়ে গেল!!একদিন বাড়িতে গেল রিম্পা। মাকে জিজ্ঞেস করল-
- তুমি এমন কেন করছ মা!! তুমি তো এমন ছিলেনা। ছাড়ো এই সাদা থান। ছাড়ো তোমার নিরামিষ খাওয়া। বৌদিদের সাথেও কেন এমন করছ মা!! এই রূপে তোমাকে যে ভালো লাগছেনা মা।
কোন কথাই না শুনে রমা বলল-
-- চা খাবি!!
বলে উঠে ওর নিরামিষ চুলায় চায়ের জল বসালো।
রিম্পা পিছু পিছু গিয়ে বলল-
- আমার কথার জবাব দাও মা। কেন তুমি-
রমা একটু উদাস হয়ে রইল-
- এরপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-
-- আড়াল ওরে আড়াল। আমি এই পার্সোনালিটির আড়ালে আমার আগের ঐ পার্সোনালিটি কে ঢেকে দিয়েছি। নইলে যে তোর বাবার ব্যাবসা পত্তর আর এই সংসার বাঁচাতে পারবোনা।
রিম্পা বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চায়ের জল ফুটছিল । চাপাতা দেবার সময় হয়ে এসেছে-
--- শর্মিষ্ঠা চৌধুরী , আগরতলা
১৩ই জুলাই ২০১৯