Type Here to Get Search Results !

মাটির ব্যাংকে জমানো ১৫ আগস্ট

গতমাসে এক শুক্রবার সকালে গিয়েছিলাম ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে। ১৫ আগস্টের কান্নাভেজা বাড়িটায়। এর আগের দুই বার যখন এসেছিলাম, তখনো এদিনের মতোই কাঁদছিল আকাশটা। কী এক অদ্ভুত কাকতাল! ভেতরে ঢুকতেই বুকটা কেমন ভারী লাগে। এই আঙিনা জাতির পিতার! বইতে পড়া ১৫ আগস্ট আর এই বাড়ির বোবা আঙিনার বুকে ধরে রাখা ১৫ আগস্টে পার্থক্য সামান্যই। তবে, এই আঙিনা কিছু না বলেও বুঝিয়ে দেয় একটু বেশি কিছুই। এ বাড়ির রান্নাঘর, কবুতরের ঘর, সিঁড়ি কিংবা শোবার ঘর...সবকিছুই বছরের পর বছর ধরে পাথরের মূর্তির মতো স্থবির হয়ে আছে থেমে থাকা ঘড়ির মতো। তবে, আজও আচারের বয়ামে লেগে। আছে বঙ্গমাতার হাতের ছোঁয়া, দেয়ালে গুলির চিহ্নটা এখনও যেন তাজা, রক্তমাখা কাপড় থেকে এখনও ঝগছে খুনে লাল রং আর পিতার নিথর শরীরকে আগলে রাখা সিঁড়িটা পড়ে আছে নিজেই নিথর।স্পন্দনবিহীন। এ বাসায় নতুন বিয়ের উৎসব আর হবে না কোনদিন, শেখ কামালের তিনতলার ছাদে সেতারের সুর বাজবে না কোনোদিন কিংবা নিভে যাওয়া পাইপে আগুন জ্বলবে না আর কখনও। খাবার টেবিলের প্লেটগুলো উল্টে খাবার খাবে না কেউ, পুরাতন কোকের বোতলটার ছিপি খুললে উঠবে না বুঁদবুদের ঢেউ। উপরের বর্ণনার সবটুকু প্রথম দুবারে যেয়েই দেখেছি। আপনারা যারা গিয়েছেন তারাও দেখেছেন আশা করি। এবার চোখ খুঁজছিল না দেখা কিছু, কিংবা নজর এড়িয়ে যাওয়া এমন কিছু যা সত্যিকার অর্থে জানতে শেখাবে নতুন কিছু, বুঝতে শিখাবে ১৫ আগস্টকে নতুনভাবে। লেখার এই অংশে এসে ফিরে যাই দুই বছর আগের কোনো একটা সংবাদপত্রের একটা সংবাদে। কুমিল্লার একজন রাজমিস্ত্রী জাতির পিতার প্রতি ভালোবাসা আর ভক্তি থেকে ৪১ বছর ধরে করে চলেছেন অসামান্য এক কাজ। প্রতি বছর ১৫ আগস্ট এলেই তার মাটির ব্যাংকে জমানো টাকা দিয়ে কাঙ্গালিভোজের আয়োজন করেন। ১-২ বছর হলেও বিষয়টি এতদিন মাথায় থাকতো না হয়তো। কিন্তু, ৪১ বছরে ওই মাটির ব্যাংকে শুধু কাঙ্গালিভোজের টাকাই জমেনি, জমেছে একরাশ ভালোবাসা। তা এই লেখায় এড়িয়ে যাবো কিভাবে? আবার ৩২ নম্বরে ফিরি। এবার নতুন কী দেখলাম তা বলবার পালা। জাতির পিতার শোবার ঘরের মাথার কাছে দেখেছি একটা মাটির ব্যাংক। ওই মুহূর্তেই মনে পড়েছে কুমিল্লার ওই সংবাদটা। এই মাটির ব্যাংকটি ভাবনার অন্য জগতে নিয়ে গেল। একজন রাষ্ট্রপ্রধানের বাসায় মাটির ব্যাংক কেমন যেন বেমানান মনে হতে পারে, তাই না? মানুষটা বঙ্গবন্ধু বলেই হয়তো মানিয়ে যায় অনায়াসেই।কারণ, তিনি শেকড়ের কোনোকিছুই দূরে ঠেলে দেননি কোনোদিন। কার ছিল মাটির ব্যাংকটা? জাতির পিতার নিজের? বঙ্গমাতার খুচরো জমার? নাকি ছেলেবেলা থেকেই শিশু রাসেলকে সঞ্চয়ের শিক্ষা দেবার মাধ্যম ছিল ওটা? এখনও কি হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করলে শৈশবের চেনা ঝনঝন শব্দে বেজে উঠবে ভেতরের মুদ্রাগুলো? ছুঁয়ে দেখা যায় না এখনো ঘরের কোনোকিছুই। তাই দূর থেকে দেখা মাটির ব্যাংকটি আমার কাছে একটা প্রশ্নব্যাংক হয়েই থেকে যায়। একটা অবাক ব্যাপার হলো, বাসার প্রায় সবকিছু হন্তারকেরা তছনছ করে দিলেও অক্ষত আছে মাটির ব্যাংকটা। একটা ছোট্ট মাটির ব্যাংক নিয়ে এত কথা বলায় বিরক্ত হতে পারেন। তবে, আমার কাছে ওই ক্ষুদ্র জিনিসটাই মনে ধরে আছে এখনও অবধি। কেন? কুমিল্লার সেই রাজমিস্ত্রীর মাটির ব্যাংকে জমেছে ভালোবাসা। আর ৩২ নম্বরের এই মাটির ব্যাংকে জমেছে আর্তনাদ, হাহাকার, চাপা কান্না আর এক সমুদ্র শোক। কর্তৃপক্ষের কাছে বিশেষ অনুরোধ, সাবধানে রাখবেন মাটির ব্যাংকটা। ওটা কোনোভাবে অসাবধানতায় মাটিতে পড়ে ভেঙে গেলে বাতাসে ছড়াবে গুমোট বেদনা আর পুরো আকাশ ছেয়ে যাবে বছর-বছর ধরে জমে থাকা কষ্টের কালো মেঘে। হয়তো চিরতরে। আমার চোখ বেয়ে গড়ানো দু’ফোঁটা অশ্রুও তো জমে আছে ওই মাটির ব্যাংকে! এ শোক সইবার নয়, এ ভার বইবার নয়।

মনদীপ ঘরাই
সিনিয়র সহকারী সচিব,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

১৫ই আগস্ট ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.