Type Here to Get Search Results !

"শেষ থেকেই হোক শুরু"... নারীদের জীবনসংগ্রাম নিয়ে বাংলাদেশ থেকে লিখলেন সালমা তালুকদার​

আমার পাশে রিক্সায় বসেছিল।তার স্বামী ফোন দিল তখন।আর আমি স্পষ্ট দেখলাম মেয়েটির হাত কাঁপছে।মুখের মাংসপেশি পর্যন্ত কাঁপছে। মেয়েটি রিক্সাওয়ালাকে বললো,"ভাই তাড়াতাড়ি চালান।" আমি শুধু তার হাত ধরে ছিলাম। আর ভাবছিলাম ঐ লোকটি আমাদের সামনে কত ভালো আর স্ত্রীর কাছে সে জীবন্ত একটা বিভীষিকা। এটা ২০১১ সালের ঘটনা।
একটা শিক্ষিত মেয়ে সে। বুয়েট থেকে তার লেখাপড়া শেষ করেছে। এখন দুই সন্তানের মা। তার দিন কাটে সংসার করে আর বাচ্চাদের দেখাশোনা করে। মা হিসেবে সন্তানের জন্য যতটুকু করা প্রয়োজন তার চাইতেও বেশি করে। তবু সন্তানের অসুখ হলে তার স্বামী তাকে বাজে ভাবে বকে। বুকের ভেতর গিয়ে আঘাত করে এমন কথা শোনায়। আর মেয়েটি তাই প্রতিদিন চেষ্টা করে কোনো ভাবেই যেন সন্তান ব্যাথা না পায়। আমার চোখের সামনে একদিন তার একটি বাচ্চা মাথায় আঘাত পেয়েছিল। মেয়েটির চোখে মুখে কি দারুণ ভয় আমি দেখেছি! ভাবছিলো কি করে বাচ্চার ব্যাথার জায়গাটি স্বামী বাড়ি আসার আগে লুকানো যায়।সালটা ছিলো ২০১৬ ইং।
মেয়েটি ডাক্তার। স্বামী চায় মেয়েটি চাকরী করুক আর বাকি সময় তাকে দিক। মেয়েটির নিজেকে দেয়ার জন্য কোনো আলাদা সময় থাকবে না। মেয়েটির স্বামী সন্তান ছাড়া কোনো জগৎ থাকবে না।কিন্তু মেয়েটি যখন সংসার,সন্তান, বাচ্চা পালনে পাগল প্রায় হয়ে একটু নিঃশ্বাস নেয়ার জন্য কারো সাথে গল্প করতে যায় অথবা নিজের কোনো প্রয়োজনে একটু বাইরে যায় তখন তার এই চিন্তা নিয়ে বাইরে যাওয়া লাগে যে,বাসায় ফিরলে একটা দারুণ ঝড়ের মুখোমুখি হতে হবে। এবং এই ঝড়টা সে কি করে মোকাবিলা করবে সেই ভয়ে তার হৃৎপিণ্ড ধরাস ধরাস করে বাড়ি খেতে থাকে।এটা ২০১৯ সালের ঘটনা।
সময় বয়ে চলে।সবাই বলে পরিবর্তন হচ্ছে। একে কি পরিবর্তন বলে! আমি নারীদের জীবনচক্রের পরিবর্তনের কথা বলছি। নারীরা সমাজটাকে চলমান রেখেছে। তবু নারীরা নিজেরাই চলতে পারে না। তাদের হাত পা মমতার শিকলে বন্দী। অসহায় কন্ঠে চিৎকার করতে চায় কিন্তু চিৎকার করতে গিয়ে দেখে তাদের কন্ঠ দিয়ে কোনো শব্দ বের হয় না। খুব বেশি করে মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে যায় যখন নারীরা বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হয়। সংসারের মায়ার বাঁধন এমন আষ্টেপৃষ্টে বিবাহিত নারীদের বেঁধে ফেলে যে তারা চাইলেও আর সামনে এগুতে পারে না।​
যারা সব বাঁধা অতিক্রম করে সত্যি সত্যি সামনে এগিয়েছে তারা কেউ হারিয়েছে নিজ পরিবার। কেউ হারিয়েছে নিজের সতিত্ব। কেউবা আবার ঘনিষ্ঠ কাছের মানুষ। এই সব নারীরা সমাজে নারী অধিকারের পক্ষে ঝান্ডা হাতে নিয়ে সবার আগে দাঁড়িয়ে।​
যারা নিজের জীবনে সংগ্রাম করতে গিয়ে নানা বাঁধা অতিক্রম করেছে,তারা নিজেদের প্রতিনিধি তৈরী করে অসহায় নারীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাদের মুখের ভাষাকে অনেকে অশ্লিল বলে। তারা কাউকে পরোয়া করে না বলে মা বাবারা নিজ সন্তানকে তাদের থেকে দূরে রাখে। অথচ এদেরও একসময় স্বপ্ন ছিলো ছোট সংসারের। মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে এরাও চেয়েছিলো ছোট জীবনটা কোনো রকমে পার করে দিতে।
উপরে যেসব নারীদের জীবনের কথা দিয়ে শুরু করেছি এরা এখনো জীবনযুদ্ধে প্রতিদিন সংগ্রাম করছে। এখনো স্বামীর অন্যায় গুলো দেখেও দেখছে না। এরাই হয়তো একদিন সব ঝেরে ফেলে সামনে এগোবে তখন সমাজের চোখে এরা হবে বেয়াদব, পথভ্রষ্ট। অথচ যখন এরা কষ্ট করেছে তখন কেউ তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।
তবু এভাবেই প্রতিটি নারীর সামনে এগুনো দরকার। পরিবারকে বন্ধু হিসেবে পাশে না পেলেও নিজেকে অসহায় ভাবার কোনো কারণ নেই। সৃষ্টিকর্তা আলাদা ভাবে মানুষের রিজিক নির্ধারণ করেছেন।শুধু একটু সাহস ও সদিচ্ছার প্রয়োজন।

সালমা তালুকদার​
লেখিকা ও প্রাবন্ধিক
যশোর সেনানিবাস​ , বাংলাদেশ

৩রা আগস্ট ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.