আবু আলী, ঢাকা ॥
ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানি সংক্রান্ত দুই ঘোষণায় বাংলাদেশে পেঁয়াজের বাজার অস্থির হয়ে পড়েছে। দেশটিতে সারাবছর পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ মেট্টিক টন। এর বিপরীতে উৎপাদিত হয় ২৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্টিক টন। তবে সংরক্ষণ ও সরবরাহের সময় ৩০ শতাংশ পেঁয়াজ নষ্ট হয়। ফলে দেশটির মোট ১০ থেকে ১২ লাখ মেট্টিক টন আমদানি করতে হয়। এর সিংহভাগই আমদানী হয় ভারত থেকে। তবে এবছর মহারাষ্ট্রের ভয়াবহ বন্যায় ভারতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বিবেচনা করে সেপ্টেম্বরের দ্বিদীয় সপ্তাহে পেয়াজের রপ্তানি মূল্য আড়াশ ডলার থেকে সাড়ে ৮শ ডলারে উন্নীত করার ঘোষণা দেয়। ওই সময় বাংলাদেশে প্রতিকেজি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। কিন্তু ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ ঘোষণায় একদিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি৭ পেঁয়াজে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা বৃদ্ধি পায়। ফলে ভারতের দুই ঘোষণায় দুই সপ্তাহেগর ব্যবধানে দেশিটিতে প্রতিকেজিতে দাম বেড়েছে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা।
দেশটির পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, আমদানিকারকরা তাদের ফোন করে জানিয়েছেন, ভারত ও মিয়ানমারের পেঁয়াজ ৭৫ টাকার নীচে বিক্রি করবেন না। কারণ ভারত সরকার পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করেছে। অন্যদিকে দেশে পেঁয়াজের স্বাভাবিক মজুদ থাকলেও সরবাহে একটি ব্যবসায়ী মহল কারসাজির চেষ্টা করছে। অবশ্য এ ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, এখন ডিজিটাল যুগ। ফলে কাউকে জানাতে হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়লে অটেমেটিক্যালি দেশে খবর চলে আসে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, বাজারে পোঁজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রধান করে দশটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে এসব টিম বাজার পর্যবেক্ষন করবে। বিশেষ করে বৃহত্তর ফরিদপুর ও পাবনা অঞ্চলে এসব টিম কাজ করবে।
বাজার পরিস্থিতি : রবিবার সকালেও যে পেয়াজ বিক্রি হয়েছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় সোমবার সকালে তা বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা কেজি। রাজধানীর কোথাও কোথাও আবার ১২০ টাকা দরেও বিক্রি হয়েছে পেঁয়াজ। অন্যদিকে আমদানিকৃত পেঁয়াজের মূল্য ৯০ থেকে ১০০ টাকা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের পেঁয়াজের পাইকার মোহাম্মদ ফয়েজ জানান, আগেরদিন সকালে পাইকারি বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি করেছি ৭২ থেকে ৭৫ টাকায়। সন্ধ্যায় দাম বেড়ে হয় ৮০ থেকে ৮২ টাকা। গতকাল সকাল থেকে দাম আরও বেড়ে হয়েছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা।
তিনি আরও বলেন, সকালে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ হঠাৎ কমে যাওয়ায় অনেক বিক্রেতাই পেঁয়াজ কিনতে পারেননি। এখন পরিস্থিতি এমন যে, বিক্রেতার চেয়ে পেঁয়াজের ক্রেতার সংখ্যাই বেশি বাজারে।
একই কথা জানালেন রাজধানীর মালিবাগ বাজারের পেঁয়াজের পাইকার মো. শাহাবুদ্দিনও। তিনি বলেন, রবিবার থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত দুই লাফে বেড়েছে পেঁয়াজের দাম। কারন হিসাবে তিনি বলেন, ভারত সরকারের ঘোষণার পর আমাদের অনেক আমদানিকারকদের পেঁয়াজের ট্রাক আটকে দেওয়া হয়েছে বর্ডারের ওই পারে। তাই সকাল থেকে মোকামে পেয়াজের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। আমি বহু কষ্টে ২০০ কেজি পেয়াজ সংগ্রহ করেছি। কিন্তু অনেক ব্যবসায়ীরা আজ পেয়াজ কিনতেই পারেননি।
শ্যাম বাজারের মিতালী বাণিজ্যালয়ের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী কানাই সাহা জানান, আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় কম করে হলেও পেঁয়াজ আমদানি চালু ছিলো। তবে গতকাল হঠাৎ করেই তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের পেয়াজের বাজার আরও অস্থির হয়ে উঠেছে। আজ সকাল থেকেই দাম বেড়ে গেছে। শিগগিরই অন্য দেশ থেকে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ আমদানি করা না গেলে আগামী কয়েকদিনে দাম আরও বাড়তে পারে।
এদিকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলো ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি পাল্লা (৫ কেজি) দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৫২০ টাকায়। কিন্তু প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা দরে। এছাড়া আমদানিকৃত মিয়ানমারের পেঁয়াজের পাল্লা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়।
অন্যদিকে খুচরা পর্যায়ে মুদির দোকানগুলোতে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা দরে। দাম বাড়ানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তারা জানান, দাম আমাদের হাতে নেই। আমরা যে দামে পাই, সে দামেই তো বেচবো। মোকামেই দাম বেড়ে গিয়েছে।
দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম প্রতিকেজি ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে এ ব্যাপারে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিনকে প্রশ্ন করলে তিনি বলছেন, দেশীয় ও আমদানি করা পেঁয়াজের সন্তোষজনক মজুত রয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই। যারা মজুত করবেন এবং বাজারকে অস্থির করার চেষ্টা করবেন তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সঙ্গে মঙ্গলবার থেকে টিসিবির মাধ্যমে ১৬ স্থানের পরিবর্তে রাজধানীতে ৩৫ স্থানে ট্রাকের মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রি করা হবে বলেও জানান তিনি।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে পেঁয়াজ নিয়ে কোনো সমস্যা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য আমরা কৃষি ও অন্যান্য মন্ত্রণালয় নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা নিচ্ছি। আমাদের ঘাটতি খুব বেশি নয়। যেহেতু আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজেই পেঁয়াজ, রসুন, আদা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে পদক্ষেপ নিয়েছি। যাতে ভবিষ্যতে আমদানির দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়।
ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধের খবরে একটু সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘আমরা বসে নেই। এ বিষয় নিয়ে আজ (সোমবার) সকালে বসেছিলাম। একটি ভালো খবর হলো, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ আনার যে প্রক্রিয়া ছিল সেটার দুটি জাহাজ এসে পৌঁছেছে নৌবন্দরে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি জাহাজের পেঁয়াজ গতকাল (রবিবার) খালাস হয়েছে।
মিয়ানমার থেকে দুটি চ্যানেলে পেঁয়াজ আমদানি করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘একটা বর্ডার ট্রেড হিসেবে আসে টেকনাফ দিয়ে। এটা চলমান। একটা হলো ফরমাল চ্যানেলের মাধ্যমে নৌবন্দর দিয়ে। এছাড়া তুরস্ক ও মিসর থেকে পেঁয়াজ আনার প্রক্রিয়া চলমান। আসতে যতটা সময় লাগতে পারে। তবে সময়টা আমি বলতে চাচ্ছি না। যেকোনো মুহূর্তে আসতে পারে।
এদিকে দেশিয় উৎপাদন না বাড়িযে যতই পেঁয়াজ আমদানি করা হোক না কেন তা কার্যকরি হবে না বলে মন্তব্য করেছেন কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তিনি বলেন, আমদানি করে তাৎক্ষণিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করা সম্ভব। তবে তা টেকসই সমাধান নয়। কাজেই বাজার নিয়ন্ত্রণে দেশে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়াতে হবে। আমদানি নির্ভরতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।
সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে ২৪ লাখ মেট্টিক টন পেঁয়াজের চাহিদা রয়েছে। এরমধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে ২৩ লাখ ৭০ হাজার মেট্টিক টন উৎপাদিত হয়। এরমধ্যে ৩০ শতাংশ সংগ্রহ এবং সংরক্ষণের সময় নষ্ট হয়। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে ১৬ লাখ ৩১ হাজার মেট্টিক টন পেঁয়াজ সরবরাহ করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১১ লাখ ৩১ হাজার মেট্টিক টন পেঁয়াজের এলসি খোলা হয়েছে। এরমধ্যে নিস্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ৯১ হাজার মেট্টিক টন।
৩০শে সেপ্টেম্বর ২০১৯