Type Here to Get Search Results !

সরি ক্যাপ্টেন ! ......... আগরতলা থেকে ফিরে সমীর চক্রবর্তী,আখাউড়া,বাংলাদেশ

সমীর চক্রবর্তী, আগরতলা থেকে ফিরে:
জানি আমার এই ছোট্ট ‘সরি’ টুকু আপনার কাছে পৌঁছাবে না। আপনার কাছে পৌঁছানোর সব মাধ্যম আজ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। তবে বেশ কিছুদিন ধরে আমার মনের মাঝে যে তীব্র যন্ত্রনা এবং অপরাধবোধ কাজ করছে সেখান থেকে প্রতিক্ষণে সরি শব্দটি উচ্চারিত হচ্ছে। দীর্ঘ ৪৮ বছর পর একজন বিভুতি রঞ্জন চ্যাটার্জি আমার চিন্তার জগতে গভীর প্রভাব ফেলেছেন। লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে আমার স্বাভাবিক জীবন যাত্রা।
আপনার খোঁজে যখন প্রিয় শহর আগরতলার এদিক সেদিক চষে বেড়াচ্ছি তখন চোখের সামনে ভাসছে, আপনি হয়তো একটি মারো হাফ প্যান্ট পরে হাজারো মুক্তিসেনার সামনে বুকে হাত দিয়ে গাইছেন ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ অথবা লুঙ্গি পরে জঙ্গল মাড়িয়ে ঢুকে যাচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশে। পাকসেনাদের কুপোকাত করতে ক্যাম্প অধিনায়ক হয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ভরাট কণ্ঠে কমান্ড দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন মুক্তিসেনার দল, যাদের হাতে অল্পবিস্তর থ্রি নট থ্রির সাথে উপজাতিদের তৈরি বিশেষ গাদা বন্দুক অথবা ডামি রাইফেল। কারো পরনে লুঙ্গি কারো পরনে ছেড়া শার্ট। নিরন্ন এই মানুষদের নিয়ে আপনার যুদ্ধ জয়ে এগিয়ে যাওয়ার সাহস কারো কারো চোখে হয়তো হাস্যকর ঠেকেছে তখন। কিন্তু আপনার হাতে গড়া সেই মানুষগুলো বাঁশের লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বিদায় করেছে তখনকার বিশ্বের পরাক্রমশালী পাকবাহিনীকে। আপনাকে আমাদের হাজারো কুর্নিশ।
সরি ক্যাপ্টেন, আমরা আপনাকে যথাযথ সম্মান দিতে পারিনি। দুর্দান্ত প্রতাপে চীন এবং কাশ্মীর যুদ্ধ শেষে আপনি যখন জন্মভিটা ত্রিপুরায় এলেন তখন ‘ত্রিপুরার চালকরা’ ঠিকই চিনতে পেরেছিল আপনাকে। যার কারণেই নির্যাতিত বাঙালির মশাল হয়েছিলেন আপনি। নিজের পাঁচশ’ কানি ফল বাগান আর টিলা উজাড় করে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য। লালমাটির এই বিস্তৃত চরাচরেই বাংলার দামাল ছেলেদের চলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ। ত্রিপুরার চড়িলামের গঙ্গা যমুনা নামের সেই বেইজক্যাম্প মুখরিত হয়ে উঠেছিল জয় বাংলা ধ্বনিতে। জাতীয় সংগীতের সুরে ভোর আসতো সেখানে। প্রায় আট হাজার মুক্তিযোদ্ধার সেই দ্রোণাচার্য যখন আক্ষেপ নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় তখন আমরা ব্যথিত হই, লজ্জায় লাল হই। চড়িলামের বাসিন্ধা বিপুল ভৌমিক বলেছিলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য চড়িলামের ছেলেবুড়ো সবাই আমৃত্যু আপনাকে সম্মানসূচক ‘স্যার’ ডাকতেন। এখনো আপনার বীরগাঁথা গল্প হয়ে ধরা দেয় গল্পবলা মায়েদের মুখে। নিজে অসাধারণ হলেও খুব সাধারণ থাকতেন আপনি। মাটির দেয়ালে ছনের ছাউনি। লম্বা বারান্দায় বাঁশের মাঁচা। কাঠে দড়ি পাকানো একটি খাটিয়া, জল রাখার একটি মাটির ঠেলা আর রেডিও ছিল আপনার সম্বল। তবে হারিকেনের টিপটিপ আলোতেও আপনার ঘরটি নাকি ছিল সূর্যের মতো আলোকিত। কারণ ভেতরে যে একজন দেবদূতের বাস। নিজের ফল বাগান উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন চড়িলামের গণমানুষকে। পাড়ার যুবকদের বারংবার বলতেন ‘ফল খেলে বল হবেরে’। বিপুল ভৌমিক বলছিলেন, নিজেদের প্রিয় স্যারকে আজো তারা খুব মিস করে। আপনাকে রেঁধে খাওয়াতো স্বপ্না নামের যে কিশোরি সে আজো আপনার জন্য চোখের জল ফেলে। রাজনীতির বেড়াজালে আপনাকে সম্মান না দেয়া তাদের বিক্ষুব্দ করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী সম্মাননা প্রাপ্ত আগরতলার অধ্যাপক মিহির দেব বলেছিলেন, আপনি ছিলেন একজন ক্লান্তিহীন সেনা অধিনায়ক। সাফল্য বার বার আপনার পা ছুঁয়েছে। ত্রিপুরার সাংবাদিক শুভ্রজিৎ ভট্টচার্য বলেন, এখনো চড়িলামের ক্যাম্প জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে সমর বিদ্যার খুটিনাটি। লাল মাটির টিলায় ছড়িয়ে থাকা ব্যাংকারগুলো এখনো তাদের শক্তি যোগায়। চড়িলামের পরিমল চৌমুহনীর ব্রিজ থেকে দক্ষিণ দিকে এঁকেবেকে গেছে লাল মাটির পথ। সেই পথ ধরে মানুষ আজো খুঁজে ফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের আতুরঘর গঙ্গা যমুনা ক্যাম্প। স্মৃতি হাতড়ে তারা ব্যথিত হয়। কারণ চ্যাটার্জির ইতিহাসে ধুলোর প্রলেপ।

বাবার প্রসঙ্গ তুলতেই চোখ ভিজে আসে আপনার ছেলে রাজীব চ্যাটার্জির। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনার নানা দলিল এখনো আগলে রেখেছেন তিনি। শিশুর মতো কান্না করে বলছিলেন, বাবার মৃত্যুর পর বাংলাদেশ হাইকমিশনের ফুল তার কাছে কাঁটার মতো লেগেছিল। কারণ মৃত্যুর আগে তার বাবা সম্মান পাওয়া তো দূরের কথা একটি বারের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত পাননি। শেখ হাসিনাকে না দেখার আক্ষেপ নিয়েই পা বাড়িয়েছেন পরপারে। মুক্তিযুদ্ধে মৈত্রী সম্মাননা প্রাপ্ত ত্রিপুরার উদয়পুরের স্বপন ভট্টাচার্যও আক্ষেপ নিয়ে বলছিলেন, চ্যাটার্জির ইতিহাস কেউ মনে রাখেনি। অথছ মানুষটা প্রতিবেশি দেশের জন্য সব উজার করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কিংবা ভারতের পক্ষ থেকে সম্মান না পাওয়ার বিষয়টি তাকেও ব্যাথিত করে। মি. চ্যাটার্জি, আমি জানি যোদ্ধারা কোনদিন প্রতিদান আশা করেনা। কিন্তু বাংলার দামাল ছেলেদের চোখে স্বপ্ন বুনে দেয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩৩ কর্গ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন বিভুতি রঞ্জন চ্যাটার্জি কেন একটি বার শেখ হাসিনাকে না দেখার আক্ষেপ নিয়ে মৃত্যু বরণ করবেন, সেটা আমাকেও তাড়িত করে। আমি জানি মৃত্যুর পর বাংলাদেশ হাইকমিশনের মালা দেখে হয়তো উপর থেকে আপনি মুচকি হেসেছেন। তবে এটা নিশ্চিত জানি পাথরচাপা থাকা আপনার বীরত্বের কাহিনী বাংলার মায়েরা কোন একদিন তার সন্তানদের শুনাবে। আপনার কাছে অনুপ্রাণিত হয়ে এই বাংলার দামাল ছেলেরা প্যালেস্তাইনের মানুষের পাশে দাঁড়াবে। আপনার গল্প অনুপ্রেরণা জোগাবে উগান্ডা কিংবা ইথিউপিয়ায় শান্তি রক্ষায় নিয়োজিত বীর বাঙালিদের। আপনি আমাদের ক্ষমা করুন প্রিয় ক্যাপ্টেন। থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন।
লেখক: সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠক, আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিষ্ঠাতা, স্বেচ্ছায় রক্তদানের সংগঠন ‘আত্মীয়’ আখাউড়া

২৭শে অক্টোবর ২০১৯

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.