অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে প্রতিদিন কোনো না কোনো নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই। আর এই বিভিন্নরকম অভিজ্ঞতা থেকে যেটুকু উপলব্ধি করি তার থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু কথা তুলে ধরছি।
আমি যে ক্লাসে আছি,সেখানে মোট ছয় জন শিশু। বয়সের ভিন্নতার সাথে তাদের আচরণের পার্থক্যও আছে। অর্থাৎ ছয় জন শিশু ছয় রকম আচরণ করে। নিয়মানুযায়ী একজন অটিস্টিক শিশুর জন্য একজন স্পেশাল এডুকেটর প্রয়োজন। যদি তা সম্ভব না হয় তবে দু'জন অটিস্টিক শিশুর জন্য একজন স্পেশাল এডুকেটর দিলেও হয়। যা আসলে বিভিন্ন পরিস্থিতির জন্য সম্ভব হয় না। সেটা হতে পারে জনবল সংকুলানের জন্য, হতে পারে দক্ষতার অভাবের কারণে,হতে পারে এসব শিশুদের নিয়ে কাজ করার অনাগ্রহের জন্য এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কারণটা আমি মনে করি,সেটা হচ্ছে বেতন সংক্রান্ত বিষয়ক জটিলতা।
কারণ এই কাজটা পুরোটাই আসলে সেবা। যারা ভালোবেসে এই কাজে আসবেন,তারা তাদের পুরোটাই দেবেন। সেই তুলনায় মাস শেষে বেতনের পরিমানটা কম। কারণ নরমাল বিদ্যালয় গুলোতে অবিভাবকেরা নিজের ইচ্ছায় বেতন দেন। তারা জানেন এখানে বিনিয়োগ করে কোনো লস নেই।আর অটিস্টিক শিশুদের বাবা মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিজেদের উপরে বোঝা মনে করেন। আমরা যদি নিজেদের সন্তানদের দ্বারা ভবিষ্যতে আমাদের ভরনপোষণের কথা চিন্তা করি,সেক্ষেত্রে একজন বাবা অথবা মা তার অটিস্টিক সন্তানকে অবশ্যই তাদের নিজেদের এবং সমাজের বোঝা মনে করবেন। এটা তাদের জন্য একটি চরম সত্যি কথা। তাই সেই সন্তানের পেছনে বিনিয়োগ করাকেও তারা অপচয় মনে করবেন। আর তাই প্রতিষ্ঠানের খরচ বহন করতে অনীহা প্রকাশ করেন।
অথচ অভিভাবকদের সহযোগিতার মাধ্যমেই এই সব প্রতিষ্ঠানের উত্তরোত্তর সাফল্য সম্ভব। সেটা স্পেশাল এডুকেটরদের জন্য অনুপ্রেরণার অংশ হবে এবং প্রতিষ্ঠানে অটিস্টিক শিশুদের মেধা বিকাশে যেসব প্রয়োজনীয় উপাদান প্রয়োজন সেসবেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকবে।
কিন্তু যেহেতু বেশির ভাগ অভিভাবেরা মনে করেন যে, "প্রতিষ্ঠানে দিলাম শুধু নিজে কিছুক্ষন ফ্রী থাকার জন্য।" সেহেতু প্রতিষ্ঠানের ব্যায় বহনে তাদের অনীহা প্রকাশ করা স্বাভাবিক। আর এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, অটিস্টিক শিশুদের ব্যাপারে বাবা মায়েদের কোনো জ্ঞান না থাকা।
যারা এই সব শিশুর বাবা মা হন তাদের অনেক রকম পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। পরিবার,সমাজ,আত্মীয় স্বজন প্রতিনিয়ত তাদের হেয় প্রতিপন্ন করেন। যেন এরকম সন্তান জন্ম দেয়ার পেছনে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ আছে। আমি নিজেও আমার ক্লাসের অটিস্টিক শিশুর অভিভাবককে বলতে শুনেছি, "কোন পাপের ফল আমি পেয়েছি! মাঝে মাঝে মনে হয় আমি নিজে মরি,আমার সন্তানটাকেও মেরে ফেলি। আর জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য হয় না।" বলেই পরক্ষনে আবার নিজের এই অটিস্টিক সন্তানকেই জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছেন। কিন্তু যতই উনি আদর করুন না কেন, একবার ঘুনাক্ষরে ও টের পেলেন না একটু আগে তার মুখের দুটো কথা দিয়ে তিনি তার আদরের সন্তানের কত বড় একটা ক্ষতি করে ফেললেন।
আমরা ভাবি এই সব শিশুরা কিছু বোঝে না। অথচ এরাই সবচেয়ে বেশি বোঝে। অভিভাবকের মুখের হাসি,অসাধারণ ধৈর্যই পারে অটিস্টিক শিশুদের কিছুটা স্বাভাবিক করে তুলতে। অনেক সময় এই সব শিশু সমাজের অনেক রকম উপকারে আসে। দক্ষ জনশক্তি হিসেবেও কাজে লাগে। আর একজন অটিস্টিক শিশু যখন সমাজের কোনো একটা সেক্টরে নিজের দক্ষতা প্রমান করতে পারবে,একটা দেশের ও পরিবারের জন্য এরচেয়ে সুখের কথা আর কি হতে পারে। তবে এরজন্য অভিভাবকদের অসীম ধৈর্য্যের পরিচয় দিতে হবে এবং বুকে কষ্ট অথচ মুখে হাসি নিয়ে তার এই শিশুকে সৃষ্টিকর্তার পক্ষ থেকে উপহার মনে করে কাজ করে যেতে হবে।
যদি ধর্মীয় লাইনে কথা বলি,তাহলে বলবো একজন অটিস্টিক শিশু যেসব পরিবারে আছে সেসব পরিবার আপাত দৃষ্টিতে কষ্টে আছে মনে করলেও আদতে তাদের জন্য এটা আল্লাহ'র পক্ষ থেকে গুনাহ মাফের একটা কৌশল। এই মানব সন্তানটির পেছনে যারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তারা সৃষ্টিকর্তার প্রিয় বান্দা অবশ্যই। এই ব্যাপারটা তারাই বুঝবেন,যাদের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান আছে।
এই সব শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছে অটিস্টিক শিশুদের বাবা মায়েদের জানা প্রয়োজন অটিজম কি এবং কেন হয়। কি করলে এই সব শিশুদের সমাজের স্বাভাবিক গন্ডিতে ঢোকানো সম্ভব। তাহলে অভিভাবকেরা সময় মতো সন্তানকে প্রতিষ্ঠানে দিবেন এবং স্পেশাল এডুকেটর ও থেরাপিস্টদের উপর আস্থা রাখতে পারবেন। অনেক পড়ালেখার মাধ্যমে এই সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। তবেই সন্তানকে বোঝা মনে না করে প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয় তৈরি করে তাদের ভালোর পথে,আলোর পথে নিয়ে আসতে পারবেন। তবে এখানে একটা কথা আমি অবশ্যই বলবো যে, অটিস্টিক শিশুদের সমস্যাই হচ্ছে আচরণ গত সমস্যা। সবার আগে এসব শিশুদের আচরণ ঠিক করে তবেই একাডেমিক দক্ষতায় এগোতে হবে। যেটা সম্পর্কে অভিভাবকেরা এখনো অজ্ঞতায় নিমজ্জিত।
অটিস্টিক শিশুদের অভিভাবকগন অনেক বেশি সেনসিটিভ হয়ে থাকেন। তার উপর আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদের আরো বেশি সেনসিটিভ করে তোলে। তবে অবিভাবকদের যদি এ সম্পর্কে ধারনা থাকে,তাহলে তারা নিজেরা এসব শিশুদের নিয়ে অনেক ভালো কাজ করতে পারবেন। এবং সমাজের নেগেটিভ পরিবেশকেও সহজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠান ও পরিবারের সমন্বিত কাজের মাধ্যমে একজন অটিস্টিক শিশুকে তার আচরণ গত সমস্যা থেকে বের করে আনা সম্ভব। এবং তাকেও দক্ষ জনশক্তিতে রুপান্তরিত করা সম্ভব। তবে তার আগে চাই অটিস্টিক শিশুর অভিভাবকদের এই সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং নেগেটিভ মানসিকতা পরিহার করা। এসব শিশু সম্পর্কে সমাজের মানসিকতা বদল হয়তো হবে কোনো এক সময়। কিন্তু তাই বলে তো আমরা সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করে আমাদের সন্তানদের কষ্ট দিতে পারি না।
অটিস্টিক শিশু নিজেরাও জানে না তারা কি করছে। হাসি,কান্না, সুখ,দুঃখ,সমাজে পরিবেশে মেলামেশার নিয়ম,ক্ষুধার প্রকাশ এমন আরো অনেক স্বাভাবিক আচরণ সম্পর্কে এরা অবহিত নয়। সুতরাং আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হবে ধৈর্য্য নিয়ে এসব শিশুকে তাদের আচরণ গত সমস্যা থেকে বের করে আনা। সুস্থ হোক সমাজ ও পরিবেশ।মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হোক। কোমলমতি এসব শিশুদের জন্য নিশ্চিন্ত আবাস গড়ে উঠুক।
সালমা তালুকদার
স্পেশাল এডুকেটর
প্রয়াস,যশোর অঞ্চল
২৩শে অক্টোবর ২০১৯




