ঢাকা, বাংলাদেশ: এই কদিন ধরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে কত ধরণের মেসেজ পাচ্ছি, কত ধরনের অভিজ্ঞতা যে তারা লিখে জানাচ্ছে… সব পড়া সম্ভব নয়, অমানবিকতার চূড়ান্ত... এই তালিকায় ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারসহ অনেকেই আছেন যারা নাম প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেছেন। সারাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে/মেডিক্যাল কলেজে পড়ুয়া অথবা সাবেক শিক্ষার্থীদের এসব মেসেজ, যারা জানাচ্ছেন তারা কিভাবে ছাত্র হলগুলোতে বসবাস করেন/করতেন, কিভাবে ছাত্র নেতাদের অনুগত হয়ে থাকতে হয়, রাজনৈতিক আনুগত্যের সেই সংস্কৃতি নিয়ে নানা তথ্য দিচ্ছেন প্রতিদিন। আমাকে কেন দিচ্ছেন, সেই উত্তর আমার জানা নেই। হয়তো আশা করছেন, আমি যেন লিখি। কিন্তু এই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলা দরকার আমাদের সকলের, যেন দেশজুড়ে বিদ্যমান অপরাজনীতি বন্ধ হয় । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও দেখা যাচ্ছে, ক্যাসিনো মালিকদের যেমন টর্চার সেল খুঁজে পাওয়া গেছে, তেমনি অনেক ছাত্র হলগুলোতে এই ধরণের টর্চার সেল আছে। গণমাধ্যমেই দেখলাম এক বুয়েটেই ১০ টা টর্চার সেল পাওয়া গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানের টর্চার সেল সহ সকল ধরণের অপকর্মের নথি পত্র সংগ্রহ করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গণমাধ্যম কর্মীদের বলেছেন। দেখা যাক, গণমাধ্যম এখন কতটা সক্রিয় ভূমিকা রাখে! এখনই সময় এসব টর্চার সেল খুঁজে বের করার এবং ধ্বংস করে দেবার।
ছাত্র রাজনীতি বিষয়টাই এখন একটা ত্রাসের নাম হয়ে গেছে, যদিও তার একটা সোনালি অতীত ছিল, বাঙালির জীবনে ছাত্র রাজনীতি ঐতিহ্য ও অহংকারের বিষয় ছিল। এর জন্য কেবল শিক্ষার্থীদের দায়ী করলে হবেনা, দায় নিতে হবে আমাদের সকলকে। তারুণ্য এর রাজনীতি হবে সমাজের আদর্শ, অথচ আজ তরুণেরা নিজেরাই আদর্শচ্যুত। তারুণ্যের এই আদর্শচ্যুতির জন্য আমরা প্রত্যেকে দায়ী- এই পুঁজিবাদী সমাজ, এই রাষ্ট্র, শিক্ষক রাজনীতি, প্রশাসন, দুর্বল গণমাধ্যম, মিথ্যা প্রচার-প্রোপাগান্ডা, আমি-আপনি সকলে। আমরা শিক্ষকরা যেমন এই দায় এড়াতে পারবো না, তেমনি পারবেনা জাতীয় রাজনীতির চরিত্র, প্রশাসন, অভিভাবকগণ কেউই। যার যার প্রয়োজনে আমরা সকলে মিলে তারুণ্যের সৌন্দর্যকে, তারুণ্যের শক্তিকে ধ্বংস করেছি। শুধু ছাত্র নেতাদের কাছ থেকে শুদ্ধতা আশা করা কতটুকু বাস্তবসম্মত যেখানে শুদ্ধতা নেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়? এখন যখন আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন এসেছে, তখন তারুণ্যকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা হতে বিরত হবার নানা পথ খুঁজে বেড়াচ্ছি। আর সেই পথের মাঝে প্রথমেই এসেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা!
কিন্তু মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলা তো সমাধান নয়, বরং ডাক্তার দেখানো, ডায়ালাইসিস করানো, কেন মাথা ব্যথা হচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধান করে বের করা, ঔষধ খাওয়া, ইত্যাদি ব্যবস্থার কথা চিন্তা করা বুদ্ধিমানের কাজ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের একটি প্লাটফর্ম না থাকলে শিক্ষার্থীদের স্বার্থ, তাদের দাবি দাওয়া উত্থাপন হবে কিভাবে? প্রশাসন তো তাহলে যেভাবে খুশি সেভাবে পরিচালনা করবে, ডাইনিং হলের খাবার এর দাম বাড়ানো থেকে শুরু করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিজের মতো করে নেবে। শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস, শিক্ষার্থীদের পড়া-লেখার জন্য প্রতিষ্ঠান, অথচ শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্ব থাকবেনা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায়, তাতো হয়না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সামগ্রিকভাবে দেশের চলমান বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাসী কার্যক্রম, দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আওয়াজ তুলতে ছাত্র রাজনীতির কি কোনো বিকল্প আছে? এখন আমাদের ভাবতে হবে, শিক্ষার্থীদের এই রাজনীতির ধরন ধারণ কিভাবে ভিন্নতর হতে হবে এখনের ত্রাসের রাজনীতি হতে?
এইজন্য আমূল পরিবর্তন আনতে হবে ছাত্র রাজনীতি ধারনায়নে। এই যে এখন বুয়েট ক্যাম্পাসে আবরার হত্যার দাবী নিয়ে শিক্ষার্থীরা মিছিল-সমাবেশ করছে, এখানেই লুকিয়ে আছে ছাত্র রাজনীতির সত্যিকারের চিত্র, যে চিত্র দেখার স্বপ্ন দেখে প্রতিটি সাধারণ শিক্ষার্থী। যেখানে একটি বিষয়ে সকল দল-মতের শিক্ষার্থীরা একত্রিত হবে- তা হল, দেশের যেকোনো অন্যায়-অবিচার- বৈষম্যের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। এই যে তারুণ্য এখন নিপীড়কের বিরুদ্ধে দিন রাত এক করে শ্লোগান তুলছে, প্রশাসন বরাবর দফায় দফায় দাবী তুলছে, একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে ঘিরে সারাদেশ কাঁপিয়ে দিচ্ছে এটাই তো তারুণ্যের ধর্ম! এই ধর্ম থেকে তারুণ্য কতটা সরে গেলো, তা যেন আবরার মরে গিয়ে আমাদের জানান দিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ কোনো সমাধান নয়, প্রয়োজন সংস্কারের। আজ যদি রাজনীতি বন্ধ করে দেয় প্রশাসন তার ক্ষমতাবলে, কাল হতে কোন অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা কঠিন হয়ে পড়বে শিক্ষার্থীদের জন্য, যা জাতি হিসেবে আমাদের পিছিয়ে যাওয়া হবে।
সোজা কথায়, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নয়, মূলত জাতীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করা জরুরি, দরকার ছাত্রদের কল্যাণে একটি সংসদ, একটি পাটাতন, যেখান হতে শিক্ষার্থীদের সাথে প্রশাসনের আলোচনা হবে, দাবী দাওয়া নিয়ে আলাপ হবে, প্রয়োজনে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখে মতামত দেবে, রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ করবে একেবারেই শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে সামনে রেখে। এই ছাত্র কল্যাণ সমিতি/সংসদে প্রতিবছর নির্বাচন হবে, সাধারণ যেকোনো ছাত্র যেমন স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারবে, তেমনি কোন ছাত্র সংগঠনের পক্ষ হতেও করতে পারে, তবে তা মূল সংগঠনের মদদপুষ্ট হবেনা, কারণ তাতে জাতীয় দলের ইমেজই নষ্ট হয়। গত কয়েক দশকে ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল তাদের জাতীয় দলের ইমেজ বাড়িয়েছে এমন উধাহরন খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। তাই মতাদর্শগত মিল থাকতে পারে, কিন্তু কোন ক্ষমতা সম্পর্ক কিংবা লেজুড়বৃত্তি করা যাবেনা। এখন লেজুড়বৃত্তি বন্ধ করতে সবাই একমত কিনা, সেই প্রসঙ্গে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু ছাত্র রাজনীতি বন্ধ নিয়ে আলাপ অনেকটাই শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অধিকার হরণের মতো হয়ে যাবে বিষয়টি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতির ক্ষেত্রে যে জায়গাগুলোতে সংস্কার দরকার বলে মনে হচ্ছে-
১. রাজনীতিতে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের মন মানসিকতার পরিবর্তন! যারা ছাত্র রাজনীতি করবে, তাদের একমাত্র লক্ষ্য থাকবে ছাত্রদের কল্যাণ সাধন। এই তরুণ বয়সেই যদি রাজনীতিতে নাম লিখেই একটি মোটর সাইকেল পাওয়া, উপর থেকে টাকা পাওয়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরাজন করা, হলের ভেতরে টর্চার সেল বানানো, মদ খাওয়া, জুয়া খেলা, একটি দামী মোবাইল ব্যবহার করার ইচ্ছা জাগে অপকর্মের মধ্যদিয়ে, তাহলে তার কাছ থেকে এই জাতি কি পাবে? সারাটা জীবন তার সামনে, তারুণ্যেই যদি একজন এতোটা অবিবেচক, লোভী ও পাষাণ হয়ে যায়, তবে বাকি জীবন সে কতটা অপকর্ম করবে, ভেবে দেখতে হবে। জীবনে খারাপ কাজ করাতে কোন আনন্দ নেই, আছে ভাল মানুষ হওয়ার মাঝে, অন্যের উপকার করার মাঝে। যেমন একটা উধাহরন দেই, বঙ্গবন্ধু নিজের গায়ের চাদর দিয়ে এসেছিলেন যার গায়ে চাদর নেই, এমন কাউকে। সেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করতে আসা ছাত্রদের কেউ কেউ মদ খেয়ে টর্চার সেল বানিয়ে সাধারণ ছাত্রদের পিটিয়ে মারে, চোখ তুলে নেয়? তাহলে সেই নেতারা কি করে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি করে? আমি নিশ্চিত এসব নেতারা বঙ্গবন্ধুর উপর লেখা কোন বই পড়েনি, পড়লে তাঁর আদর্শের রাজনীতি করে সাধারণের উপর এই অমানবিক নির্যাতন করতে হাত কেঁপে উঠত। আর এটাও মনে রাখা জরুরী, এই সময়টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের। এখন কেউ কোন অপকর্ম করে খুব বেশি ঢেকে রাখতে পারবেনা, প্রকাশ পাবেই, তাই অপকর্ম করার আগে পরবর্তীতে কি ফলাফল ভোগ করতে হবে, সেটাও মাথায় রাখা জরুরি।
একটা চক্র আছে সমাজে, যারা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে নিজেরা লাভবান হয়ে উঠেন। তারা বিভিন্ন সময় ছাত্রদের নানা রকম প্রলোভনে ফেলে একধরনের ইলুশন তৈরি করেন।
এই পুঁজিবাদী সমাজও এই ইলুশন তৈরির পেছনে দায়ী, এই সমাজ এমন ধারনা দিয়েছে যে, নেতা মানেই দামী গাড়ী চালিয়ে আসবে, দামী পাঞ্জাবি, দামী সানগ্লাস-জুতা পড়বে, তবেই না সে বড় নেতা! সেই যে শুরু হয় এসবের খোঁজ, তা হতে এক দুষ্ট চক্রের ভেতরে পড়ে যায়। এই ইলুশন কে এড়িয়ে যারা চলতে পারে, তারা কিন্তু খারাপ পথে পা বাড়ায় না। ছাত্র রাজনীতি পুরোটাই নষ্টদের দখলে চলে গেছে, এই কথা সাধারণীকরণ করে বলা যাবেনা এই সঠিক পথে থাকা ছাত্র নেতাদের জন্য। তবে এই সংখ্যা আজকের দিনে খুব কম কারণ, সুচতুর ঐ কুচক্রী মহল তাদের ক্ষমতা বা পদ-পদবি হতে সরিয়ে দেয় হাতের পুতুল বানাতে পারেনি বলে। ফলে ভালোরা ছিটকে পড়ে রাজনীতির মাঠ হতে, যেমনটি ঘটে জাতীয় রাজনীতির মাঠেও। কদিন আগেই আমরা দেখতে পেলাম, অনুপ্রবেশকারীরা বা নব্য নেতারা কিভাবে দলের পুরাতনদের পেছনে ফেলে উঠে এসেছে সামনের সারির নেতার আসনে আর লুটে একাকার করে দিচ্ছে সমাজ ও দেশের অর্থনৈতিক-রাজনীতিকে।
তবে এখন এই চক্র থেকে বের হতে হবে তারুণ্যকে। ইলুশন হতে বেড় হয়ে নিজেকে প্রশ্ন করতে শিখতে হবে, বড় ভাইদের বা উপরের অশুভ শক্তির 'চামচা' হবে কেন? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লেখা করা তরুণ হবে 'আমি বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত' ধরণের, যাদের একমাত্র লক্ষ থাকবে দেশে কিংবা নিজের ক্যাম্পাসে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, যেকোনো অপকর্মের বিরুদ্ধে, শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে কণ্ঠ উঁচু করা। কারো নির্দেশে চলা, কারো অপকর্মের সাথী হওয়া, কারো অঙ্গুলি নির্দেশে উঠা-বসা করা মানে তো 'চামচা' হয়ে উঠা, একজন ছাত্রনেতা কেন 'চামচা' হবে? একজন ছাত্রনেতা মানে হচ্ছে ক্যাম্পাসের অন্য হাজার শিক্ষার্থীর সামনে 'হিরো' হওয়া, 'হিরো' যখন চ্যালামি করে তখন আসলে বিষয়টি লজ্জার হয়ে উঠে। তারুণ্যের একটা স্বাধীনচেতা মেজাজ থাকা উচিত, তবেই সেটা তারুণ্য। বড় ভাই-বেরাদরের অন্যায় আদেশ অমান্য করে নিজের ব্যক্তিত্ব, নিজের মানবিকতা-মূল্যবোধ, নিজের স্বকীয়তাকে সবার উপরে স্থান দেয়া জরুরী। সাধারণ শিক্ষার্থীদের পক্ষে থাকা, শিক্ষার্থীদের বিপদে আপদে তাদের পাশে দাঁড়ানোর ব্রত নিয়ে রাজনীতির মাঠে নামা উচিত। আর যদি সেই ব্রত না নিতে পারে, আরও অনেক কাজ আছে জীবনে, আরও অনেক পথ আছে, সেইদিকে হাঁটা ভাল, ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করে তারুণ্যকে ধ্বংস করার কি প্রয়োজন?
তারুণ্যের মাঝে রাজনৈতিক চেতনা অবশ্যই থাকতে হবে, নয়তো জাতি হিসেবে আমরা পিছিয়ে যাবো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমাজ ও রাজনীতি সম্পৃক্ত পঠনপাঠনের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিমুখী হয়, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কোনভাবেই কেবল ক্লাসরুমে আবদ্ধ হতে পারেনা, ক্যাম্পাসজুড়ে নানা বিষয়ের সাথেই জড়িয়ে আছে শিক্ষার্থীদের জ্ঞানার্জন প্রক্রিয়া। সমাজে নতুন চিন্তা ও সামাজিক রাজনৈতিক সচেতনার বাহন মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীরা। তাদের রাজনৈতিক চিন্তা চেতনাকে বন্ধ করে দিলে আরও অন্ধকার নেমে আসবে। তাছাড়া এই ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে, বিশ্ববিদ্যালয় আর বিদ্যালয়ের তফাৎ থাকলো কোথায়? রাজনৈতিক সচেতনতা, রাজনৈতিকভাবে সম্পৃক্ততা, রাজনৈতিক নেতা হয়া-সব গুলো ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, আলাদা স্বত্বা।
আমাদের ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ এই স্বাতন্ত্র্যতা বুঝতে ব্যর্থ হয়, সেখানেই ঘটে বিপত্তি। যে ছাত্রটি হলে বসে পড়তে চায়, ভাল রেজাল্ট করতে চায়, তাঁকে কেন ডেকে এনে মিছিলে যেতেই হবে বলে বাধ্য করা হয়? ঐ দুষ্ট চক্র নেতা-নেত্রীদের চোখে নিজেদের বড় করার জন্য ছাত্রনেতাদের নির্দেশ দেয় যে, তুমি আজ মিছিলে এতো হাজার শিক্ষার্থী আনবে, ইত্যাদি। শোডাউন করার রাজনীতি হতে বের হতে হবে। মনে রাখা জরুরী, ছাত্র রাজনীতির মূলে থাকবে ছাত্রদের কল্যানে কাজ করা, এবং সেটা হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক যেখানে নেতারা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনের কথা বার বার উচ্চারণ করবে। উপরের দিকের নেতাদের ক্ষমতায়িত করার জন্য নয়, উপরের দিকের নেতাদের অঙ্গুলি নির্দেশে নির্যাতন নিপীড়ন করে দলে ভিড়ানো, মিছিলে অনিচ্ছা স্বত্বেও যেতে বাধ্য করা, এসব থেকে বের হতে হবে। হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের রুম পাওয়া নির্ভর করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির সাথে যুক্ততা প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে, নেতারা একেক জন একাধিক রুম দখল করে রেখে বহিরাগতদের থাকার জায়গা করে দেয়, যারা পরবর্তীতে হলের পরিবেশ নষ্ট করে । তাহলে যে ছেলেটা কষ্ট করে নিজ মেধায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হল, ভাল রেজাল্ট করার স্বপ্ন নিয়ে ঘুরছে, তাঁর রুম পাওয়ার অধিকার নেই আনুগত্য দেখানো ছাড়া? একজন সাধারণ ছাত্রকে রাতের আধারে নির্যাতন করে দলে ভিড়িয়ে আসলে কি আদায় করতে চায় ছাত্রনেতাদের কেউ কেউ? তার প্রতি আনুগত্য, শ্রদ্ধা নাকি করুণা? ভালো কাজ করলে, শিক্ষার্থীদের উপকার করলে এমনিতেই শ্রদ্ধা চলে আসবে মনে, তাহলে আনুগত্য পাবার জন্য এতো কঠিন পথ নেবার কি দরকার?
আমাদের এই ধারনা থেকে আগে শিক্ষার্থীদের আসলে মুক্ত করতে হবে যে, মূল রাজনৈতিক দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা, কিংবা তাদের লাঠিয়াল বাহিনী হয়ে উঠা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রনেতাদের কাজ নয়। এ ধরনের ছাত্র সংগঠনগুলোকে বড় বড় দলগুলো রাজপথ সরগরম করে রাখা একপাল লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহৃত না করতে চাইলেই ছাত্র রাজনীতির ধরণ ধারণ অনেকটাই পালটে যাবে।
ছাত্র রাজনীতির সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে র্যাগিং। এই র্যাগিং প্রথাকে চিরতরে নিষিদ্ধ করতে হবে। ভারতের আদালত এই র্যাগিংকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে, বাংলাদেশেও এই ব্যাপারে সরকারকে সিরিয়াসলি ভাবতে হবে। র্যাগিং এর নামে ছাত্র নেতারা কিংবা হলের সিনিয়ররা জুনিয়রদের উপর যে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়, তা অনেকেই মেনে নিতে না পেরে মানসিক সমস্যায় ভুগে। গত কয়েকদিনে আমি অনেক মেসেজ পেয়েছি, যেখানে ছাত্ররা বিভিন্ন ধরণের র্যাগিংএর বর্ণনা দিয়ে আমায় লিখেছে এবং এই সম্পর্কে লিখতে বলেছে। অনেকেই হয়তো নিজের র্যাগিং হবার কথা একসময় ভুলে যায় এবং নিজে সিনিয়র হলে আবার সেই একই কাজ জুনিয়রদের উপর প্রয়োগ করে, কিন্তু এই সংখ্যা বেশি নয়, অনেকেই তীব্র মানসিক সংকটে পড়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এমন কোন আচরণই একজন ছাত্র তো দূরের কথা, একজন শিক্ষকও করতে পারেন না একজন শিক্ষার্থীর সাথে, যে আচরণে একজন শিক্ষার্থীর আত্মসম্মানবোধে আঘাত আনতে পারে। র্যাগিং বিষয়টি সবসময় রাজনীতির সাথে যুক্ত তা নয়, একেবারেই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন সিনিয়ররাও জুনিয়রদের উপর র্যাগিং করে থাকে। অতয়েব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে র্যাগিং বন্ধ খুব জরুরী, এক্ষণই এই বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা আসা জরুরি।
শেষ কথা, আমরা এই মুহূর্তে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে এমন কোন দুঃসময় আমরা পার করছিনা যে, আমাদের তরুণদের লাঠিয়াল বাহিনী হতে হবে। রাষ্ট্র, সমাজ, শিক্ষকের পাশাপাশি বাবামায়ের একটা বড় ভূমিকা আছে, সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের সকলকেই নিরুৎসাহিত করতে হবে তাদের যারা পথ ভ্রষ্ট, যারা সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর অত্যাচার করতে উৎসাহিত হয়, টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি করতে লালায়িত, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে পাশান্ডের মতো নির্যাতন করে। প্রশাসনের ভূমিকা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, প্রশাসন জানেনা এমন কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ঘটে, তা হতে পারেনা। প্রশাসন নিজেদের এসব নেতাদের কাছে জিম্মি করে ফেলে কিসের লোভে, তা খুঁজে দেখা জরুরি। এই ধরণের বোধ-বুদ্ধিহীন, অত্যাচারী, নংপুশক, অবিবেচক, কপট, পাষাণ শ্রেণীর নেতাদের যারা তৈরি করে, যাদের মদদে এসব হয়, তাদের যেমন বিচারের আওতায় আনতে হবে, তেমনি এই ধরণের অপরাজনীতি অবশ্যই ক্যাম্পাসে বন্ধ করতে হবে। সোচ্চার হতে হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের, সোচ্চার হতে হবে শিক্ষক সমাজের, সোচ্চার হতে হবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর, প্রশাসন, অভিভাবকমহল সহ সকলের। তবেই তারুণ্যকে এই অপরাজনীতি হতে মুক্ত করা সম্ভব হবে। সত্যিকারের ছাত্র রাজনীতি ফিরে আসুক তারুণ্যের দুর্দান্ত সময়গুলোতে, সেই প্রত্যাশায় থাকলাম!
রাশেদা রওনক খান
শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবিঃ ইন্টারনেটের সৌজন্যে
২০শে অক্টোবর ২০১৯