আমার বয়স তখন পনের কিংবা ষোলো। এক ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যরাত। বারান্দায় গিয়ে দেখি একা বসে আছেন আমার বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা। তার মতো শক্ত প্রশাসক আর কঠিন হৃদয়ের মানুষের চোখে জল! হিসেব মেলে না। আনন্দের বিজয় দিবস জল ঝরালো কেন বাবার চোখে? জিজ্ঞাসা করার সাহস সে বছর হয় নি। পরের সকালে উৎসবে যোগ দিয়েছি, বাবার হাত ধরে। মনটা গুমোট রয়ে যায়।
তারও বছর খানেক পর। আবারও ১৫ ডিসেম্বর রাত। এদিন বাবা নিজেই ডাকলেন। একটা গাঁথা মালার মতো বলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি। যুদ্ধের লোমহর্ষক বর্ণনা, সহযোদ্ধা হারানোর করুণ গল্প।
আর বললেন, ওরা তো দেখে যেতে পারলো না... দেশটা স্বাধীন করেছি আমরা। দুজনের চোখে একই জল। বাবা, আমি বড় হয়েছি। আমি বুঝতে পেরেছি বিজয় কেন তোমার চোখে জল আনে বছর বছর। দেখো, আমি লিখছি আর চোখ বেয়ে বিজয়ের আনন্দ ঝরছে...।
আমি দুর্ভাগা। সৃষ্টিকর্তা আমাকে ৭১ দেখার সৌভাগ্য দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান নি। সে ভাগ্যটা হয়েছে আমার বাবার। তাই আমার চোখে ৭১ মানে বাবার দিকে তাকিয়ে হা করে শোনা রূপকথার গল্প।
সেক্টর ৯, সুন্দরবন, ভারতে প্রশিক্ষণ, বীর মুক্তিযোদ্ধা মধু কাকা,পাগলাটে সেকেল কাকা, বাজারের ঘরটাতে অজ্ঞাত নারীর পোড়া লাশের গন্ধ....আমার নাকে এসেও লাগে বছর বছর। কিভাবে? আমিও যে জানি না!
আমার ঠাকুরমার (দাদীর) ঝুলিতে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ কি ছিল জানো? তোমার নামটা রাখা। মা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের বছর বছর আগে দূরদর্শী হয়ে ছেলের নাম ‘রণজিত’ রাখলেন?
যুদ্ধ জিতেছে ছেলে। নামের শক্তিতেই কিংবা মায়ের চোখে দেখা ভবিষ্যতের স্বপ্ন সফল করতে।
চাইছিলাম এ বছর বিজয় দিবসে কিছু লিখি। স্পর্ধা হয়ে উঠতে সময় লেগেছে। বলতে পারেন... যে ৭১ দেখে নি, সে এসব নিয়ে কি লিখবে!
জবাব আছে আমার কাছে। স্বাধীনতার সুঘ্রাণ নিচ্ছি মুক্ত মাটিতে...বছরের পর বছর। একাত্তরের খানিকটা কি রক্ত মাংসের এই আমার মগজে ঢোকে নি? উত্তর: না। মগজে ঢোকে নি একদম। হৃদয়ে মিশেছে প্রতিক্ষণে। প্রতি মুহূর্তে।
খুব ছোটবেলায়, বয়সটা ঠিক মনে নেই, যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সেজেছিলাম। আমার বড় বোন প্রতিভা সেজেছিল মুক্তিযুদ্ধে ছেলে হারানো পাগলিনী মা। একটা প্লেট জিতেছিলাম খুব মনে আছে। কিন্তু বাসায় ফিরে মন খারাপ!
মার কাছে বারবার একই আবদার করতে লাগলাম, ‘মা, আমি সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা হবো’।
মা সেদিন বলেছিলেন, ‘তুই তো আমার মুক্তিযোদ্ধাই!’
মানেটা সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝি। স্বাধীনতার প্রায় পাঁচ দশক পরেও কি যুদ্ধ চলছে না? দেশকে এগিয়ে নেয়ার যুদ্ধ। আমি হয়তো আমার ক্ষুদ্র অবস্থান থেকে খুব বেশি কিছু করতে পারি নি। তবে, দূর থেকে ভালোবেসে যাওয়া পাগল প্রেমিকের মতো উজাড় করে ভালোবাসছি মাটি ও মানুষকে। বলুক না লোকে পাগল!
খ্যাতিনামা লেখক আনিসুল হক স্যারের Anisul Hoque ‘মা’ উপন্যাসটা পড়েছি হাসপাতালে অসুস্থ মায়ের পাশে বসে। সারারাত। মাকে সুস্থ করেই ছুটেছি আজাদের মায়ের কবরে। আমার সহধর্মিনী দেবযানী গাড়ির বাইরে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখতে দেখতে বললো, কে জানে, তুমিই হয়তো আগের জন্মের আজাদ!
জানি না মিলটা কোথায়! যেদিন সাফিয়া বেগম (বীর মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা) মৃত্যুবরণ করেছিলেন, সেদিন আকাশ কেঁদেছিল। যেদিন আমি জুরাইন গোরস্তানে গেলাম, সেদিনও কেন কাঁদলো আকাশ? সব প্রশ্নের জবাব মিলবে না।
অভয়নগরের শান্তিলতা দেবীর কথা মনে আছে? ভারপ্রাপ্ত ইউএনও থাকার সময়টাতে তাকে খোলা আকাশের নিচে থেকে তুলে গড়ে দিয়েছিলাম শান্তিনীড়। সংবাদপত্রে খবর বের হলো একের পর এক। যা সবার দৃষ্টি এড়িয়েছে, সেটা আজ বলি। বিধবা শান্তিলতা দেবী যুদ্ধের সময় ভিটে ছেড়ে যান নি।একা রয়ে গেছেন মাটির মায়ায়। অনেকে এটাকে ঘুরিয়ে বলবেন তো, যে মাটির মায়া নাকি জমির লোভ? উত্তরটা দিয়ে দেই। স্বাধীনতার পর ভিটে ছাড়া বাকি সব জমি দান করে দিলেন স্কুলকে। যুক্তি একটাই: দেশের মানুষ পড়ালেখা শিখুক। আমরা এমনই পাগল!
আবার এই স্বাধীন দেশেই তাকে ভিটেছাড়া করার পায়তারা চলছিল, যা একা হাতে ঠেকিয়েছি। আমরা এমনও!
কারও সাথে দেখা হলেই বলি, বাড়ি কোথায়? কবে বলবো আমার বাড়ি পুরো বাংলাদেশ? জেলায় জেলায় বিভেদ দেখে নিশ্চয়ই ওপারে হাসছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ। ভোলা জেলায় যার জন্ম, তিনি প্রাণ দিলেন গাইবান্ধায়,সম্মুখ যুদ্ধে। সেদিন একাত্তরের চিঠি বইটাতে তার লেখা মায়ের কাছে চিঠিতে বলেছেন, যুদ্ধ করছি মা, বাংলাদেশের মধ্যেই কোথাও। এই তো চাই। এই এক থালাতেই পুরো বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি....
থামতে মন চাইছে না। হাজার গল্প আর চিন্তা এসে ঠকঠক করে কড়া নাড়ছে মনের দরজায়। আর থাক। শেষ একটা গল্প বলেই থামি।
৭১ এর মাঝামাঝি। যুদ্ধ চলছে। বাবা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। যে রুমে শুয়ে ছিলেন পাশেই পড়ে আছে লাশ। একজন নার্স ছিলেন তিনিও নাকি চলে গেছিলেন বাইরে। লাশের পাশে সেদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবা অস্বস্তি আর ভয় কাটাতে সারারাত উচ্চকন্ঠে আবৃত্তি করে গেছেন ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। হ্যাঁ আবৃত্তি জেনেশুনেই বলছি। এর চেয়ে রক্ত গরম করা কবিতা আর আছে কী?
‘আর যদি একটা গুলি চলে....’
বিজয়ের সাথে সাথে সব গুলি থেমে গেছে বাবা। শেষ হয়ে গেছে যুদ্ধ। একাত্তরের রণক্ষেত্র বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের উর্বর ভূমি। তোমার-আমার প্রজন্মের শিরায়-শিরায় এখনও বয়ে যায় বিজয়ের স্রোত। লাল-সবুজ স্রোত।
মনদীপ ঘরাই, বাংলাদেশ লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান)
১৬ই ডিসেম্বর ২০১৯
মনদীপ ঘরাই, বাংলাদেশ লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান)
১৬ই ডিসেম্বর ২০১৯