গুজবের বাংলাদেশে গুজব দ্রুত ছড়ায়। আলোর গতির চেয়ে বেশী গতিতে ছুটে চলে বাংলাদেশের গুজব। গুজবে শুধু কান নয় অনেকে জান পর্যন্ত দিয়ে দেয়। বাংলাদেশের মানুষ গুজব ছড়াতে এবং গুজবে যোগদান করতে বেশী পছন্দ করে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চেয়ে গুজবে বিশ্বাসী মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। গুজবের কারনে অনেকেই সেলিব্রেটি হয়েছেন। অনেকেই সেলিব্রেটি হওয়ার জন্য গুজব ছড়াতে থাকেন।
বাংলাভাষার বয়স আনুমানিক পাঁচ হাজার বছর মনে করা হয়। কিন্তু বাংলায় গুজবের বয়স কত বছর তা আজ পর্যন্ত কোন ইতিহাসবিদ বের করতে পারেননি। এদেশে ধর্ম, রাজনীতি, শিক্ষা, মৃত্যু, জন্ম সহ সববিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়। সম্প্রতিকালে কয়েকটি বহুত প্রচলিত গুজবের মধ্যে রয়েছে যুদ্ধাপরাধী মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। মধ্যরাতের এইগুজব বাংলাদেশের অনেক মসজিদের মাইকে বারবার প্রচার করা হয়। গুজব সত্যি হলে দোলোয়ার হোসেন সাঈদী হতেন বিশ্বের প্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি কোনরকম যানবাহন ছাড়া চাঁদে পৌছাতে সক্ষম হয়েছেন। সাঈদীকে চাঁদে দেখা যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য বন্ধ করার অপচেষ্ঠা করা হয়েছিলো। বাংলাদেশের দুটি বৃহত্তম রাজনৈতিক দল সরাসরি গুজবের সাথে জড়িত ছিলো। বাংলাদেশের মানুষের নিজের টাকায় তৈরী স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে গুজব ছিলো আরোও ভয়াবহ। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের অগ্রগতির জন্য অনেক মাথা লাগবে। ফেসবুকের হিসাবে দেশের প্রায় হাজার খানেক মাথা কাটা হয়েছিলো পদ্মা সেতুর জন্য। স্বপ্নের পদ্মাসেতুর কাজ বন্ধ করার জন্য এগুজবে যোগদিয়েছিলো রাজনৈতিকদলগুলোর কর্মী সমর্থকেরা। গুজবে যাদের সবচেয়ে কম কান দেওয়ার কথা সেই ইসলামের ধারক এবং বাহক দাবীকৃত হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা গুজব ছড়ালেন বিদ্যুৎগতিতে। গুজবের বিষয় ছিলো ভয়ানক। রাঁতের আধারে নাকি হাজার দশেক হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের গুলি করে মেরে লাশ গুম করা হয়েছিলো। গুজব ছড়িয়ে রামুবৌদ্ধ বিহার এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়ার অনেক মন্দির ধ্বংস করা হয়। এসবগুলি গুজবই ছিলো ধর্মীয় চেতনাকে পুঁিজ করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল করা। গুজবে কানদিয়ে সহিংসতার উৎসবে মেতে উঠেছিলো কিছু নরপিশাচ।
বর্তমান বিশ্বের আলোচিত ভাইরাস করোনাভাইরাস নিয়ে বাংলাদেশে মাস দুয়েক যাবত চলছে নানা রকমের গুজব। গুজবে যোগদিচ্ছেন বুড়াবুড়ি থেকে শুরু করে বাঁচ্চারা পর্যন্ত। প্রথমে চীনে এই করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করলে বাংলাদেশে ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয় চীনের মুসলমানদের উপর চীন সরকারের অত্যাচার করার কারনে মহান আল্লাহ তায়ালা গজব হিসেবে চীনে করোনাভাইরাস প্রেরণ করেছেন। কিছু ইসলামীবক্তা প্রচার করলেন হারাম খাদ্যাভাসের কারনে চীনের এই করুন পরিনতি হয়েছে। এবিষয়ের দালিলিক প্রমান হিসেবে অনেকে অনেক হাদিসের সূত্র আলোচনা করেছেন। একজন আমেরিকান বিজ্ঞানীর সূত্র দিয়ে গুজব ছড়ানো হলো যে, করোনাভাইরাস চীনের তৈরী রাসায়নিক জীবাণুঅস্ত্র যা অসর্তকতাবশত ছড়িয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস মধ্যপ্রাচ্যের কঠোর মুসলিম দেশ ইরান, ইসলামের পূন্যভূমি সৌদি আরব সহ ইসলামী দেশসমুহে ছড়িয়ে পড়লে গুজব ছড়ানো হলো করোনাভাইরাস হচ্ছে মুসলিমদের ঈমানী পরীক্ষার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা প্রেরণ করেছেন। অনেকেই গুজব নয় অংক কষে হিসেব দিয়েছেন ২০২০ সালে ইমাম মাহাদী (আঃ) এর আগমন ঘটবে। তাঁর আগমনের পূর্বলক্ষণ হিসেবে এই ভাইরাসে পৃথিবীর ছয় কোটি মানুষ মারা যাবে। বাংলাদেশের একজন মহাজ্ঞানী ইসলামী বক্তা ইব্রাহীম সাহেব করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক আবিস্কারের জন্য সূত্রটি ইউটিউবে ছেড়েছেন। করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বাংলাদেশের হোমিওপ্যাথি ডাক্তাররা রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করছেন। গুজবের কারনে থানকুনি পাতা রীতিমতো সেলিব্রেটির মর্যাদায় আছে। প্রতিটি পাতা নাকি দুইশত টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাংলাদেশে মহামারী আকার ধারণ করার পূর্বাভাস নাকি নারকেল পাতায় সাদা সাদা দাগ। যদিও কৃষি অধিদপ্তর বলছে এটা নারকেল গাছের প্রচলিত একটি রোগমাত্র।
সবচেয়ে বড় গুজব কয়েকদিন যাবত বাংলাদেশের ফেসবুকে এবং মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে তাহলো বাংলাদেশের কয়েক হাজার মানুষ ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। সরকার মুজিব শতবর্ষ পালন করার জন্য গোপন রেখেছে। যদিও মুজিব শতবর্ষ পালনের একদিন আগেই সকল অনুষ্ঠান সীমিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলো সরকার। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। তবুও গুজব থেমে নেই। ফেসবুক জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে কয়েকজনের মৃত্যুর খবর পর্যন্ত। গুজবে বাতাস দিয়ে যাচ্ছেন কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপÍ কর্তাব্যক্তিরা। মিডিয়া প্রচার করছে নানাবিধ খবর। ক্ষমতাসীন দলের সাধারন সম্পাদক যখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন গুজবের পালে হাওয়া লাগে। আক্রান্ত এবং সন্দেহভাজন এর পার্থক্য দেশবাসীর কাছে তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ভুল তথ্য এবং আংশিক তথ্য প্রচার করে গুজব ছড়ানোর সুযোগ তৈরী করে দিচ্ছেন কিছু সরকারী প্রতিষ্ঠান। রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এই খবর শুনে হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছেন জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতালের ( পঙ্গু হাসপাতাল) ডাক্তার এবং নার্সরা। কানাডা ফেরত শিক্ষার্থী করনোভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। করোনাভাইরাসে মারাগেলে লাশের গোসল, জানাজা এবং মাটি হবে না গুজবে কানদিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন নোয়াখালীর একজন প্রবাস ফেরত শ্রমিক। ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে গুজব রটনাকারীরা বলছেন সরকার খুব শীঘ্রই বাংলাদেশের সকল মসজিদ বন্ধ করে দিবে।
মাঠে গুজব আছে সহসাই দেশে খাদ্য সংকট দেখা দিবে। বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানী বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। দেশ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে। গার্মেন্টসশিল্প বন্ধ হয়ে বেকার হয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক। কোটি প্রবাসী শ্রমিক বিদেশ থেকে চাকুরীহারা হয়ে দেশে এসে বেকারের সংখ্যা বাড়াবে। দেশের অর্থনীতিতে নামবে ধ্বস। সরকারী চাকুরীজীবিরা পেনশন বঞ্চিত হবেন। এসকল গুজবে মজুতদার ব্যবসায়ীরা দ্রব্যের দাম বাড়ানো শুরু করেছেন। আত্মংকে দিন কাটাচ্ছেন প্রবাসীদের পরিবার। সবার আগে সরকারকে আশ্বস্থ করতে হবে দেশে পর্যাপ্ত পরিমান প্রয়োজনীয় খাদ্য দ্রব্যের মজুদ আছে। চাকুরীহারা হবেন না কোন শ্রমিক। করোনাভাইরাস আমাদের অর্থনীতিতে যতটুকু ধ্বস নামাতে পারবে তার চেয়ে বেশী ধ্বস নামাবে গুজব নামের ভাইরাস।
করোনাভাইরাসের মতো গুজবভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সারাবিশ্বে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে গুজব রীতিমতো মহামারী আকার ধারণ করেছে। গুজব রয়েছে গোমূত্র পান করলে এবং গোবর দিয়ে গোসল করলে করোনাভাইরাস থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব। গুজবে বিশ্বাসী মানুষগুলি হাজার রুপি খরচ করে গোমূত্র পান করছেন। মদ পান করলে করোনাভাইরাস আক্রমন করতে পারেনা এই গুজবে কানদিয়ে জান দিয়েছেন মুসলিম রাষ্ট্র ইরানের অনেক মদবিদ্বেষী মানুষ। মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশে মসজিদে নামাজ পড়া বন্ধ করার পাশাপাশি সৌদিআরব ওমরাহ হজ্ব বন্ধ করে দেওয়ার পর গুজব আছে হাজার হাজার আবাবিল পাখি প্রতিনিয়ত কাবা শরীফ তাওয়াফ করছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের অনেক নাগরিক বিশ্বাস করেন তাদের খ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। পাগলাটে প্রেসিডেন্ট কিম জং উত্তর কোরিয়ায় আক্রান্ত নাগরিকদের গুলি করে মারছেন এটা অনেকেই গুজব মানতে নারাজ।
বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু গুজবে বেশী বিশ্বাস করে সেহেতু সরকারকে কঠোর হাতে গুজব দমন করতে হবে। গুজব দমনে ব্যর্থ হলে সরকারের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের চেয়ে এইমুহুর্তে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে গুজব প্রতিরোধে। গুজব প্রতিরোধ করতে পারলে মানুষের মনে আস্থা ফিরে আসবে, মানুষ সচেতন হবে। সচেতনতা বাড়লে মানুষ নিজ উদ্দ্যেগে প্রতিরোধে এগিয়ে আসবে। করোনাভাইরাসের সাথে সাথে সবধরনের গুজব প্রতিরোধে সরকার এবং সচেতন নাগরিকদের একসাথে কাজ করতে হবে। করোনাভাইরাস প্রতিরোধের জন্য প্রচার কর্যক্রম চালু করার পাশাপশি গুজব প্রতিরোধ সেল গঠন করতে হবে। সমাজের গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরকে গুজব প্রতিরোধে ব্যবহার করতে হবে। স্কুল কলেজের শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সহ শিক্ষার্থীদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। টেলিভিশন, রেডিও এবং সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
গুজব ছড়িয়ে পড়ছে এশিয়া থেকে ইউরোপ, আফ্রিকা থেকে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে। বিজ্ঞানীরা চেষ্ঠা করছেন করোনাভাইরাসের টিকা আবিস্কার করতে। হয়তো খুবশীঘ্রই টিকা আবিস্কার করে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। কিন্তু গুজবভাইরস নিয়ন্ত্রণ করা যাবে কিভাবে। গুজবভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার টিকা আবিস্কার করতে না পারলে বিশ্বকে প্রতিনিয়ত পড়তে হবে বৈশ্বিক বিপদে।
মোঃ হেদায়েত উল্লাহ তুর্কী
সহকারী রেজিস্ট্রার
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,বাংলাদেশ
২০শে মার্চ ২০২০