Type Here to Get Search Results !

বাঙালি জাতির ইশতেহার যে ভাষণ" --- ড. কাজল রশীদ শাহীন,বাংলাদেশ

কোনো ভাষণ কি একটি জাতির ইশতেহার হয়ে উঠতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জাতিসমূহের মধ্যে কি এ রকম নজির আছে যে, একটি ভাষণ হয়ে উঠেছে তাদের ইশতেহার? প্রশ্নগুলো যতটা সহজ, উত্তর ততটাই গোলমেলে এবং হ্যাঁ বা না-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার নয়। একটি ভাষণ অবশ্যই একটা জাতির ইশতেহার হয়ে উঠতে পারে, যদি সেই জাতির ললাটে সেই রকম মহানায়কের আবির্ভাব ঘটে। আবার শুধু মহানায়কের আবির্ভাব ঘটলেই হবে না, থাকতে হবে সেই রকমের ভাষণ, যে ভাষণ একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বপ্ন সংগ্রাম চাওয়া পাওয়ার সামগ্রিকতাকে ধারণ করবে। যে ভাষণ সময়ের হয়েও সময়নিরপেক্ষ হবে, যে ভাষণ ব্যক্তির হয়েও ব্যক্তিনিরপেক্ষ হবে- কারণ তখন ব্যক্তি এবং জাতি একাকার হয়ে একটা সরলরেখায় গিয়ে মিলিত হয়। এবং সেই ভাষণ নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের হয়েও বিষয়নিরপেক্ষ যেমন হবে তেমনই বিষয়কে ধারণ করে তার সঙ্গে জাতির ইতিহাস-ঐতিহ্য, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতকে একসূত্রে গ্রথিত করবে। সত্যিই বিশ্ব ইতিহাসে সেই রকম ভাষণ বিরল।
হ্যাঁ, পৃথিবীতে অনেক মহামানব এসেছেন। অনেক জাতির ইতিহাসে এক বা একাধিক মহানায়ক এসেছেন। সেইসব মহামানব-মহানায়কেরা জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন, জাতিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। তাদের অঙ্গুলি নির্দেশনায় পাল্টে গেছে ইতিহাসের অনেক অধ্যায়। কিন্তু একটা ভাষণকে একটা জাতির ইশতেহার হিসেবে হাজির করার নজির এখন পর্যন্ত একটাই-একমেবাদ্বিতীয়ম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভষণ হলো সেই ভাষণ যেটা বাঙালি জাতির ইশতেহার হয়ে উঠতে পেরেছে। প্রশ্ন হলো, তা হলে অন্য ভাষণ কেন সেই জাতির ইশতেহার নয়? ভারতের জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী নামে অধিক পরিচিত। মহামতি বুদ্ধের অহিংস নীতিকে তিনি জীবনের অন্যতম পথ ও পাথেয় হিসেবে জ্ঞান করেছিলেন। তার সবচেয়ে আলোচিত ভাষণ হলো, ‘কুইট ইন্ডিয়া’। ব্রিটিশদের ভারত ছাড়ার জন্য তিনি এই ভাষণ দেন। এটি অবশ্যই পৃথিবীর ইতিহাসের আলোচিত ভাষণগুলোর অন্যতম। কিন্তু এই ভাষণে তিনি আলো ফেলেছেন একটামাত্র জায়গায়। ফলে এই ভাষণ ভারতীয়দের জন্য মহার্ঘ হলেও তাদের জাতিগত ইশতেহার নয়। মার্টিন লুথার কিংয়ের আলোচিত ভাষণ হলো ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’। এখানে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের ঘিরে বলেছেন স্বপ্নের কথা। কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের বিরোধ নিরসনে তিনি এই ভাষণ দিয়েছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন বর্ণপ্রথা নয়, সব আমেরিকান এক হবে। আমেরিকার আকাশ থেকে দূর হবে জাতিগত ভেদাভেদ। অসম্ভব মূল্যবান এই ভাষণ। যার প্রতিটি বাক্য শিহরণ জাগানিয়া, যার প্রতিটি শব্দ উজ্জীবনী সুধাস্বরূপ। কিন্তু সেই ভাষণও হয়ে ওঠেনি সেই জাতির ইশতেহার। কারণ সেখানেও আলো ফেলা হয়েছে একটা বিষয়ে। মার্কিন জাতির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সেখানে একসূত্রে গ্রথিত হয়নি। পৃথিবীর ইতিহাসে যত ভাষণ রয়েছে তার মধ্যে আলোচিত আরেকটি ভাষণ হলো গেটিসবার্গ ভাষণ। আব্রাহাম লিঙ্কন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চরম দুঃসময়ে এই ভাষণ দেন। ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর মার্কিনিদের ভাগ্যাকাশে এ রকম দুঃসময় কখনো আসেনি। জাতিগত দাঙ্গা আর গৃহযুদ্ধে তখন দেশটি বিধ্বস্ত, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে প্রায়। এ রকম একটা সময়কে সামাল দিতে আব্রাহাম লিঙ্কন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানামুখী কৌশল অবলম্বন করেন। এবং এরই আলোকে দেন গেটিসবার্গ ভাষণ। এর পরই রহিত হয় দাসপ্রথা। কিন্তু তারপরও গেটিসবার্গ ভাষণ মার্কিনিদের জাতিগত ইশতেহার নয়। এ ভাষণ দাসপ্রথার মতো অমানবিক একটা প্রথার বিলুপ্তি ঘটালেও সেখানে মার্কিনিদের সামগ্রিকতাকে ধারণ করা সম্ভব হয়নি। লক্ষণীয় উপর্যুক্ত তিনজনই অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। এতেও একটা বিষয় স্পষ্ট যে, তারা সময় ও ব্যক্তিস্বার্থের ওপরে উঠে কাজ করেছেন। ফলে মন্দ মানুষেরা তাদের এই সততাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজকে ধারণ করতে পারেনি। তারা উপলব্ধিই করতে পারেনি, তারা পৃথিবীর বাঁক বদলানো মহামানবদের মতো কাজ করেছেন। তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে, তাদের আলোচিত ভাষণকে মহার্ঘ জ্ঞান করেও আমরা গবেষণার তথ্যউপাত্তের নিরিখে বলছি তাদের ভাষণ সেসব জাতির ইশতেহার নয়।
পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র জাতির ইশতেহার হয়ে ওঠা ভাষণ হলো বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু সামগ্রিকতাকে ধারণ করেছেন। আমরা সবাই জানি ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী বলেন তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন সবাই। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ময়দানে ভাষণ দেবেন এটা ঘোষণা হওয়ার পর থেকে শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে থেকেও সবাই প্রতীক্ষায় ছিলেন বঙ্গবন্ধু কী বলেন। সেই সময়ের পত্রপত্রিকার দিকে খেয়াল করলেও আমরা বিষয়টা লক্ষ করে থাকি। পত্রিকায় এ রকম শিরোনামও এসেছে, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী বলেন তার দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। যে ভাষণ শোনার জন্য তাকিয়ে আছেন সবাই সেই ভাষণ বলার জন্য বঙ্গবন্ধু কিন্তু কোনো রকমের লিখিত ড্রাফট করেননি। এমনকি দল বা ব্যক্তি কারও সঙ্গে কোনো প্রকার পরামর্শও করেননি। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করে কিছুই বলেননি। এমনকি ৭ মার্চ সকালেও এ নিয়ে কোনো প্রকার কথা হয়নি। বঙ্গবন্ধু এই সময়ে যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে উঠেছিলেন। সবার মাঝে থেকেও ডুব দিয়েছিলেন নিজের মাঝে। কবি যেমন কবিতা পাণ্ডলিপিতে লেখার আগে নিজের মাথায় রচনা করে নেন। কথাসাহিত্যিক যেমন গল্প-উপন্যাস লেখার আগে কথা বলেন তার চরিত্রসমূহের সঙ্গে। কী অদ্ভুত, রচনা হয়, কথা হয় অথচ কেউ শুনতে পায় না। ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুর মনের কথা কেউ শুনতে পাননি, তার রচনা কেউ দেখতে পাননি। সহধর্মিণী ফজিলাতুন্নেছা রেণু বোধকরি টের পেয়েছিলেন। কারণ তার চেয়ে ভালো করে আর কারও তো বঙ্গবন্ধুকে চেনার কথা নয়, চেনেওনি। এ কারণেই বোধকরি ৭ মার্চ সকালে তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, কে কী বলল সেদিকে তোমার কান দেওয়ার দরকার নেই। তোমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়, তুমি সেটাই বলো। বঙ্গবন্ধু তার সহধর্মিণীর কথা রেখেছিলেন। তার মনে যেটা ভালো হয়েছে সেটাই তিনি বলেছেন। বঙ্গবন্ধু সেদিন জাদুকরী এক মন্ত্রে সবাইকে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। ভাইয়েরা আমার সম্বোধনের মধ্য দিয়ে তিনি এবং জনতাকে এক করে ফেলেছিলেন। ফলে এই ভাষণ বঙ্গবন্ধুর মুখ থেকে উচ্চারিত হলেও বাঙালিমাত্রই মনে করেছিল এ কথা তাদের নিজেদেরই কথা। এ দাবি তাদের নিজেদেরই দাবি, এই স্বপ্ন তাদের নিজেদেরই স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর প্রতিটি কথা প্রতিটি বাক্য সেদিন সাত কোটি বাঙালির হয়ে উঠেছিল। বাঙালি জেনেছিল-বুঝেছিল এটাই তো হওয়ার কথা, এটাই তো আমরা চাই। বঙ্গবন্ধু যেন সেদিন সকলের স্বপ্নের সারথি হয়ে উঠেছিলেন। বঙ্গবন্ধু যখন বলছেন, আর যদি একটা গুলি চলে, তখন সমবেত জনতাও হঙ্কার দিয়ে উঠেছেন। এভাবেই ব্যক্তির কথা হয়ে উঠেছিল সমষ্টির কথা, একটা জাতির ইশতেহারস্বরূপ। সেদিন বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের বাঙালির স্বপ্নের সারথি হয়ে উঠেছিলেন। ৭ মার্চের সেদিনের সেই ভাষণে পাকিস্তানের নিগড় থেকে মুক্তির কথা যেমন বলেছেন, তেমনই শোষণ-বঞ্চনার কথাও বলেছেন। সেই ভাষণ শুধু একটা বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সময়ে দাঁড়িয়ে সময়নিরপেক্ষ কথা বলেছেন। তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলতে গিয়ে জাতি হিসেবে আমাদের করণীয় কী তার বার্তা দিয়েছেন। তিনি একই সঙ্গে মুক্তির কথা বলেছেন আবার স্বাধীনতার কথাও বলেছেন। আমরা জানি মুক্তি এবং স্বাধীনতা দুটো পৃথক সত্তা। স্বাধীনতা একটা পিরিয়ডিক্যাল বিষয়, মুক্তি নন-পিরিয়ডিক্যাল। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হয়, মুক্তির সংগ্রাম চলমান, হাজার বছর কিংবা তারও অধিককালের। এ কারণে বঙ্গবন্ধু মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার সংগ্রামকে একসূত্রে গেঁথেও আলাদা করে আইডেন্টিফাই করেছেন এবং গুরুত্ব নিশ্চিত করেছেন। এ কারণেই ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির ইশতেহার।









ড. কাজল রশীদ শাহীন
সাংবাদিক ও গবেষক
বাংলাদেশ

৭ই মার্চ ২০২০

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.