জগতের কিছু সৃষ্টি আজও শাশ্বত হয়ে আছে, থাকবে অনন্তকাল। নদী যেমন অনন্তকাল বহমান, পাহাড়ি ঝর্ণা যেমন প্রতি মুহূর্ত প্রবাহিত, হিমালয় পর্বত যেমন কালের রেখায় দণ্ডায়মান; এমনি অনেককিছুই পৃথিবীতে অবিনশ্বর হয়ে আছে। এগুলো সবই প্রকৃতির সৃষ্টি। তবে মানুষেরও কিছু সৃষ্টি প্রকৃতির মতোই পৃথিবীতে যুগ যুগান্তরে সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। যার আবেদন কোনোদিন শেষ হয় না। কিছু কবিতা, কিছু গান চিরকালই আধুনিক। সব কালের, সব সময়ের সাথে ছবির মতো মিশে থাকে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে শতাব্দির শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রকৃতির মতোই আমাদের ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সাথে বহমান। তাঁর সৃষ্টির ছোঁয়ায় আমরা একটি মানচিত্র পেয়েছি, পেয়েছি স্বাধীন একটি দেশ। যার নাম বাংলাদেশ। আশ্চর্যের বিষয় এই স্বাধীন বাংলাদেশের উৎপত্তি একটি মুখের বিপ্লবী কণ্ঠস্বর থেকে। দিনটি ছিল ৭ মার্চ ১৯৭১ সাল। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন একটি মানুষের মুখ থেকে উচ্চারিত কিছু শব্দাবলী বিচ্ছুরিত হয়ে একটি দেশের জন্ম হয়েছিল; যে দেশটির নাম বাংলাদেশ। যে দেশটি এখন পৃথিবীর বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
যে দেশটি এখন অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। অথচ এই দেশটির জন্ম হয়েছিল উর্বর পলিতে তলিয়ে যাওয়া রক্ত নদীর প্রবাহ থেকে। বোমার আঘাতে ঝলসে যাওয়া আগুনের কুন্ডলি থেকে। এত এত রক্ত, এত এত মানুষের আত্মবলিদানে অর্জিত যে স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজ পতাকা আজ বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র পৃথিবী জুড়ে আমরা উড়তে দেখি; সেই পতাকার মর্মর ধ্বনিতে আজও বেজে ওঠে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ। কী ছিল সেই ভাষণে? যার প্রতিধ্বনিতে মুখর হয়ে সাতকোটি নিরস্ত্র বাঙালি চোখের নিমিষে ঝাঁপিয়ে পড়লো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সামনে!
কী ছিল ভাষণে, যা শুনে মানুষ নিজের জীবনকে হাতে নিয়ে এগিয়ে চললো নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে? বস্তুত, ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্যকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সুদূর অতীতে। ১৯৪৭ সালে যখন ভারত পাকিস্তান দুটি আলাদা রাষ্ট্রে ভাগ হয়ে যায়। আর ভৌগোলিক মানচিত্রের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা এবং পশ্চিম পাকিস্তান দুটি আলাদা জনপদের সমন্বয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয়। কিন্তু এই রাষ্ট্রের যাবতীয় শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতেই রয়ে যায়। পূর্ব বাংলার লোকেরা প্রতিটি পদে পদে তাদের অধিকার বঞ্চিত হতে থাকে।
এমনকি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুতে পরিণত করার প্রস্তাব করা হয়। সেই থেকে পূর্ব বাংলার মানুষ অনুভব করতে পারে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি তাদেরকে কেবল দাসত্ব বানিয়ে রাখতে চায়। তারপর ১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার মানুষ তাদের মাতৃভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে গর্জে উঠলো। আর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী নির্বিচারে গুলি চালালো ছাত্র জনতার ওপরে। রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার ও বরকতের তাজা রক্তে ছেয়ে যায় রাজপথ। তার দুই বছর পরে ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলায় আইনসভার নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে বিজয় লাভ করে, তবুও বাংলার মানুষ তাদের অধিকার বঞ্চিত থাকে। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্বশাসন তুলে ধরা হয়।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নানান অভিযোগ এনে বাঙালিদের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেই অন্ধকার সময়ে একজন বঙ্গবন্ধু উপলব্দি করেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তারপর এলো সেই ঐতিহাসিক দিন। ৭ই মার্চ ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় একটি দিন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে অনেকগুলি দিক পরিলক্ষিত হলেও বস্তুত সেই ভাষণের মধ্যে দুটি দিক খুবই গুরুত্ব বহণ করে। একটি হলো ধৈর্য, আরেকটি দিক হলো সাহস। বঙ্গবন্ধু সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তাঁর ভাষণে বলেছিল- শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে এদেশে বাস করার সম্ভাবনা আছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেবার অনেক কিছুই আছে। যেকোনো ঝগড়া বিবাদ, সহিংসতা মোকাবেলা করতে গেলে প্রথমে মানুষকে ধৈর্যশীল হতে হয়। ধৈর্য হারিয়ে ফেললে সবকিছু এলেমেলো হয়ে পড়ে। তাছাড়া যে কোনো পরিস্থিতির সমাধান করতে গেলে প্রথমে দেখতে হয় শান্তিপূর্ণ দিকটাকে। যদি শান্তিপূর্ণভাবে কোনোকিছুর সমাধান সম্ভব হয় তাহলে সেখানে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা যুদ্ধ মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। তাই তো বঙ্গবন্ধু সেই উত্তাল অবস্থার ভিতর দাঁড়িয়েও তিনি শান্তির বার্তা ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। বর্বর পাকিস্তান শান্তিকামী বাঙালির এই সংস্কৃতিকে আমাদের দুর্বলতা ভেবেছিল। তাই তো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের এই মনোভাব বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যখন মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। যখন যুদ্ধই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, তখন মানুষকে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তাই তো সাত কোটি বাঙালি সেদিন এক প্রকার খালি হাতেই পাক বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এটাই সাহস। কতটুকু সাহস প্রাণে সঞ্চারিত হলে মানুষ মরতেও ভয় পায় না। সেই সাহসের প্রবাহ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন। যার প্রতিফলন আমরা ২৬শে মার্চের পরে দেখেছি। যখন ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ যেন বিশাল মহাসমুদ্রে এক খণ্ড ভাসমান কাঠের টুকরায় পরিণত হয়েছিল। এদেশে তখন নেতা বলতে মানুষ একজনকেই চেনে, একজনকেই জানে; যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই নেতাই তখন এদেশের মাটিতে ছিলেন না; তিনি বাঁচবেন কি মরবেন বা আর কোনোদিন ফিরবেন কিনা তাও কেউ জানত না। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরসহ প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে ঢুকে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কী হবে এখন? কি করে মুক্তি মিলবে ওই পাকিস্তানি হায়েনাদের থেকে? কে এখন সাহস যোগাবে? সবাই কি তাহলে পাকিস্তানি মিলিটারির গুলির নিচে নিজেকে সঁপে দেবে? নাকি সবাই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে? না, এসবের কিছুই সেদিন হয়নি। হয়নি তার কারণ বাংলার আকাশে বাতাসে তখন ধ্বনিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে; মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো; তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই ভয়াল মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু ছিল না। কিন্তু তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠ প্রতিটি মানুষের প্রাণে গাঁথা হয়েছিল। তাইতো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এই সরকারের অধীনেই সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। অতঃপর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ৭১’র সেই ভগ্নদশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে উন্নত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে। এই এগিয়ে চলার মাঝেও আছে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের ইতিহাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পরই বাংলাদেশের বুকে ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। যেদিন দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এদেশে শাসনভার পেয়ে যায় দুঃষ্কৃতিকারী স্বৈরশাসক গোষ্ঠী। তারপর যখন ১৯৮১ সালে ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন, তখন থেকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ তখনও থামেনি। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ছোড়া হয় গ্রেনেড। অনেক নেতা কর্মী সেদিন জীবন হারালেও প্রাণে বেঁচে যান জননেত্রী শেখ হাসিনা। এভাবে প্রতিটি পদে পদেই যুদ্ধ এবং ষড়যন্ত্রের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবুও বাংলাদেশ কখনও দমেনি, থেমে থাকেনি। কারণ এই বাংলার মাটিতে একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন। যিনি তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতি লড়াই করার মন্ত্র দিয়ে গেছেন। এই মন্ত্র যতদিন আমরা আঁকড়ে থাকতে পারবো ততদিন বাংলাদেশ পথ হারাবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে চলবে দুরন্ত দুর্বার গতিতে। তাইতো বলি, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাঙালি জাতির পিতা, আমারই ক্ষুদ্রজ্ঞানে তাহার গুণের কথা, লেখার নেই যে ক্ষমতা’ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা ৭ই মার্চের সেই ভাষণ কতটা প্রভাবিত করে সেই আলোচনা বিশদ। তবে এটাই নির্মম সত্য যে- যেদিন আমাদের রাজনীতির মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেমে যাবে, যেদিন আমাদের ভিতর থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে যাবে, সেদিনই আমাদের রাজনীতি অন্ধকার সমুদ্রে নিমজ্জিত হবে। জানি, সেইদিন এদেশের বুকে কোনোদিনও আসবে না। কেননা নদীমাতৃক এই দেশে যতদিন স্রোতধারা বইবে, ততদিন ধ্বনিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
তানজিনা মনি পরশ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্মী, ইডেন কলেজ শাখা।
৬ই মার্চ ২০২০
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আমাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পূর্ব বাংলার মানুষের ওপর নানান অভিযোগ এনে বাঙালিদের ওপরে অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। সেই অন্ধকার সময়ে একজন বঙ্গবন্ধু উপলব্দি করেছিলেন স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালি জাতির মুক্তি অর্জন সম্ভব নয়। তারপর এলো সেই ঐতিহাসিক দিন। ৭ই মার্চ ১৯৭১। বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যময় একটি দিন। ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণে অনেকগুলি দিক পরিলক্ষিত হলেও বস্তুত সেই ভাষণের মধ্যে দুটি দিক খুবই গুরুত্ব বহণ করে। একটি হলো ধৈর্য, আরেকটি দিক হলো সাহস। বঙ্গবন্ধু সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তাঁর ভাষণে বলেছিল- শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই ভাই হিসেবে এদেশে বাস করার সম্ভাবনা আছে। এখান থেকে আমাদের শিক্ষা নেবার অনেক কিছুই আছে। যেকোনো ঝগড়া বিবাদ, সহিংসতা মোকাবেলা করতে গেলে প্রথমে মানুষকে ধৈর্যশীল হতে হয়। ধৈর্য হারিয়ে ফেললে সবকিছু এলেমেলো হয়ে পড়ে। তাছাড়া যে কোনো পরিস্থিতির সমাধান করতে গেলে প্রথমে দেখতে হয় শান্তিপূর্ণ দিকটাকে। যদি শান্তিপূর্ণভাবে কোনোকিছুর সমাধান সম্ভব হয় তাহলে সেখানে যুদ্ধের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা যুদ্ধ মানুষের ধ্বংস ডেকে আনে। তাই তো বঙ্গবন্ধু সেই উত্তাল অবস্থার ভিতর দাঁড়িয়েও তিনি শান্তির বার্তা ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু তখনকার বাস্তবতা ভিন্ন ছিল। বর্বর পাকিস্তান শান্তিকামী বাঙালির এই সংস্কৃতিকে আমাদের দুর্বলতা ভেবেছিল। তাই তো বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি শাসকদের এই মনোভাব বুঝতে পেরে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। যখন মানুষের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যায়। যখন যুদ্ধই হয়ে ওঠে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন, তখন মানুষকে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তাই তো সাত কোটি বাঙালি সেদিন এক প্রকার খালি হাতেই পাক বাহিনীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এটাই সাহস। কতটুকু সাহস প্রাণে সঞ্চারিত হলে মানুষ মরতেও ভয় পায় না। সেই সাহসের প্রবাহ বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্যে ঢেলে দিয়েছিলেন। যার প্রতিফলন আমরা ২৬শে মার্চের পরে দেখেছি। যখন ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ যেন বিশাল মহাসমুদ্রে এক খণ্ড ভাসমান কাঠের টুকরায় পরিণত হয়েছিল। এদেশে তখন নেতা বলতে মানুষ একজনকেই চেনে, একজনকেই জানে; যার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেই নেতাই তখন এদেশের মাটিতে ছিলেন না; তিনি বাঁচবেন কি মরবেন বা আর কোনোদিন ফিরবেন কিনা তাও কেউ জানত না। দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা শহরসহ প্রতিটি গ্রামেগঞ্জে ঢুকে নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কী হবে এখন? কি করে মুক্তি মিলবে ওই পাকিস্তানি হায়েনাদের থেকে? কে এখন সাহস যোগাবে? সবাই কি তাহলে পাকিস্তানি মিলিটারির গুলির নিচে নিজেকে সঁপে দেবে? নাকি সবাই তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে? না, এসবের কিছুই সেদিন হয়নি। হয়নি তার কারণ বাংলার আকাশে বাতাসে তখন ধ্বনিত হচ্ছিল বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে; মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো; তবুও এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম- আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই ভয়াল মুহূর্তগুলোতে বঙ্গবন্ধু ছিল না। কিন্তু তাঁর সেই বজ্রকণ্ঠ প্রতিটি মানুষের প্রাণে গাঁথা হয়েছিল। তাইতো বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। এই সরকারের অধীনেই সেদিন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়। অতঃপর লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। আজ মহান মুক্তিযুদ্ধের আটচল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে। ৭১’র সেই ভগ্নদশা থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ আজ জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে উন্নত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছে। এই এগিয়ে চলার মাঝেও আছে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের ইতিহাস। দেশ স্বাধীন হওয়ার চার বছর পরই বাংলাদেশের বুকে ঘটে যায় পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যা করা হয়। যেদিন দেশের বাইরে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর এদেশে শাসনভার পেয়ে যায় দুঃষ্কৃতিকারী স্বৈরশাসক গোষ্ঠী। তারপর যখন ১৯৮১ সালে ছয় বছর নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন, তখন থেকে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে। কিন্তু যুদ্ধ তখনও থামেনি। তাঁরই নেতৃত্বে ১৯৯০ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামাতে বাধ্য করা হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১শে আগষ্ট বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে ছোড়া হয় গ্রেনেড। অনেক নেতা কর্মী সেদিন জীবন হারালেও প্রাণে বেঁচে যান জননেত্রী শেখ হাসিনা। এভাবে প্রতিটি পদে পদেই যুদ্ধ এবং ষড়যন্ত্রের ভিতর দিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবুও বাংলাদেশ কখনও দমেনি, থেমে থাকেনি। কারণ এই বাংলার মাটিতে একজন বঙ্গবন্ধু জন্মেছিলেন। যিনি তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে বাঙালি জাতি লড়াই করার মন্ত্র দিয়ে গেছেন। এই মন্ত্র যতদিন আমরা আঁকড়ে থাকতে পারবো ততদিন বাংলাদেশ পথ হারাবে না। বাংলাদেশ এগিয়ে চলবে দুরন্ত দুর্বার গতিতে। তাইতো বলি, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ বাঙালি জাতির পিতা, আমারই ক্ষুদ্রজ্ঞানে তাহার গুণের কথা, লেখার নেই যে ক্ষমতা’ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বা ৭ই মার্চের সেই ভাষণ কতটা প্রভাবিত করে সেই আলোচনা বিশদ। তবে এটাই নির্মম সত্য যে- যেদিন আমাদের রাজনীতির মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেমে যাবে, যেদিন আমাদের ভিতর থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ মুছে যাবে, সেদিনই আমাদের রাজনীতি অন্ধকার সমুদ্রে নিমজ্জিত হবে। জানি, সেইদিন এদেশের বুকে কোনোদিনও আসবে না। কেননা নদীমাতৃক এই দেশে যতদিন স্রোতধারা বইবে, ততদিন ধ্বনিত হবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ।
তানজিনা মনি পরশ বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কর্মী, ইডেন কলেজ শাখা।
৬ই মার্চ ২০২০