পঁচিশে বৈশাখ।এই তারিখটি উচ্চারিত হলেই আমাদের হৃদয়ে,আমাদের অনুভবে,আমাদের সত্বায় একধরণের আত্মশ্লাঘা বা আত্মগৌরব অনুভূত হয় গভীর শ্রদ্ধায়।আমরা যেন সবাই নতজানু হয়ে পড়ি সেই মানুষটির কাছে যিনি শুধু বিশ্বকবি নন,তিনি আমাদের প্রাণের কবি,আমাদের হৃদয়ের কবি । তাঁর নামটি আমাদের চিন্তন,আমাদের মননে উদ্ভাসিত হলেই আমরা যেন আত্মমগ্ন হয়ে পড়ি আমাদের চৈতন্যের কাছে,আমাদের দায়বদ্ধতার কাছে ।তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।যাকে বলা হয় কবি সার্বভৌম। মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশ বা মানব সমাজের অগ্রগমনে এতো বড়ো বিশ্ববিবেক আর আবির্ভূত হয়নি।তিনি মানবতার কবি।বিশ্ব শান্তি আর আর মানুষের কল্যাণে তিনি নিজেকে নিবেদন করেছেন পরমসত্বার কাছে।বিশ্বসভার তিনি ছিলেন নিমগ্ন সাধক।আজীবন যিনি মানুষকে 'মিলাবে মিলিবে'এর সাধনায় আত্মমগ্ন ছিলেন।যাঁর জাতীয়তাবোধ আন্তর্জাতিকতায় উন্নীত হয়েছে আজীবন।যিনি বার বার নিজেকে সমর্পণ করেছেন পরম সত্বার কাছে।
তিনি আমাদের হৃদয়ের কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।প্রথমে মাতৃদেবী,মাতৃদেবীকে হারিয়ে যাকে আঁকড়ে ধরেছিলেন সেই বৌঠান কাদম্বরী দেবী,কাদম্বরী দেবীর পর ভাইপো বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর,বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পর আদরের কন্যা রেনুকা, রেনুকা পর পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর,এরপর প্রিয় পুত্র শমীন্দ্রনাথ ঠাকুর,পরে মধ্যম কন্যা মাধুরীলতা।তাঁর একান্ত নিজের পরিবারের মধ্যেই এতোজন প্রিয় মানুষকে হারিয়ে যখন রবীন্দ্রনাথ ঋষির মতোই নির্বাক হয়ে পড়েছিলেন তখন তিনি তাঁর অন্তর থেকে অনুভব করছিলেন যে তাঁর অহংকারের জন্যই হয়তো ঈশ্বর তাঁকে এই কষ্ট দিচ্ছেন।তিনি আত্মসমর্পণ করে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উচ্চারণ করলেন, " আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধূলির তলে"।
বছর ঘুরে আবার এসেছে পঁচিশে বৈশাখ।এবারের পঁচিশে বৈশাখ এসেছে বিশ্বব্যাপী এক অদ্ভুত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে।করোনা ভাইরাস নামক একটি ভাইরাসের কারণে মানব সমাজ যখন জর্জরিত। এই নেতিবাচক পরিস্থিতিতে আমরা ত্রিপুরাবাসী কিন্তু বসে থাকবো না । সমবেতভাবে না হলেও আমরা ঘরে ঘরে মানবতার এই মহান কবিকে স্মরণান্জলি নিবেদন করবো।কেননা ত্রিপুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সম্পর্ক যে সুগভীর।তাঁর সঙ্গে এক আত্মার বন্ধনে আমরা ত্রিপুরাবাসী জড়িয়ে আছি।
তাঁর "ভগ্নহৃদয়" কাব্যগ্রেন্থর জন্য আঠেরোশো বিরাশি খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরার আলোকপ্রাপ্ত মহারাজা ও কবি বীরচন্দ্র মানিক্যে বাহাদুর কবিকে বিশ্বের মধ্যে প্রথম তাঁকে ভবিষ্যতের কবি হিসেবে সম্মাননা জ্ঞাপন করেছিলেন।কবির বয়স তখন মাত্র বাইশ বছর।মহারাজা বীরচন্দ্র তাঁর সচিব রাধারমণ ঘোষকে কোলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে পাঠিয়ে এই সম্মাননা জ্ঞাপন করেন।
"জীবন স্মৃতি"তে তিনি লিখেছেন,
"ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে আমার যে প্রথম পরিচয়,তা খুব অল্প বয়সে।সেই সময় আমাকে এবং আমার লেখা সম্বন্ধে খুব অল্প লোকই জানতেন।আমার পরিচয় তখন কেবল আমার আত্মীয় স্বজন নিকটতম বন্ধুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। একদিন এই সময়ে ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের দূত আমার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করিলেন। বালক আমি,সসঙ্কোচে তাঁকে অভ্যর্থনা করলাম। তিনি রাধারমন ঘোষ।মহারাজ তাঁকে সুদূর ত্রিপুরা হতে বিশেষভাবে পাঠিয়েছিলেন কেবল একথা জানাতে যে আমাকে তিনি ভবিষ্যতের কবি রূপে অভিনন্দন জ্ঞাপন করছেন।" সেই থেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিন্তন মননে ত্রিপুরা শব্দটি গেঁথে যায়।তিনি ত্রিপুরার ইতিহাস অবলম্বনে রচনা করলেন "রাজর্ষি ", " বিসর্জন ", এবং ": মুকুট "। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্যের প্র্য়ানের পর তাঁর পুত্র মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের আমন্ত্রণে তিনি আঠেরোশো নিরানব্বই সালের সাতাশে মার্চ বসন্ত শ্রীপঞ্চমীতে প্রথম বারের মতো ত্রিপুরায় তাঁর চরণধূলি পড়ে। এরপর তিনি পরপর সাতবার ত্রিপুরায় আসেন।মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য, মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্য , মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর মানিক্য এবং মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য এই চারজন মহারাজার সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। তিনি নিজেই বলেছেন একজন কবির সঙ্গে একটি রাজ্যের চার চারজন রাজার সম্পর্ক পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।এটা শুনলে অনেকেই অবাক হবেন যে,ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মানিক্যের নির্দেশ পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশক আর্থিক সাহায্য গেছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে।কবির একশো ষাটতম জন্মজয়ন্তীতে তাঁর স্মৃতির প্রতি এবং তাঁর অবদানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।
জীবনের শেষ সম্মাননাও রবীন্দ্রনাথ গ্রহন করেছিলেন ত্রিপুরার শেষ মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুরের কাছ থেকে আঠেরোশো একচল্লিশ সালে কবির আশিতম জন্মজয়ন্তীতে মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর কবিকে " ভারত ভাস্কর " সম্মাননা জ্ঞাপন করেন।
ডঃ দেবব্রত দেবরায়
শিক্ষাবিদ,ত্রিপুরা
ছবিঃ সৌজন্যে ইন্টারনেট
৮ই মে ২০২০