Type Here to Get Search Results !

সমান্তরাল " ... বাংলাদেশ থেকে সঞ্জিত চন্দ্র পন্ডিত এর ছোট গল্প

রূপালী চাঁদের আলোকচ্ছটায় জয়ীকে অপ্সরী মনে হচ্ছিল অভিকের। অভিকের হাতে কৃত্রিম আলো আর জয়ীর কাঁধে ব্যাগ শ্রান্ত পায়ে জনমানবহীন বিশাল সবুজের প্রাকৃতিক কার্পেটে প্রবেশ করল ওরা। অভিকের মনে হচ্ছিল অন্তহীন এই পথচলা। রাত্রি প্রায় দ্বি প্রহর অভিক তার দাপ্তরিক জরুরি কাজ করছিল সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে। মফস্বলের কর্মস্থল বিদ্যুৎ এর লুকোচুরি খেলা চলে নিয়মিত। কাজ শেষ করতে করতে কখন যে দ্বি প্রহর অতিক্রম করলো তা কেউ বুঝতে পারে নি। অভিক একটি বেসরকারি সংস্থার মফস্বলের একটি শাখার দায়িত্বে নিয়োজিত আর জয়ী ওই দপ্তরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। দুজনের কাজের বোঝাপড়ার জন্য সংস্থাটির উক্ত শাখাটি অল্পদিনেই একটা বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল। আর এজন্য তাদের দুজনকে খুবই পরিশ্রম করতে হয়েছে। দিনের পর দিন অফিস টাইম অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কাজ করতে হয়েছে। আজ সেরকম একটা দিন ছিল। নিজেদের দেহপল্লব দিয়ে জোৎস্নার গালিচা কেটে কেটে ওরা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলছে। একেবারেই নিরব ওরা মনে হচ্ছে নিঃশ্বাসের শব্দও অন্তরীণ। অভিক মনে পুরানো দিনের বাংলা সিনেমার গানটি বারবার অনুরণিত হচ্ছে ‘এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো বলতো...’ । ও মনে প্রাণে চায় এই পথচলা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক। প্রায় ছয়মাস ধরে অভিক এখানে আবাস গড়েছে । শুধু অভিক নয় অভিকের সহকর্মীরাও চায় জয়ী আর অভিকের পথ একত্রিত হোক। সেজন্য অফিসের সহকর্মীরা অভিকের নিকট আজ এসে বলছিলেন ‘স্যার আপনি কি জয়ীকে ভালোবাসেন?’ অভিক স্মিত হেসে জবাব দিয়েছিল ‘ভালবাসার কথা নিজেকেই জানাতে হয় হয়তোবা কখনো কখনো না জানালেও চলে’। সহকর্মীদের ঘটকালি করার অগ্নিতে পানি ঢেলে দেয়ায় তারা বিরস বদনে চলে গিয়েছিল। জয়ী পরম নির্ভরতায় অভিকের পাশে শব্দহীন হেঁটে যাচ্ছিল আর বারবার অভিকের কথা শোনার জন্য ওর ভাবলেশহীন অবয়বের দিকে দৃষ্টিপাত করছে। কিন্তু অভিক আজ অস্বাভাবিক নিরব। জয়ীর আজ এই অফিসে শেষ দিন ছিল। কাল থেকে পরবর্তী কর্মস্থলে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করতে হবে। সত্যি অভিক আসার পরে অফিসের কাজে সবাই নতুন করে উৎসাহিত হয়েছে। ওর মোটিভেশন আমাদের সকলকে একত্রিত করে কাজে পূর্ণ মনোযোগ দিতে সহায়তা করেছে। জয়ীর কাছে আজ তার সহকর্মীরা এসে বলেছিল আমরা তোমাকে হারাতে চাই না। জয়ী বলেছিল ‘যার আটকে রাখার শক্তি আছে সেই তো নিরব।’ সহকর্মীরা বলেছিল ‘আজকেই স্যার কিছু বলবে।’ জয়ী অভিকের দিকে সেই কাঙ্ক্ষিত শব্দের সম্মিলনে জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু অপেক্ষা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিস্তৃত জোৎস্নার তিন চতুর্থাংশ অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। একটু পরেই জয়ীর বিদায়ের ক্ষণ উপস্থিত হবে। কি করবে জয়ী ? মনের অস্থিরতা কাটাতে ডান হাতে দিয়ে অভিকের বাঁহাতে আলতো স্পর্শ করলো। মেয়েদের অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে তারা শুধুমাত্র অনুভব দ্বারাই পুরুষের অভিব্যাপ্তি বুঝতে পারে এক্ষেত্রে জয়ী তার এই ক্ষমতা ব্যবহার করে অভিককে বুঝতে চেষ্টা করল। স্বপ্নের রাজ্যে হেঁটে বেড়ানো অভিক হঠাৎ স্পর্শে শিহরিত হলো এবং বোঝার চেষ্টা করলো এটা কি কোন আহ্বান না নিছক এক্সিডেন্ট। আর চোখে জোছনার আলোয় জয়ীর ভাবলেশহীন মুখ দেখে অভিক থমকে দাঁড়াল । ‘নাহ্ এটা আহ্বান হতে পারে না’ অভিক নিজেকে বোঝালো। নশ্বর এই পৃথিবীতে সকল পথের একটি শেষ আছে । অভিক বা জয়ী কেউই হয়তো পথের শেষ হোক তা চায় না। কিন্তু বাস্তবতায় ছয়শত গজের মাঠ ওরা অতিক্রম করে । ওরা পৌঁছে যায় জয়ীদের বাসার দরজার সামনে। অভিক আর জয়ী পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেয় রবি ঠাকুরের অমিত লাবণ্যর মতো। ওদের অপ্রকাশিত ভালোবাসা রেললাইনের মতো সমান্তরালে বহমান থাকবে কী? নাকি সময়ের নিষ্ঠুর আবর্তে ফিকে হয়ে যাবে।

সঞ্জিত চন্দ্র পন্ডিত
বাংলাদেশ

৭ই জুন ২০২০


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.