কিছুদিন আগে এক বিকেলে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলাম দৈনিক উত্তরপূর্ব পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক, সিলেট প্রেসক্লাবের সভাপতি ও আমার নিকটজন তাপস দার দিঘলীর বাড়ি। তাপস দাস পুরকায়স্থ আমাদের আশার বাতিঘর, প্রেরণার উৎসভূমি। কিছুদিন যাবৎ ছোটোখাটো অসুখে কাতর হয়ে নিজের বাড়িতেই থাকছেন। বাইরে খুব একটা বের হন না। আমি আমার সহকর্মী আহমদ কবীরকে সঙ্গে নিয়ে তার সাথে অন্তরঙ্গ আলাপে মেতে উঠে সুনন্দ সময় পার করলাম। প্রয়াত আজিজ আহমদ সেলিম ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করলাম দুজনে। সেলিম ভাই ছিলেন তার দীর্ঘদিনের সহকর্মী ও সাংবাদিকতার গুরু। আসলে সেলিম ভাই শুধু যে তারই গুরু ছিলেন তাই নয়, আমাদেরও সবার গুরু ছিলেন। সৎ সাংবাদিকতার পথিকৃৎ সেলিম ভাইয়ের পরে তাপস দা ছাড়া আমাদের ভরসার স্থল আর কেউ নাই। আমাদের পথের দিশা দেবার মানুষ দিনে দিনে কমে গেছে। ফলে চিন্তার দিক থেকে আমরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছি। তাপসদা এদিক থেকে বিরলপ্রজদের একজন হিসাবে আমাদের প্রেরণার তূণীর হয়ে রয়েছেন।যেকোনো সংকটে ও দুর্যোগে তিনি আমাদের পথ এবং পাথেয় উভয়ই। সমাজের রন্ধ্রে থাকা অসুখগুলি তাকে ব্যথিত করে। সমাজের অনেক কিছুই যখন নাই হয়ে যাচ্ছে তখন তিনি বলে উঠেন, আমাদের সাহিত্য আড্ডা, সামাজিক আড্ডা, ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির আড্ডা ও মেলবন্ধন, রাজনৈতিক সুচিন্তাপ্রসূত আড্ডা, খেলার আড্ডা, পারিবারিক আড্ডা সবই এখন নাই হয়ে গেছে। এই নাই হয়ে যাওয়াটা সমাজের জন্য, মানবিক সমাজের জন্য ক্ষতিকর। মানুষ মানুষ থেকে দূরে যাচ্ছে। সকল মানবিক অর্জনকে বিসর্জন দিতে বসেছি।
তার পিতার স্মৃতিচারণ করলেন। বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী সাহেবের ঘনিষ্ঠ সহচর ও রাজনীতিবিদ পিতা হেমচন্দ্র দাস পুরকায়স্থ ছিলেন জনগণের জন্য নিবেদিত। আজীবন স্থানীয় বাসিন্দাদের সুখদুঃখের সাথী ছিলেন পিতা হেমবাবু। এলাকায় বিদ্যুতায়ন থেকে শুরু করে স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা,বাজার ব্যবস্থার উন্নয়ন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তনে তিনি ছিলেন অগ্রদূত। তার পিতার ছবিটির দিকে আমি বারবার তাকাচ্ছিলাম আর তন্ময় হয়ে তার কথা শুনছিলাম। আপাদমস্তক নিরহংকারী মানুষ তাপস দা তার পিতার আদর্শকে লালন করে চলেছেন। হলুদ সাংবাদিকতার গলিঘুজিতে হারিয়ে যাবার মানুষ তিনি নন। সৎ সাংবাদিকতার এক অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আমাদের শ্রদ্ধার আসনটি তিনি কবেই দখল করে ফেলেছেন আমরা টেরই পাই নি।
আমাদের সম্পাদনায় এবার বেরুলো শব্দকথা লিটল ম্যাগাজিনের মুজিববর্ষ সংখ্যা। এতে অকাল প্রয়াত সাংবাদিক আজিজ আহমদ সেলিম ভাইয়ের জীবনের একটি শেষ লেখা আমরা ছাপতে পেরেছি। তাপস দা শুনে এবং তার লেখাটি দেখে খুব আপ্লুত হয়ে পড়েন।
অনেকদিন পরে দাদাকে পেয়ে আমিও আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের অনলাইন পত্রিকার খবরটি তাকে বলা হয় নি আগে। গোগলের এক্সেস আমরা খুব অল্পসময়ের মধ্যেই পেয়ে গেছি বলায় দাদার চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক ছড়িয়ে পড়তে দেখেছি। শুধু শব্দকথার জন্য তার ভালোবাসার সীমাপরিসীমা নেই দেখে আমি অভিভূত। গোগল বাবা দায়িত্ব নেয়ায় আমরা আসলেই আশার আলো দেখছি। মাত্র চারমাস বয়সে গোগল এক্সেস পাওয়ার পেছনে আমার সহকর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর বিনিদ্র অধ্যাবসায় জড়িয়ে আছে।
কাল নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গি দাদার জীবনের সাথে জড়িয়ে আছে। আজীবন নির্মোহ জীবন তিনি উদযাপন করে যাচ্ছেন। অনেকেই যেখানে শহুরে জীবন যাপনে কেতাদুরস্তভাব ফুটিয়ে তুলেছেন সেখানে তিনি উজানস্রোতের যাত্রী, অত্যন্ত সাদামাটা, সহজসরল এবং গ্রামীণ জীবন বেছে নিয়েছেন। দীঘলিয়া থেকে গণপরিবহনে প্রতিদিন বাইশ কিলোমিটার দূরের সিলেট শহর, তার কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। জাগতিক প্রাপ্তির নেশা তাকে কোনোকিছুর পেছনে ছুটে যেতে বাধ্য করতে পারে নি। বরং সকল মোহকে তিনি উষ্টা মেরে ফেলে দেবার মতো ধনুকের ছিলার টানটান করা সাহস দেখিয়ে আমাদের নমস্য হয়ে থাকলেন। আমরা তাকে দেখে সদ্ভাবে বেচে থাকার প্রেরণা পাই। দাদাকে অনেক কিছুই বলতে চাই। দাদাও বলতে চান। কিন্তু মুঠোফোনের উপদ্রবে তিনি তিতি বিরক্ত হয়ে পড়েছেন বলে আমাদের আলাপেও ছেদ পড়ে যাচ্ছিলো। ব্যস্ততার ভেতরেও প্রাণখুলে আমাদের সাথে তিনি গল্পে মশগুল হয়ে থাকলেন। আমাদের স্মৃতির দরজায় কড়া নাড়লেন। সেই যুগভেরীর যুগ থেকে আজকের উত্তরপূর্ব যুগেও আমাদের সম্পর্কে যতি পড়ে নি। আমার গুরু কবি পার্থ সারথি চৌধুরীর কথা বারবার মনে পড়ছিলো যখন দাদার পাশে বসেছিলাম। একসময় পাশে বসতেন আমার গুরু। শীরু ভাইয়ের বাসায় পার্থদার সাথে গেলে এমনিভাবেই গল্প জমে উঠতো। আজ শীরু ভাই,পার্থদা, সেলিম ভাইদের কেউ বেচে নেই। কিন্তু তাদের বিচিত্র কর্মভার ও সম্ভার এবং অত্যাবশ্যকীয়ভাবে তাদের মায়ামাখানো স্মৃতি আমাদেরকে কাতর করে তুলবে। তাদের দেখানো পথেই আমরা পথচলার বাসনা পোষণ করি। প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে, তাই হেরি তাই সকল প্রাণে। এইসব প্রাণের মানুষদের সাহ্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম বলে নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করছি।
কোনো জ্বরা,ব্যধি এইসব মানুষকে কখনো কাবু করে নি, করতে পারে নি। কিন্তু তাদের অনুচিন্তনে ও মননে ছিলো মা,মাটি ও স্বদেশ। ফলে তারা স্বাদেশিক চিন্তায় চিত্তের আনন্দ খুজে পেতে বেকারার ছিলেন। তাপসদাও এই বৃত্তের বাইরের কেউ নন বলে তার কাছে নমিত হই।
একটি শিক্ষিত, ভদ্র সমাজের প্রতিনিধিত্ব তিনি করে থাকেন বলেও তিনি সর্বজনীন ও গণের শ্রদ্ধা তিনি পেয়েছেন। আস্থার জায়গায় যেখানে দিনেদিনে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে সেখানে তিনি ধন্বন্তরি হিসাবে আবির্ভূত হন। আমাদের মতো নিভৃতচারীদের কাছে তিনি ভালোবাসার প্রতীক হয়ে ধরা দেন।
আমাদের গপ্প যোজনার কাল ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কখন তা বুঝতেই পারি নি৷ গল্প যেনো ফুরুতেই চায় না। সহকর্মী কবিরের তাড়নায় উঠতেই হলো। দাদা আরেকদিন জম্পেশ আড্ডায় থাকবেন বললে সে যাত্রায় তিনি নিস্কৃতি পান।